হ্যালোউইন স্পেশাল: ভুতুড়ে ফুলের গন্ধে যখন পিছু নেয় অতৃপ্ত আত্মা
শেয়ার করুন
ফলো করুন

অক্টোবর মাস যেমন সাদা কাশ আর পেঁজা তুলার মতো মেঘের; তেমনি ভূত চতুর্দশী, অল সোলস ডে আর হ্যালোউইনের আবহে একটা গা–ছমছমে ব্যাপার থেকেই যায়।

একটা গা–ছমছমে ব্যাপারই বটে
একটা গা–ছমছমে ব্যাপারই বটে

আচ্ছা ধরুন, যদি ফুলের সঙ্গে আধ্যাত্মিক সংযোগ চলে আসে, তবে কেমন হয়? না, সুগন্ধি ফুল ফোটে বছরের বিভিন্ন ঋতুতে। এদের মধ্যে অনেক ফুল নিয়ে আছে আধ্যাত্মিক গল্প আর লোকগাথা। আমাদের প্রিয় এমন কিছু ফুলের নেপথ্যের ভৌতিক গল্প শোনানো যাক।

বিজ্ঞাপন

শেওড়াগাছে পেতনি ঠাসা, ছাতিমগাছে ভূতের বাসা

ছাতিম ডাকে ভূতেদের
ছাতিম ডাকে ভূতেদের

ছাতিম ফুল, যাকে মানুষ ‘ডেভিলস ট্রি’ বা ‘সপ্তপর্ণী’ নামেও চেনে। সাতটি পাতা একসঙ্গে থাকার কারণেই এর সংস্কৃত নাম ‘সপ্তপর্ণী’। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে প্রচলিত আছে যে এই ফুলের তীব্র গন্ধ নাকি ভূতেদের ডাক পাঠায়। সন্ধ্যা নামলে ছাতিমের গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। কেউ কেউ বলেন, এই গাছের নিচে দাঁড়ালে চারপাশে অনুভব করা যায় অদৃশ্য উপস্থিতি। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ও ‘পথের পাঁচালী’তে এই ফুলের সৌন্দর্য বর্ণনা করেছেন এক রহস্যময় আবেশে। যদিও বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই, তবু এই গাছকে ঘিরে থাকা ভয় আর লোকবিশ্বাস যেন আজও আমাদের কল্পনাকে ছুঁয়ে যায়।

বিজ্ঞাপন

বিষণ্নতার গন্ধে ভরা দেবলোকের ফুল শিউলি

শিউলির গন্ধ বেড়ে গেলে বুঝতে হবে অশরীরি কেউ আছে চারপাশে
শিউলির গন্ধ বেড়ে গেলে বুঝতে হবে অশরীরি কেউ আছে চারপাশে

শিউলি নামেই আছে বিষণ্নতার ছোঁয়া। একে বলা হয় দুঃখের বৃক্ষ। সন্ধ্যায় ফোটে, সকালে ঝরে যায়; যেন জীবনের ক্ষণস্থায়িত্বের প্রতীক। শিউলি দেবী দুর্গার প্রিয় ফুল, যা মাটিতে পড়লেও পবিত্র হিসেবে পূজায় নিবেদন করা হয়। অনেকে বলেন, শিউলির গন্ধ আত্মার সঙ্গে আত্মার সংযোগ ঘটায়। তাই তো, কখনো হঠাৎ এই গন্ধ পেলে মন ভারী হয়ে যায়, পুরোনো স্মৃতি বা অজানা দুঃখ ফিরে আসে।
লোকবিশ্বাস বলে, রাতে একা হাঁটতে গিয়ে যদি হঠাৎ শিউলির গন্ধ বেড়ে যায়, বুঝে নিতে হবে যে আশপাশে কোনো আত্মা ঘোরাঘুরি করছে।

ইন্ডিয়ান পাইপ: আত্মার শান্তির ঘোস্ট ফ্লাওয়ার

রহস্যময় সাদা ফুল
রহস্যময় সাদা ফুল

ইন্ডিয়ান পাইপ; এক রহস্যময় সাদা ফুল, যাকে বলা হয় ঘোস্ট ফ্লাওয়ার। কোনো সবুজ পাতা নেই, আলো ছাড়াই জন্মায় অন্ধকার মাটিতে। চেরোকি কিংবদন্তিতে বলা হয়, একদা দুই গোত্রের মধ্যে যুদ্ধ চলাকালে শান্তির জন্য প্রার্থনায় একত্র হলে মহান আত্মা তাদের রূপান্তরিত করেন এই সাদা ফুলে। তাই ইন্ডিয়ান পাইপ আত্মার শান্তি ও ক্ষমার প্রতীক।

ফরেস্ট ঘোস্ট ফ্লাওয়ার

রহস্য ও ভয়ের ফুল এটা
রহস্য ও ভয়ের ফুল এটা

নেপাল ও ভারতে এই ফুল দেবতা শিব ও পার্বতীর পূজায় ব্যবহৃত হয়। প্রাচীন কবিতায় এটি স্মৃতি ও প্রতিফলনের প্রতীক হিসেবে উল্লেখ আছে। এর অদ্ভুত জীবনচক্র অন্য গাছের মূলের ওপর নির্ভরশীল বলে এটি রহস্য ও ভয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছে।

