এক দশক ধরে প্রতি আষাঢ়ে এই ব্যতিক্রমী আয়োজন করছেন ফ্যাশন ডিজাইনার, ভিজ্যুয়াল আর্টিস্ট ও রন্ধনশিল্পী ফায়জা আহমেদ। বাংলা বছরের প্রতিটি মাস যেন আত্মিকভাবে উদ্যাপনের একটি উপলক্ষ হয়ে ওঠে, সে ভাবনা থেকেই এ উদ্যোগ।
এবারের চা–চক্রের আসর বসে গুলশান ২–এর ৬৩ নম্বর রোডের ১২/এ ছয়তলা ভবনের চিলেকোঠার পাশেই। আষাঢ়ের বিকেলে আকাশে মেঘ–রোদ্দুরের খেলা। ঘরে ঢুকতেই ধূপের মিষ্টি গন্ধে মনে হচ্ছিল হুট করেই চলে গিয়েছিলাম ভাটি অঞ্চলের কোনো এক বর্ষণমুখর সন্ধ্যায়।
ঘরে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ল কালো বোর্ডে সাদা চক দিয়ে লেখা—আষাঢ়ের চা–চক্র। কাঁসার পাত্রে জলে ভাসছে কৃষ্ণচূড়ার পাপড়ি আর ছোট ছোট ভাসমান মোমবাতি। বেতের চৌকিতে বসে গান শোনার ব্যবস্থা। ঘরজুড়ে ছিমছাম মাটির সজ্জা, ছাদের দড়িতে ঝোলানো তিনকোনা কাপড়ের ঝালর আর মানাসের শাড়ির তৈরি পর্দা, সব মিলিয়ে চারপাশটা ছিল মনকাড়া।
অতিথিরাও এসেছিলেন পরিপাটি বাঙালি বসনে। চা–চক্রের সূচনা হয় লোকসংগীত দিয়ে। দোতারার আত্মিক সুরে গায়েন গোলাম পাঞ্জাতোন প্রথমেই গেয়ে ওঠেন, ‘আমার হাড় কালা করলাম রে’। এরপর একে একে পরিবেশন করেন ‘খাঁচার ভেতর অচিন পাখি’, ‘আমি অপার হয়ে বসে আছি’, ‘সত্য বল, সুপথে চল’সহ নানা আধ্যাত্মিক সুর। গান শুনে মুগ্ধতার আবেশ ছড়িয়ে পড়ে আসরে।
শিল্পী গোলাম পঞ্জাতোন জানান, ছোটবেলা থেকেই গানকে সঙ্গী করে বড় হয়েছেন। বললেন, ‘লালনের গান শুধু কানে শোনার নয়, অনুভবের।’ এর পরের পরিবেশনা ছিল তানভীর আলম সজীবের। তিনি শুরু করেন শচীন দেববর্মনের ‘বর্ণে গন্ধে ছন্দে’ দিয়ে। সূচনা আসর থেকেই আছেন সজীব।
গানের ফাঁকে কথা হয় ফায়জা আহমেদের সঙ্গে। তিনি বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল ঘুরে বেড়ান শিকড়ের সন্ধানে। তিনি বিশ্বাস করেন, যেকোনো অঞ্চলের খাবারের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে সেই অঞ্চলের সংস্কৃতি ও শিকড়ের আস্বাদন। বাংলার বারো মাস ধরে তিনি আয়োজন করে থাকেন চা–চক্রের; যেখানে খাবার, গান এবং মানুষে মানুষে সংযোগ গড়ে ওঠে।
এবারের চা–চক্রে পরিবেশিত মিষ্টি এসেছে মানিকগঞ্জ থেকে। আনা হয়েছে খই, চাল, চিড়ার নাড়ু। সাধারণত নাড়ু ঘি দিয়ে বানানো হয়, কিন্তু গ্রামাঞ্চলে এখনো সরিষার তেল ব্যবহার করে নাড়ু তৈরি করা হয়। বিশেষ করে খই গুঁড়া করে বানানো নাড়ুর স্বাদ আলাদা। বর্ষার বিকেলে যে ধরনের নাশতা বাঙালির ঘরে হয়, অনেকটা তেমনই ছিল।এই যেমন ডালপুরি, আলুর চপ, পুরি ছিল এবারের আয়োজনে। মানিকগঞ্জে সপ্তাহে দুই দিন বুধ ও বৃহস্পতিবার হাট বসে। সেখানকার একজন বিশেষ কারিগরের কাছ থেকে বানিয়ে আনা হয়েছে নিমকি।
পরিবেশন করা হয়েছে বিভিন্ন রকম মসলা দিয়ে তৈরি চা। উপকরণ হিসেবে ছিল হলুদের গুঁড়া, খেজুরের গুড়, আমলকী ও পুদিনাপাতা। সবকিছুই এসেছে ফায়জার নিজস্ব ভেগান উদ্যোগ ‘সঞ্চয়িতা’ থেকে। সঞ্চয়িতা থেকে যে বিশেষ গুড়ের বাদাম টানা নিয়মিত গ্রাহকদের জন্য বিক্রি হয়, তা–ও ছিল এখানে। পাশেই ছিল তাঁর ব্র্যান্ড ‘মানাস’–এর শাড়ি ও পোশাকের প্রদর্শনী। পরিবেশবান্ধব তালপাতার প্লেটের ওপর কলাপাতা দিয়ে পরিবেশন করা হচ্ছিল খাবার।
আয়োজনটি স্বাভাবিক ধারার বাইরে, অপ্রচলিত বলেই হয়তো কারও কাছে বিরক্তিকর লাগতে পারে। অনেকেই ভাবতে পারেন, ১ হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে মুড়ি-মুড়কি খাওয়ানো হচ্ছে। অথচ এর পেছনের গল্পটা একেবারে আলাদা। এসব ভেবেই ফায়জা এবার তাই রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থা রেখেছিলেন। কারণ, শুরুতে এই আয়োজনে কোনো রেজিস্ট্রেশন ফি ছিল না। ইভেন্ট ঘোষণার পর ১৫ দিন ধরে চলে ফোনে ফোনে আলাপ, হাতে হাতে গিয়ে খাবার চেখে দেখা। সবই অতিথিদের সন্তুষ্টি ও ভিন্ন অভিজ্ঞতার জন্য।
আজকাল ভার্চ্যুয়াল রেস্টুরেন্টের মাধ্যমে ঘরে বসেই যেকোনো খাবার পাওয়া যায়। কিন্তু এই যে আয়োজন—একসঙ্গে গান, চা, জলখাবার আর আন্তরিক কথোপকথনের সুযোগ—এটাও তো জীবনের এক অন্য রকম উদ্যাপন। আমরা নবান্ন বলতেই বুঝি নতুন ধান। অথচ আষাঢ়ে আমন ধান ওঠে, তা দিয়েই হয় নাড়ু-মোয়া। সে গল্প অনেকেই জানে না, এ সময় খেজুরের গুড় হয় না, তালের গুড় হয়। সেই গল্প জানাতে পারাটা, বলতে পারাটা একরকম আনন্দই বটে।
এটা নিছক এক চা–চক্র নয়, বরং এই আয়োজনের নেপথ্যে আছে বাঙালির যাপনের গল্প, যা এই শহুরে আবহে নতুন করে ভাবায় এবং জাগিয়ে তোলে এক গভীর জীবনবোধ।
ছবি: হাল ফ্যাশন