রং নানাভাবে আমাদের প্রভাবিত করে। ক্রোমোথেরাপিস্টরা রং ব্যবহার করে রোগ উপশম করেন। রঙের প্রভাব নিজেকে কীভাবে পরিবর্তন করে, তা জানা যেমন প্রয়োজন, তেমনি ব্যক্তিজীবনে এর প্রয়োগের ক্ষেত্রে পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে। লিখেছেন সহকারী চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী ও আর্টথেরাপিস্ট জাহিদ হাসান নীল
আমরা রং নিয়ে প্রতিনিয়ত নানা অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হই; যেমন মেজাজ খারাপ হয়ে চোখ-মুখ লাল হয়ে গেলে বুঝতে পারি মানুষটি রেগে গেছেন, রোদের প্রখরতা থেকে বাঁচতে আমরা বিভিন্ন রঙের রোদচশমা ব্যবহার করি, মুঠোফোনের নীল আলো ব্যবহারে অনেকের ঘুমের সমস্যা হয় আবার মন খারাপ থেকে ভালো থাকার জন্য অনেকে সবুজ রঙের প্রাধান্য আছে—এমন কোনো জায়গায় যেতে পরামর্শ দেওয়া হয়। তাহলে এটা থেকে বোঝা যায়, রং ও মানুষের জীবন ওতপ্রোতভাবে জড়িত, যেখানে রং মনকে নিয়ন্ত্রণ বা শাসন করার ক্ষমতা রাখে।
রঙের এই মন শাসন করার ক্ষমতা আছে বলেই মন বা শরীরের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে পিথাগোরাস ২ হাজার ৫০০ বছর আগে রঙের ব্যবহার করেছিলেন। পরে ইবনে সিনা বলেন, রং হলো একটি রোগের পর্যবেক্ষণযোগ্য লক্ষণ। তিনি একটি রঙের চার্ট তৈরি করেছিলেন, যেখানে শরীরের তাপমাত্রা এবং শারীরিক অবস্থার সঙ্গে রঙের সম্পর্ক নির্ধারিত ছিল। আরও পরে ১৮৭৬ সালে আধুনিক থেরাপি বা ক্রোমোথেরাপির জন্ম দিয়েছিলেন অগাস্টাস প্লেসনটন। এ ছাড়া এডউইন ডোয়াইট ব্যাবিট কালারথেরাপি উন্নয়নে কাজ করেন।
আবার বর্তমানে মনোবিজ্ঞানীরা মনোরোগ চিকিৎসায় রোগীর হাত কাটার তীব্রতা থেকে বাঁচাতে হাতের যে অংশ কাটতে ইচ্ছা করে, সে অংশে লাল রং ব্যবহার করতে বলেন, যা দেখে রোগী হাত কাটার ইচ্ছাকে ভিন্নভাবে মোকাবিলা করতে শেখে। এ তো গেল কৌশলের কিছু প্রায়োগিক দিক, কিন্তু যে থেরাপি বা কৌশল নিয়ে এত কথা বলছি, সেই রং বা কালারথেরাপি অথবা ক্রোমোথেরাপি বলতে কী বোঝায়, তা জেনে নেওয়া যাক।
সাধারণভাবে বলতে গেলে রং বলতে আলো ও শক্তির সমন্বয়কে বোঝায়। দৃশ্যমান আলো সব ধরনের কণা, অণু ও বস্তুর মাধ্যমে প্রতিফলিত বাঁক ও প্রতিসরণ ঘটায়। আলোর দৃশ্যমান তরঙ্গদৈর্ঘ্য প্রায় ৩৯০ থেকে ৭৫০ ন্যানোমিটার সীমার মধ্যে পড়ে, যা দৃশ্যমান বর্ণালি হিসেবে পরিচিত। কালারথেরাপি বা ক্রোমোথেরাপি এমন একটি কৌশল, যা মানুষের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের বিভিন্ন সমস্যার উন্নয়নে আলোর বৈজ্ঞানিক ব্যবহার বোঝায়। এটি বর্তমানে একটি সহযোগী থেরাপি বা চিকিৎসাকৌশল হিসেবে বেশি পরিচিত।
এবার নিশ্চয় আপনাদের মনে প্রশ্ন জাগছে, কীভাবে মানবমনে এই থেরাপি কাজ করে, তার কি কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে? এ প্রশ্নের উত্তর যেভাবে দেওয়া যেতে পারে, তা হলো, রং বা কালারথেরাপির দুটি প্রধান প্রায়োগিক কৌশল আছে। একটি দৃষ্টিশক্তির প্রয়োগের মাধ্যমে, অর্থাৎ নির্দিষ্ট রঙের দিকে তাকিয়ে শরীর কাঙ্ক্ষিত প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে। আরেকটি হলো আলোর মাধ্যমে বা শরীরের বিভিন্ন অংশে সরাসরি কিছু রং প্রতিফলিত করে।
তা ছাড়া রঙিন কাপড় পরে, রঙিন খাবার খেয়ে (রঙিন শাকসবজি), রঙের সঙ্গে কল্পনা করে বা ধ্যান করে (কল্পনা করে শ্বাস নেওয়া ও ছাড়া), রঙিন আলো ব্যবহার করে (নিয়ন আলোয় অন্তরঙ্গ মুহূর্ত), রং দিয়ে নিজেদের ঘিরে রেখে (সবুজ বাগান, নীল আকাশের মধ্যে থাকা), রঙিন ম্যাসাজ অয়েল ব্যবহার করা (অ্যারোমাথেরাপি) ইত্যাদির মাধ্যমেও সেটা করা যেতে পারে।