ম্যাজেন্টা ঘোস্ট ফ্লাওয়ার

মৃত আত্মাদের শান্তির প্রতীক এই ফুল
মৃত আত্মাদের শান্তির প্রতীক এই ফুল

দক্ষিণ ভারতের পশ্চিমঘাট অঞ্চলে এই ফুলকে মৃত আত্মাদের শান্তির প্রতীক বলা হয়। লোককথা বলে, এটি সেই জায়গায় জন্মায়, যেখানে কোনো আত্মা অবশেষে শান্তি পায়। ফুল শুধু সৌন্দর্য নয়, অনেক সময় তা হয়ে ওঠে আত্মার বার্তাবাহক, সময়ের সাক্ষী। হয়তো সবই কল্পনা, কিন্তু সেই কল্পনাতেই লুকিয়ে থাকে হ্যালোউইনের রোমাঞ্চ।

দেবতার রক্ষাকবচ নাগকেশর

মৃতদের আত্মাকে দেখায়
মৃতদের আত্মাকে দেখায়

নাগকেশর ফুলকে প্রাচীনকাল থেকেই দেবতার আবাসের প্রতীক বলা হয়। হিন্দু পুরাণে বিশ্বাস করা হয়, নাগকেশর গাছে বাস করেন দেবদূতেরা; এর নিচে বসে ধ্যান করলে আত্মা পরিশুদ্ধ হয়। কোনো কোনো লোককথায় বলা হয়—নাগকেশর ফুল দিয়ে পিণ্ডদান বা শ্রাদ্ধ করলে মৃত আত্মা শান্তি পায়, কারণ এর গন্ধে নাকি "পৃথিবী ও পরলোকের মাঝের পথ" খুলে যায় এক মুহূর্তের জন্য।

তিব্বতীয় আধ্যাত্মিক ধারায়ও এই ফুলকে আত্মাশুদ্ধির ফুল বলা হয়—যেখানে নাগকেশরের ধোঁয়া মৃতদের আত্মাকে সঠিক পথে নিয়ে যেতে সাহায্য করে বলে বিশ্বাস করা হয়।

দেবী ও আত্মশক্তির প্রতীক বেলি

অশরীরী আত্মার প্রতিরোধক বেলি
অশরীরী আত্মার প্রতিরোধক বেলি

বেলি ফুল শিবের পূজার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, কিন্তু এর আধ্যাত্মিক অর্থ অনেক গভীর। প্রাচীন শৈব ও তান্ত্রিক বিশ্বাসে বেলফুলের তিনটি পাপড়ি তিনগুণ শক্তির প্রতীক—সৃষ্টি, সংহার ও সংরক্ষণ। বলা হয়, বেলি ফুল শুধু দেবতার পছন্দ নয়, অশরীরী আত্মার প্রতিরোধক হিসেবেও কাজ করে লোককথায় শোনা যায়, অমাবস্যার রাতে যদি কেউ বেলি ফুল গাছের নিচে ঘুমিয়ে পড়ে, তবে দেবতার ছায়া তাকে আশ্রয় দেয়, কিন্তু যে অশুভ আত্মা ঘোরাফেরা করে, তারা নাকি সেই গাছের গন্ধ সহ্য করতে পারে না। এই কারণেই অনেক ঘরে আজও বেলপাতা বা বেলি ফুল রাখা হয় ‘নজর লাগা’ ঠেকাতে।

রাতের গোপন গন্ধ ও আত্মার আহ্বানের রজনীগন্ধা

এই ফুলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে রাতের রহস্য
এই ফুলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে রাতের রহস্য

রজনীগন্ধার ইংরেজি নাম— টিউবরোজ: নাইট–ব্লুমিং বিউটি’।  কিন্তু আমাদের লোকগাথায় এর গন্ধের সঙ্গে জড়িয়ে আছে রাতের রহস্য।

বলা হয়, এই ফুল প্রথম ফুটেছিল এক অভিশপ্ত কন্যার চোখের জল থেকে—যে রাতভর অপেক্ষা করেছিল তার মৃত প্রেমিকের ফেরার আশায়। তাই এর গন্ধে আছে বিষাদ, আকুলতা আর মৃত্যুর পরেও ভালোবাসার স্মৃতি।

গ্রামীণ বাংলায় অনেক জায়গায় বিশ্বাস করা হয়— মধ্যরাতে রজনীগন্ধার গন্ধ ঘরে হঠাৎ তীব্র হয়ে উঠলে বুঝতে হবে অদৃশ্য কোনো আত্মা কাছাকাছি আছে। পুরনো বাড়ি বা পরিত্যক্ত বাগানে এই ফুলের সুবাসকে অনেকে আত্মার উপস্থিতির ইঙ্গিত হিসেবে মানে।

তাই এই গতায়ু অক্টোবরের রাতে, যদি হঠাৎ বাতাসে ছাতিম বা শিউলির গন্ধ ভেসে আসে, একটু থামুন। ভাবুন, হয়তো কোনো অতৃপ্ত আত্মা তার গল্পটা শোনাতে চাইছে। তবু শেষে, রোমাঞ্চটুকু রেখে দিন আমাদের পৃথিবীতে।

একগুচ্ছ ফুল হাতে প্রিয়জনকে বলুন, হ্যাপি হ্যালোউইন!

ছবি: এআই ও উইকিপিডিয়া

প্রকাশ: ৩০ অক্টোবর ২০২৫, ১৭: ০০
বিজ্ঞাপন