অনেক দিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেট্রো স্টেশনে ট্রেন এসে থামতেই বগির মধ্যে জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের ভিড় প্রায় নাই হয়ে যেতে দেখা গেল। স্বাভাবিকতায় ফিরছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুঝতে পারা যায়। স্টেশন চত্বরেই দেখা মেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী সুপ্রিয়া সিঁথি ও হিসাববিজ্ঞানের শিক্ষার্থী বৃষ্টির। ক্লাস শুরু হওয়ায় দুজনেই বেশ খুশি। সুপ্রিয়া বলেন, অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। তেমনি বাসায় বসে বসে অলস দিন কাটাতে আর ভালো লাগছিল না তাঁর। প্রায়ই মনে হচ্ছিল, অনেক তো হলো। এবার ছুটির পাট চুকিয়ে পড়াশোনায় ফেরা দরকার।
কলাভবনকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রাণকেন্দ্র হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। আজ শিক্ষার্থীদের পদচারণে ভুতুড়ে কলাভবনও যেন ফিরে পেয়েছে প্রাণ। প্রায় সব বিভাগের ক্লাসই শুরু হয়ে গেছে বলে জানা যায়। যেসব বিভাগে এখনো শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়নি, দু–এক দিনের মধ্যেই শুরু হয়ে যাবে বলে জানান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। কলাভবনের আশপাশের লোকসমাগম নেহাত কম নয়। শ্যাডোতে আজ মানুষের ভিড় ছিল বেশ। মল চত্বরেও ক্লাসের ফাঁকে ভিড় জমিয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা।
দোতলায় উঠতেই চোখে পড়ে ইংরেজি বিভাগের করিডর। ঝিমধরা দুপুরের মতো মনে হলো সবকিছু। শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। পুরোদমে চলছে ক্লাস। বেশ কিছু শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি নজরকাড়া। ইংরেজি বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরি অ্যাটেন্ডেন্ট নাসির উদ্দিনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আজ মোটে দুটি ব্যাচের ক্লাস ছিল বিভাগটিতে। তাই শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি তুলনামূলক কম। দুই-তিন দিনের মধ্যে সবকিছু আগের গতিতে ফিরে আসবে বলে আশাবাদী তিনি।
কলাভবনের মূল ফটকের বাইরেই ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের একচিলতে উঠান। জানা যায়, অতিরিক্ত গরম ও আসন্ন হিটওয়েভের আশঙ্কায় এখনো শ্রেণি কার্যক্রম শুরু হয়নি এখানে।
দুপা এগোতেই আসে সমাজবিজ্ঞান চত্বর। শিক্ষার্থীদের আড্ডায় ঢুঁ মেরে জানা যায়, সমাজবিজ্ঞান অনুষদেরও একই হাল। সব বিভাগের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হলেও শ্রেণি কার্যক্রম শুরু হয়নি এখনো। তবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী লামিয়া আহসান মিলি বলেন, ‘আমরা আজ সকাল থেকে ক্লাস করেছি। অনেক দিন পর একসঙ্গে হলাম, সবার সঙ্গে দেখা হলো, সবাই বেঁচে আছে, সুস্থ আছে, এটিই খুব আনন্দ দিয়েছে আমাকে।’
ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের আরেক শিক্ষার্থী হুমায়রা হোসেন বলেন, শিক্ষক থেকে সহপাঠী, সবার সঙ্গে আগের মতো সহজ সম্পর্কের সমীকরণ থাকবে কি না, তা নিয়ে চিন্তা উঁকি দিচ্ছিল তাঁর মনে। আজ অনেক দিন পর সবার সঙ্গে দেখা হলে, তা অনেকটাই কেটে গেছে।
টিএসসির চায়ের দোকানগুলো উৎখাত করা হয়েছে বলে এলাকাটি প্রায় জনমানবশূন্য। আগের মতো চায়ের কাপে আর খুলছে না গল্পের ঝুলি। কার্জন হলের দিকে এগোতেই চোখ পড়ে সারি সারি লাল বাসের দিকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য এ বাসগুলো যেন এক অন্য রকম অনুভূতির নাম। মেট্রোরেলের আরামের নিচেও চাপা পড়েনি লাল বাসের জৌলুস। শুধু ক্লাস নয়, বাসও ফিরে এসেছে তার রোজকার রুটিনে। আন্দোলন–পরবর্তী সময়ে কেবল দুটি করে আপ ও ডাউন ট্রিপে যেত লাল বাস। আজ থেকে চলবে স্বাভাবিক নিয়মে।
কার্জন হলে বহিরাগত দর্শনার্থী নিয়ন্ত্রণে অভিযানের কারণে পরিচয়পত্র দেখিয়ে ঢুকছেন শিক্ষার্থীরা। জীববিজ্ঞান অনুষদের কর্মচারী মিজানুর রহমান খান তাঁদের মধ্যে একজন, যাঁদের ঘাড়ে বর্তেছে পরিচয়পত্র নিরীক্ষণের দায়িত্ব। তিনি বলেন, অধিকাংশ শিক্ষার্থী নিজ উৎসাহেই পরিচয়পত্র দেখাচ্ছেন। জোরজবরদস্তি করতে হচ্ছে না। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের মুখে বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শুরুর আনন্দ তাঁকে মুগ্ধ করছে প্রতিবারের মতোই। সবকিছু আবার আগের গতি ফিরে পাচ্ছে বলে তিনি আনন্দিত।
ছবি: সিফাতুজ্জামান পারভেজ
লেখক: শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়