কালারথেরাপিস্টরা বিশ্বাস করেন, রং আমাদের চোখ বা ত্বকের মাধ্যমে শরীরে ঢুকতে পারে এবং প্রতিটি রঙের তরঙ্গদৈর্ঘ্য ও ফ্রিকোয়েন্সি ভিন্ন, তাই প্রতিটি ভিন্ন ভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সি মানুষের মন, মেজাজ ও শরীরে ওপর আলাদা প্রভাব ফেলে। যেমন লাল রং সাধারণত উত্তেজক হিসেবে ব্যবহার করা হয়; আবার সাদা রং ব্যবহার করা হয় শান্ত প্রভাবের জন্য। এ ছাড়া কোনো পণ্য বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্তে রং ভূমিকা রাখে। রং স্নায়ুতন্ত্রকে (আতঙ্কে) প্রভাবিত করতে পারে, অ্যাড্রিনাল গ্রন্থিগুলোকে উদ্দীপিত করতে পারে এবঙ রক্তচাপ বাড়িয়ে দিতে পারে (মানসিক চাপ)। আবার লুশার কালার টেস্টের মাধ্যমে মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা পরিমাপ করা যেতে পারে।
‘বেনীআসহকলা’ দিয়ে আমরা যেমন রংধনুর রংকে বুঝি, ঠিক তেমনি মানবমনে কেমন করে ভিন্ন ভিন্ন রং ভিন্ন ভিন্ন অবস্থাকে নির্ধারণ করে, তা জানা যেতে পারে। যেমন—
লাল: লাল রং ব্যক্তিকে উজ্জীবিত থাকতে অনুপ্রাণিত করে। আবার কখনো লাল নেতিবাচক উদ্দীপক হিসেবেও কাজ করে
নীল: ক্রোমোথেরাপিস্টরা বিষণ্নতা ও ব্যথা নিরাময়ের জন্য নীল রং ব্যবহার করেন। নীলের গাঢ় শেডগুলোতেও ঘুমের বৈশিষ্ট্য রয়েছে বলে মনে করা হয়।
সবুজ: সবুজ প্রকৃতির রং। ক্রোমাথেরাপিস্টদের মতে, এটি মানসিক চাপ উপশম করতে এবং ব্যক্তিকে শিথিলায়নে সাহায্য করে। এ ছাড়া অনেক পুষ্টিবিদ রোগীদের ওজন কমানোর কৌশল হিসেবে সবুজ রঙের থালা ব্যবহার করতে বলেন, কারণ সবুজ রঙের থালায় অল্প পরিমাণের খাবার অনেক বেশি মনে হয়।
হলুদ: হলুদ মনকে উদ্দীপ্ত, খুশি ও আশাবাদী করতে ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া ক্ষুধা বাড়াতে এই রঙের প্রভাব রয়েছে। এ কারণে রেস্টুরেন্টের লোগো বা খাবারের মেনুতে এই রঙের ব্যবহার অনেক বেশি দেখা যায়।
কমলা: কমলা অনেকটা হলুদের মতো, মানুষের কাছ থেকে সুখী আবেগ প্রকাশ করতে ব্যবহার করা হয়। আবহাওয়াজনিত রোগ সিজনাল অ্যাফেক্টিভ ডিজঅর্ডারের রোগীদের সূর্যালোকের অভাব এবং বাড়ির ভেতরে বেশি সময় কাটাতে হয় বলে হলুদ ও কমলার মতো উষ্ণ রং বাসায় ব্যবহার করতে বলা হয়।
বেগুনি: কল্পনাপ্রবণতাকে জাগাতে বেগুনি রং ব্যবহার হয়; তাই বিভিন্ন সেমিনারে এই রঙের স্লাইড উপস্থাপন করে ব্রেন স্টর্মিং করতে বলা হয়।
কালো: কালো হলো সাহস, শক্তি ও রহস্যের প্রতীক। কালো ও লালের সংমিশ্রণের পোশাকে আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায় বলে মনে করা হয়।
সাদা: সাদা হলো ইতিবাচক রং, যা শান্তি ও প্রশান্তি খুঁজে পেতে সাহায্য করে; পাশাপাশি হাসপাতাল এবং হাসপাতালের কর্মীরা ইতিবাচক অনুভূতি তৈরি করতে সাদা ব্যবহার করে থাকে বলে মনে করা হয়।
গোলাপি: গোলাপি হলো শান্ত ও চিন্তার স্বচ্ছতা। অনিদ্রা ও অতিরিক্ত সংবেদনশীলতার জন্য ব্যবহার করা হয়। একটি গবেষণায় দেখা যায়, আগ্রাসন কমাতে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাফিক পুলিশ অফিসারদের কক্ষগুলোয় গোলাপি রঙের ব্যবহার ইতিবাচক ফল নিয়ে আসে।
২০১৫ সালের একটি গবেষণায় দেখা যায়, ক্রোমোথেরাপি ক্যানসার, উচ্চ রক্তচাপ, ত্বকের সংক্রমণ ও বিষণ্নতার মতো রোগে নিরাময়ে ইতিবাচক ফল দিয়েছে। ২০১৯ সালে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উদ্বেগের বিকল্প চিকিৎসা হিসেবে কালারথেরাপি শিক্ষার্থীদের উদ্বেগকে শিথিল করতে ও কমাতে সক্ষম হয়েছে। তাই কোন রঙের প্রভাব নিজেকে কেমন করে পরিবর্তন করে, তা জানা একান্ত আবশ্যক। এ ছাড়া নিজের জীবনে এর প্রয়োগে প্রয়োজনে পরামর্শও নেওয়া যেতে পারে।