মেনস্ট্রুয়াল কাপ হলো একধরনের পুনর্ব্যবহারযোগ্য স্থিতিস্থাপক ফানেল আকৃতির কাপ, যা পিরিয়ডের সময় ব্যবহার করা হয়। এটি রবার বা সিলিকন দিয়ে তৈরি হয়, যা পিরিয়ডের রক্তের ধারা ধরে রাখতে যোনিপথে ব্যবহার করা হয়। মাসিক কাপ অন্যান্য পদ্ধতির তুলনায় বেশি রক্ত ধারণ করতে পারে, যা স্যানিটারি ন্যাপকিন বা ট্যাম্পনের পরিবেশবান্ধব বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যায়। রক্তপ্রবাহের ওপর ভিত্তি করে একটি কাপ ৮-১২ ঘণ্টা পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়।
মেনস্ট্রুয়াল কাপ ব্যবহার করার প্রাক্কালে যেকোনো জিজ্ঞাসা বা দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকলে একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে নেওয়া যায়। অনলাইনে বা বিশেষায়িত দোকানে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের কাপ আজকাল কিনতে পাওয়া যায়। তবে সবার আগে নিজের উপযোগী কাপের সাইজটি জেনে নেওয়া দরকার। ছোট মাসিক কাপ সাধারণত ৩০ বছরের কম বয়সী নারীদের জন্য উপযুক্ত। ৩০ বছরের বেশি বয়সী, যাঁরা সন্তান প্রসব করেছেন বা যাঁদের বেশি রক্তপ্রবাহ হয়, তাঁদের জন্য বড় আকারের মাসিক কাপ পাওয়া যায়। যেসব মাসিক কাপ বাণিজ্যিকভাবে কিনতে পাওয়া যায়, তার মধ্যে আছে কিপার কাপ, মুন কাপ, লুনেট মেনস্ট্রুয়াল কাপ, ডিভা কাপ, লেনা কাপ ও লিলি কাপ। এ ছাড়া বাজারে কিছু সেমিডিসপোজেবল কাপও রয়েছে।
প্রথম প্রথম মেনস্ট্রুয়াল কাপ ব্যবহারে অস্বস্তি বোধ হলেও সময়ের সঙ্গে তা ধীরে ধীরে সহজ মনে হবে। মাসিক কাপ ব্যবহারের একটি সাধারণ গাইডলাইন দেওয়া হলো এখানে:
১. প্রথমে হাত ভালোভাবে ধুয়ে নিতে হবে।
২. কাপের রিমে পানি বা জলীয় লুব্রিক্যান্ট লাগাতে হবে।
৩. মাসিক কাপটি মাঝখান থেকে শক্তভাবে অর্ধেক করে ভাঁজ করে ধরতে হবে। রিমটি ওপরের দিকে রেখে এক হাতে ধরার নিয়ম।
৪. কাপটি যোনিপথে এমনভাবে প্রবেশ করাতে হবে, যেন এটি জরায়ুর একটু ভেতরে কয়েক ইঞ্চি দূরে সেট হতে পারে।
৫. কাপটি যোনিতে রেখে বৃত্তাকারে সেট করতে হবে। তবে যেকোনো সমস্যা হলে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে হবে।
৮ থেকে ১২ ঘণ্টা একাধারে মাসিক কাপ পরে থাকা যায়। খুব বেশি প্রবাহের কারণে যদি ১২ ঘণ্টার আগেই কাপটি পূর্ণ হয়ে যায়, তাহলে সময়ের আগেই তা বের করে খালি করে নিতে হবে।
পুনর্ব্যবহারযোগ্য মাসিক কাপ যোনিতে পুনরায় প্রবেশ করানোর আগে ধুয়ে পরিষ্কার করে নিতে হবে। কাপ দিনে অন্তত দুইবার খালি করা উচিত। পুনর্ব্যবহারযোগ্য কাপ বেশ টেকসই এবং সঠিক যত্নে ছয় মাস থেকে বেশ কয়েক বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
১. সাশ্রয়ী মূল্যের, একটি কাপ বহুদিন চলে যায়।
২. স্যানিটারি ন্যাপকিন বা ট্যাম্পনের চেয়ে নিরাপদ। কারণ, এতে কোনো রাসায়নিক পদার্থ নেই।
৩. ন্যাপকিন বা ট্যাম্পনের চেয়ে বেশি রক্ত ধারণ করে।
