ভারতে ‘ফেক ওয়েডিং’ ট্রেন্ড: সবকিছু নকল, হুল্লোড়টাই আসল
শেয়ার করুন
ফলো করুন

আমাদের ছোটবেলার কথা যদি বলি—মানে নব্বইয়ের দশক, তাহলে পুতুলের বিয়ের কথা না বললেই নয়। বাড়ির ছোটরা মিলে বেশ ঘটা করে আয়োজন করত এই বিয়ের। দোতলার সাবরিনার ছেলেপুতুল আর চারতলার তাহমিনার মেয়েপুতুলের বিয়ে।

সেটাকে ঘিরে কী হাসি-ঠাট্টা, কী সাজগোজ। শুধু ছোটরাই নয়, এই খেলায় শামিল হতো বাড়ির বড়রাও। কোথাও কোথাও তো সত্যি সত্যি পোলাও-মাংস রান্নাও হতো। শৈশবের এই নিখাদ আনন্দ আজও মনে হলেই একটা অদ্ভুত নস্টালজিয়ায় ডুবে যাই আমরা।
সেই পুতুলখেলা থেকে সময় বদলেছে। বদলে গেছে খেলার ধরনও। এখনকার জেন–জিদের কাছে ট্রেন্ড মানেই অন্য রকম কিছু। হোক সেটা ফ্যাশন, হোক লাইফস্টাইল, সবখানেই চাই নতুনত্ব, চাই ক্যামেরাবান্ধব চমক। আর সেখান থেকেই এসেছে ‘ফেক ওয়েডিং’ নামের এক মজার নতুন ধারা।

বিজ্ঞাপন

বিয়ে হবে না, তবু বিয়ের সব আয়োজন। যেখানে থাকবে মেকআপ, মেহেদি, ফটোশুট, এমনকি বন্ধুদের নিয়ে রিসেপশনও! বর-কনে ছাড়াই পুরো বিয়ের আমেজ। ভারতের মেট্রো শহরগুলোতে এই ‘ফেক ওয়েডিং’ এখন একধরনের সামাজিক ফান ইভেন্ট হয়ে উঠেছে।

ফেক ওয়েডিং: নেই কিছু আছে সব
ফেক ওয়েডিং: নেই কিছু আছে সব

ভারতের দিল্লি, বেঙ্গালুরু আর পুনের মতো বড় শহরে এখন ফেক ওয়েডিং পার্টি রীতিমতো ভাইরাল এক আয়োজন। কনেপক্ষ–বরপক্ষ কিছুই নেই, কিন্তু আছে বিয়ের সব আয়োজন।

সংগীত নাইটে নাচ, ঢোলের বোল, মেকআপ আর মেহেদি, জুতা চুরি আর নকল আগুনের চারপাশে সাত চক্কর, এমনকি নকল পুরোহিতও; যিনি ‘আশীর্বাদ’ দেন কিন্তু পড়েন না কোনো মন্ত্র।

বিজ্ঞাপন

বিয়ে ছাড়া বিয়ের এই ট্রেন্ডের পেছনে কারণ কী? জেন–জি প্রজন্মের প্রতিনিধি আবিন মেহতা বিষয়টি এক বাক্যে বোঝান, ‘বিয়ের মজা তো চাই, কিন্তু দায়িত্ব না থাকলেই ভালো!’

আসলে এখন অনেকেই আছেন, যাঁরা বিয়ের চাপে পড়তে চান না। আবার অনেকে আছেন, যাঁরা বিয়ের সাজসজ্জা, মেহেদির রং, নাচ-গান আর ডেকোরেশন উপভোগ করেন ঠিকই, তবে সেটা কেবল অতিথি হিসেবেই। এই ট্রেন্ড ঠিক সেই মানুষদের জন্য, যাঁরা বিয়ের উজ্জ্বলতা চান, কিন্তু প্রতিশ্রুতির ভার নয়।

এখানে হুল্লোড়টাই আসল
এখানে হুল্লোড়টাই আসল

সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে এ ধরনের ‘ফেক ওয়েডিং’ হয়ে উঠেছে ইনস্টাগ্রাম রিল বা ভাইরাল কনটেন্ট তৈরির আদর্শ প্ল্যাটফর্ম। অনেকেই বলছেন, কনেপক্ষের সাজে যদি কেবল একটা রিলেই হাজার হাজার লাইক-শেয়ার হয়, তাহলে বিয়ে না করেও ‘বিয়ের মতো’ কিছু মুহূর্ত উপভোগ করার কী-ই বা ক্ষতি?

এই ধারাকে জনপ্রিয় করে তুলেছে ভারতের দিল্লিভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান, ‘জুম্মে কি রাত’। তারা আয়োজন করছে ‘ফেক ওয়েডিং থিম পার্টি’, যেখানে চাইলে যে কেউ টিকিট কেটে অংশ নিতে পারেন। টিকিটের দাম ৫০০ থেকে ৩০০০ রুপি পর্যন্ত, যেটা একটা আসল বিয়ের তুলনায় অনেক সস্তা। উপহার দেবার ঝামেলা নেই, বরং থাকছে মনের আনন্দে সাজা, ছবি তোলা, ইনস্টাগ্রাম ফ্রেন্ডলি সেলফি আর মন খুলে নাচার সুযোগ!

