১৯ মে ২০২৪, রোববার স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে আটটায় মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় বাংলাদেশের লাল–সবুজ পতাকা সামিট সম্পন্ন করেন বাবর আলী। ভোরে বেজক্যাম্প টিমের বরাতে এ তথ্য নিশ্চিত করেন অভিযানের প্রধান সমন্বয়ক ফরহান জামান।
বাবর আলী এক স্বপ্নচারী অভিযাত্রী
কাগজে-কলমে বাবর আলীর এই অভিযান আজ থেকে দেড় মাস আগে শুরু হলেও তাঁর কঠিন অধ্যবসায় শুরু হয়েছিল ১০ বছর আগে। ২০১৪ সালে পর্বতারোহণ ক্লাব ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ক্লাব সতীর্থদের নিয়ে নেপাল ও ভারতের বহু পর্বতে অভিযান করেছেন তিনি। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে তিনি সামিট করেছেন নেপালের আমা দাবলাম পর্বত। পর্বতারোহণ তাঁর নেশা হলেও সাইক্লিং, ম্যারাথন ও স্কুবা ডাইভিংয়ের মতো অ্যাডভেঞ্চারে নিয়মিত মেতে ছিলেন তিনি। অ্যাডভেঞ্চারের তাড়নায় পায়ে হেঁটে ঘুরেছেন দেশের ৬৪ জেলা, সাইকেলে পাড়ি দিয়েছেন ভারতের কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারীর পথ। বান্দরবান থেকে হিমালয়, সুন্দরবন থেকে দক্ষিণ ভারত; যে জনপদেই তিনি গেছেন, সাক্ষী হয়েছেন অভূতপূর্ব কিছু মুহূর্তের। প্রকৃতির প্রতি তাঁর এই ভালোবাসা ও বিস্ময় প্রতিনিয়তই মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। সেই সূত্র ধরেই অবশেষে পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়া থেকে পৃথিবী দেখার স্বপ্নও সার্থক করেছেন এই তরুণ পর্বতারোহী। তাঁর মানে, কঠিনতম পথে জয়ী হতে চাই অধ্যবসায়, অনুশীলন ও পরিশ্রম। যার সমন্বয় করতে পারেন চূড়ান্ত বিজয়ী।
বহু ত্যাগ স্বীকার করেই এই পথ তৈরি হয়েছে
নানাবিধ দুঃসাহসী কর্মকাণ্ডের কারণে পরিচিতি পেলেও বাবর পেশায় মূলত একজন ডাক্তার। চট্টগ্রামের হাটহাজারীর বুড়িশ্চর এলাকার লেয়াকত আলী ও লুৎফুন্নাহার বেগমের দ্বিতীয় সন্তান বাবর ছিলেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ৫১তম ব্যাচের ছাত্র। কিছুদিন জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করলেও আমা দাবলাম অভিযানের সময় ছুটি না পাওয়ায় ত্যাগ করেন চাকরির মোহ। বড় কিছুর জন্য এমন মোহ ত্যাগ তাঁকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়।
অভিযোজন করতে শিখতে হয়েছে তাঁকে
যেকোনো প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়াকে অভিযোজন বলা হয়। অর্থাৎ হিমশীতল বরফাচ্ছন্ন পরিবেশ বা ধু ধু মরুভূমি, যেকোনো পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া। এভারেস্ট অভিযানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তুতি হলো একাধিকবার উচ্চতায় ওঠানামা করে উচ্চতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া। যে কারণে পর্বতারোহীদের আগে থেকেই উচ্চতায় মানিয়ে নেওয়ার জন্য যেতে হয় পাহাড়ের চূড়ায়। সেখানে অক্সিজেন কম থাকায় নিজেকে মানিয়ে নেওয়া বেশ কঠিন, যিনি যত ভালো তা আত্মস্থ করতে পারেন, তিনি তত ভালো পর্বতারোহী হয়ে ওঠেন। ২০১৬ সাল থেকে কেয়াঞ্জিন রি, সারগো রি, সুরিয়া পিক, মাউন্ট ইয়ানাম, মাউন্ট ফাব্রাং, মাউন্ট সিসিকেএন, মাউন্ট শিবা, মাউন্ট রামজাক, আমা দাবলাম, চুলু ফার-ইস্ট, চুলু ইস্ট ১ হাজার ৫০০ ফুট থেকে ২২ হাজারের বেশি ফুট উচ্চতার পাহাড় সামিট করে নিজেকে প্রস্তুত করেছেন চূড়ান্ত বিজয়ের জন্য।