৪. ন্যাপকিন বা ট্যাম্পনের চেয়ে পরিবেশের জন্য ভালো।
কথা হচ্ছিল বাংলাদেশে যাঁরা মেনস্ট্রুয়াল কাপ ব্যবহার করছেন, এমন কয়েকজনের সঙ্গে। সায়কা শাহরিন একজন সফল উদ্যোক্তা। তাঁর অনলাইনভিত্তিক ফ্যাশন হাউস আছে। লম্বা সময় ধরে বাইরে থাকা তাঁর কাজেরই অংশ। তাঁর মতে, পিরিয়ডের সময় বারবার ন্যাপকিন বদলানোর ঝক্কি আর একগাদা খরচ থেকে মুক্তি দিতে মেনস্ট্রুয়াল কাপ অনন্য। এককথায় বাজেটবান্ধব। মাসিক কাপ রক্ত শোষণ করার পরিবর্তে ধরে রাখে, তাই টক্সিক শক সিন্ড্রোম হওয়ার ঝুঁকি নেই। এই কাপে বেশি রক্ত ধারণক্ষমতা থাকে। একটি কাপ এক থেকে দুই আউন্স মাসিক প্রবাহ ধারণ করতে পারে।
অন্যদিকে ট্যাম্পন বা স্যানিটারি ন্যাপকিন এক আউন্সের বড়জোর অর্ধেক রক্ত ধরে রাখতে পারে। এ ছাড়া পুনর্ব্যবহারযোগ্য মাসিক কাপ পরিবেশবান্ধব। ব্যাপারটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন মেনস্ট্রুয়াল কাপের পারফরম্যান্সে মুগ্ধ ব্যবহারকারী সুস্মিতা হোসাইন খান। এই পুষ্টিবিদ একটি আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আছেন গবেষণার কাজে। তিনি আমেরিকা থেকে ৩০টি মাসিক কাপ নিয়ে এসেছেন এবং এই কাপ উপহার দিয়ে তাঁর ভাষায় ‘কাপের পথে’ এনেছেন। এ কথা অনস্বীকার্য যে এখনো আমাদের দেশে অনেক মেয়েই মাসিক কাপের ব্যবহারবিধি সম্পর্কে জানেন না। অনেকেই ভয় পান। আরেকজন মাসিক কাপ ব্যবহারকারী তিথি দেবের সঙ্গে কথা বললে তিনিও জানান তাঁর অভিজ্ঞতার কথা। তিনি বলেন, এটা এমন একটি উদ্ভাবন, যা মেয়েদের পিরিয়ডের ব্যাপারে ধ্যানধারণা—একে ঝামেলা হিসেবে দেখার প্রবণতাকে আমূল পাল্টে দিচ্ছে। একবার যিনি মাসিক কাপ ব্যবহার করেছেন, পিরিয়ডজনিত আশি ভাগ সমস্যা থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি আর কোনো সনাতন ব্যবস্থার দিকে ফিরে যাচ্ছেন না।
দেশে মেয়েদের প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন মেরী স্টোপস বাংলাদেশের এক্সটার্নাল রিলেশন্স ও নতুন ব্যবসায় উদ্যোগ গঠন বিভাগের পরিচালক ডা. ফারহানা আহমেদ। তিনি বলেন, সবদিক দিয়েই পিরিয়ডের সময়ে প্রয়োজনীয় সামগ্রীগুলোর মধ্যে মাসিক কাপই সেরা। এর কোনো ক্ষতিকর প্রভাব তো নেই-ই, বরং আছে নানামুখী উপকারিতা। নিজের বোন, আত্মীয়, বন্ধু ও সহকর্মীদের অনেকেই তাঁর পরামর্শক্রমে মাসিক কাপ ব্যবহার করছেন। তিনি এ-ও বলেন, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে গার্মেন্টস খাতে লম্বা শিফটে কর্মরত নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্যের জন্য মাসিক কাপের প্রচলন খুবই জরুরি। এ ব্যাপারে পাইলট প্রজেক্ট নিয়ে ব্যাপকভাবে বাস্তবায়নের এখনই সময়।
যেকোনো চ্যাম্পিয়নশিপে কাপ দেওয়ার প্রচলন আছে বিশ্বজুড়েই। নারী আজ সর্বক্ষেত্রে অগ্রবর্তী। অনেক ক্ষেত্রে পথিকৃৎও বটে। তাই পিরিয়ডের সঙ্গে সম্পর্কিত সব বাধা দূর করতে, নারীকে মুক্তির পথে নিয়ে আসতে এই মাসিক কাপই প্রতীকী চ্যাম্পিয়নশিপ কাপস্বরূপ।
ছবি: পেকজেলসডটকম