আছে এমন ঘোষণাও
আছে এমন ঘোষণাও

এই ট্রেন্ড নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া আলোচনা তুঙ্গে। ইনফ্লুয়েন্সার মুকুল খুরানা ইনস্টাগ্রামে এক পোস্টে লেখেন—
‘তুমি কি এই বিয়েতে অংশ নেবে? তোমার দৃষ্টিভঙ্গি কী? এটা কি শুধু সাময়িক এক ফ্যাশন, নাকি এটা একটা ব্যবসার মডেল হয়ে উঠবে?’
তাঁর এই প্রশ্নের জবাবে কমেন্ট সেকশনে দেখা যায় নানা রকম প্রতিক্রিয়া।
একজন মজার ছলে লিখেছেন, ‘ভাই, ফ্যাড হোক আর মডেল হোক, যদি বিরিয়ানি ঠিকঠাক থাকে, আমরা যাবই।’

আরেকজনের মন্তব্য, ‘সব ট্রেন্ডের মতো এটাও কিছুদিন থাকবে, তারপর মিলিয়ে যাবে।’
কেউ কেউ বিষয়টিকে দেখছেন একধরনের সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের প্রতীক হিসেবে। একজন লিখেছেন, ‘এর মানে কী? আমরা নিজেরাই আমাদের সংস্কার নিয়ে হাসাহাসি করছি!’
আরেকজন জানিয়ে দিয়েছেন স্পষ্ট বিরোধিতা, ‘পাগলামি ছাড়া কিছুই না। আমি কোনো দিন যাব না এ রকম বিয়েতে।’
তবে সবচেয়ে মনোযোগ কাড়ে এক দর্শকের মন খারাপ করা মন্তব্য, ‘আজকাল আসলে কিছুই আর বাস্তব না। আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কী রেখে যাচ্ছি?’

হতে পারে এ এক নতুন ডোপামিন হিট
হতে পারে এ এক নতুন ডোপামিন হিট

একজন খুব দার্শনিকতা দিয়ে লিখেছেন, ‘এমন আয়োজন শুধু ক্ষণিকের আনন্দ খোঁজা। নতুন এক ডোপামিন হিটের মাধ্যম। যেহেতু কিছুতেই আর তৃপ্তি নেই, এই পর্যায়ও একদিন ফুরিয়ে যাবে।’
বাংলাদেশেও যদি জেন–জিরা এমনটা শুরু করে আপনি যাবেন কি? ভাবুন তো, মিরপুরে হচ্ছে ‘ফেক ওয়েডিং নাইট’। ব্যান্ড পার্টি ঢুকেছে, ডিজে হচ্ছে। বিয়ে হচ্ছে না তাতে কী যায় আসে, কনে তো ঠিকই সাজছে। বিয়ের ঝামেলা না নিয়েই বিয়ের আনন্দ, এটাই হয়তো আধুনিক লাইফস্টাইলের জেন–জি ভার্সন! একদম নতুন ‘রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস’:
‘ফেকলি ম্যারিড ইন পার্টি’। কেবল মজা করার জন্য মন্দ নয় কিন্তু। প্রশ্ন উঠতেই পারে, এই ‘ফেক ওয়েডিং’ কি নিছক মজা, নাকি এটা সত্যিই ভবিষ্যতের এক লাইফস্টাইল ট্রেন্ড?
হয়তো উত্তরটা সবার জন্য এক নয়। কেউ দেখছেন আনন্দের নতুন মাধ্যম হিসেবে, কেউ বলছেন সংস্কৃতির বিকৃতি।

তবে একটা বিষয় স্পষ্ট, আমরা এমন এক প্রজন্মে এসে পৌঁছেছি, যেখানে বাস্তব আর অবাস্তবের সীমারেখা ক্রমেই ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়গুলো ব্যক্তিগত সবকিছু আজকাল ক্যামেরার সামনে চলে আসছে। কখনো কনটেন্টের জন্য, কখনো ভাইরাল হবার প্রয়োজনে।

নো দায়িত্ব, কেবল আনন্দ
নো দায়িত্ব, কেবল আনন্দ

বিয়ে মানে কেবল রীতি নয়, দায়িত্বও। কিন্তু যদি সেই দায়িত্ব ছাড়া আনন্দের অংশটুকু প্যাকেজ আকারে বিক্রি হয়, তাহলে সেটা কি খারাপ? নাকি শুধু সময়ের দাবি?
এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো একেকজন একেকভাবে দেবেন। তবে এটুকু ঠিক, আমরা এমন এক সময়ে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে ‘ভান’ আর ‘বাস্তব’ মাঝেমধ্যেই একে অপরের মুখোশ পরে দাঁড়ায়। তাই নিজের বিবেচনাকে প্রাধান্য দেওয়া আর তথ্যপ্রযুক্তির ইতিবাচক ব্যবহারের সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।

ছবি: ইন্সটাগ্রাম হ্যান্ডল

প্রকাশ: ০৭ আগস্ট ২০২৫, ১৩: ৪৮
বিজ্ঞাপন