একাগ্রতা ও অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে প্রতিজ্ঞা
বাংলাদেশ থেকে বাবর আলী নেপালের উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন এপ্রিলের ১ তারিখ। প্রস্তুতিমূলক কাজ শেষ করে তিন দিন পরই ৪ এপ্রিল কাঠমান্ডু হতে উড়ে যান পৃথিবীর অন্যতম বিপজ্জনক বিমানবন্দর লুকলাতে। সেই লুকলা থেকে পথচলা শুরু করেন শত কিংবদন্তি পর্বতারোহীদের চলা পথে। ১০ এপ্রিল বাবর পৌঁছে যান এভারেস্ট বেজক্যাম্পে। কিন্তু কয়েক দিন অপেক্ষার পরও নেপালের দায়িত্বরত দল পথ তৈরি করতে পারেনি। তাই বাবর বিকল্প বেছে নেন, ১৬ এপ্রিল সামিট করেন ২০ হাজার ৭৫ ফুট উচ্চতার লবুচে ইস্ট পর্বত। এরপর আবারও বেজক্যাম্পে ফিরে পর্বতের নিচ অংশের পথ খুলে গেলে ২৬ এপ্রিল বেজক্যাম্প থেকে যাত্রা শুরু করে ক্যাম্প-২ পর্যন্ত ঘুরে এসে শেষ করেন উচ্চতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার পর্ব। এরপর শুরু হয় দীর্ঘ অপেক্ষা।
শুভাকাঙ্ক্ষী আবহাওয়াবিদ মোস্তফা কামাল পলাশের কাছ থেকে জানতে পারেন ১৯ থেকে ২১ এপ্রিল চূড়ার পরিবেশ কিছুটা শান্ত থাকবে। এরপরই ১৪ এপ্রিল মাঝরাতে বেজক্যাম্প থেকে শুরু হয় বাবরের স্বপ্নের পথে যাত্রা। প্রথম দিনেই সরাসরি উঠে যান ক্যাম্প-২–এ, যার উচ্চতা ২১ হাজার ৩০০ ফুট। পরিকল্পনা অনুসারে সেখানে দুই রাত কাটিয়ে বাবর ১৮ মে উঠে যান ২৪ হাজার ৫০০ ফুট উচ্চতার ক্যাম্প-৩ এবং ১৯ মে পৌঁছে যান ক্যাম্প-৪। ২৬ হাজার ফুট উচ্চতার এই ক্যাম্পের ওপরের অংশকে বলা হয় ডেথ জোন। অবশেষে ১৮ মে মাঝরাতে আবারও শুরু হয় বাবরের যাত্রা এবং ভোরের প্রথম কিরণে ২৯ হাজার ৩১ ফুট উচ্চতার মাউন্ট এভারেস্ট শীর্ষে উড়িয়ে দেন বাংলাদেশের পতাকা।
অভিযানের অর্থায়ন ও মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত একটি অভিযান
এই অভিযানের মোট খরচ ৪৫ লাখ টাকা; যাতে মূল পৃষ্ঠপোষক হিসেবে ছিল ভিজ্যুয়াল নিটওয়্যার লিমিটেড। এ ছাড়া সহ-পৃষ্ঠপোষক ছিল এভারেস্ট ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, ঢাকা ডাইভার্স ক্লাব, বীকন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, ব্লু জে, চন্দ্রবিন্দু প্রকাশনী, গিরি, ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স। এ ছাড়া অভিযানের জন্য গণ তহবিল বা ক্রাউড ফান্ডিং সংগ্রহে অংশ নিয়েছেন দেশ-বিদেশের নানা সামাজিক ও ক্রীড়া সংগঠন এবং অগণিত শুভাকাঙ্ক্ষী। অভিযানের সার্বিক সমন্বয় করেছে বাবর আলীর নিজের ক্লাব ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স।
ছবি: বাবর আলী