ইদানীং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে করসল ফল নিয়ে কথা হচ্ছে। অনেকে বলছেন যে এই ফল নাকি ক্যানসার নির্মূল করে। এমন দাবির কারণ মূলত, করসল ফলের পাউডার আর ক্যাপসুল বিক্রি হচ্ছে দেদার; বুঝে হোক আর না বুঝে হোক, মানুষ এসব কিনে খাচ্ছে। ফলের কী গুণ, তা নিয়ে মানুষের আগ্রহ কম; বরং নতুন কিছু শুনলেই সেদিকে ঝুঁকে পড়ে। এর ভালো–মন্দ বুঝতে হলে দীর্ঘদিন খেতে হবে।
করসলের বিভিন্ন অংশে (পাতা, ফল, বীজ) পাওয়া যায় অ্যাসিটোজেনিনস নামক প্রাকৃতিক যৌগ, যা ক্যানসার কোষের বৃদ্ধি দমন করতে পারে। এমন দাবি করা হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে সেই সাথে যেগুলোতে কিছু পরীক্ষা করা হয়েছে যা করসলের বিভিন্ন অংশে (পাতা, ফল, বীজ) পাওয়া যায় অ্যাসিটোজেনিনস নামক প্রাকৃতিক যৌগ, যা ক্যানসার কোষের বৃদ্ধি দমন করতে পারে।
করসলের মধ্যে চারান্তিন (charantin), ভিসিন (vicine) ও পলিপেপটাইড-পি নামক ইনসুলিনসদৃশ যৌগ থাকে। এগুলো শরীরের গ্লুকোজ গ্রহণ বাড়িয়ে রক্তে চিনির মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। তাই এটি টাইপ-২ ডায়াবেটিক রোগীর জন্য অত্যন্ত উপকারী। করসল পাচনতন্ত্রের এনজাইমগুলোর কার্যকারিতা বাড়িয়ে হজমে সাহায্য করে। এটি গ্যাস, অম্বল, বদহজম ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে লিভারের কার্যক্ষমতা বাড়ায় এবং শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ দূর করে। নিয়মিত খেলে জন্ডিস বা ফ্যাটি লিভারের সমস্যাও কমতে পারে। করসল রক্ত পরিষ্কার করে এবং ব্রণ, ফুসকুড়ি, একজিমা, সোরিয়াসিস ইত্যাদি কমায়। অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকার কারণে বয়সের ছাপও কিছুটা প্রতিরোধ করে।
কিন্তু আমরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রচারণা থেকে জানছি যে করসল ক্যানসার নির্মূল করে! এসব কথা বিশ্বাস না করে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখা ও ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। কারণ, যেকোনো খাবার গুণাগুণ জেনে খেলে সঠিক কার্যকারিতা মেলে।
প্রোস্টেট ক্যানসার কোষের (PC-3) বৃদ্ধির বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিরোধ দেখিয়েছে।
Bcl-2 পরিবারের অ্যান্টি-অ্যাপোপটোটিক প্রোটিনগুলোর কার্যকারিতা বাধাগ্রস্ত করে, যা ক্যানসার কোষের মৃত্যু ঘটাতে সহায়ক।
করসল ফলের নির্যাস স্তন ক্যানসার কোষের (MDA-MB-231) বৃদ্ধি থামিয়ে কোষচক্রের G2/M ও S পর্যায়ে আটকাতে পারে এবং অ্যাপোপটোসিস (কোষ মৃত্যু) ঘটাতে সক্ষম।
করসলের পাতার নির্যাস ডিম্বাশয়ের ক্যানসার কোষে (PA-1) ইপিডার্মাল গ্রোথ ফ্যাক্টর (EGF) সিগন্যালিং পথকে বাধাগ্রস্ত করে কোষের বেঁচে থাকার ক্ষমতা হ্রাস করে।
করসলের অ্যাসিটোজেনিনস HIF-1α নামক প্রোটিনের কার্যকারিতা বাধাগ্রস্ত করতে পারে, যা টিউমার কোষের অক্সিজেন-ঘাটতি পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকার ক্ষমতা কমায়।
করসল পাতার নির্যাস স্তন ক্যানসার কোষের (4T1) বৃদ্ধি দমন করেছে এবং মাউস মডেলে টিউমার গঠনে বাধা সৃষ্টি করেছে।
করসলের নির্যাস ত্বকের টিউমার গঠনে বাধা সৃষ্টি করেছে এবং টিউমারের আকার ও সংখ্যা কমিয়েছে।
এই তথ্যগুলোকে কেন্দ্র আমরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রচারণা থেকে জানছি এটা ক্যানসার নির্মূল করে! সবকিছু বিশ্বাস না করে বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষিত গুণ জেনে খেলেই কার্যকারিতা মিলবে। করসল নিয়ে আজ কিছু জানাব।
• ল্যাবরেটরিতে (টেস্টটিউব বা প্রাণীর দেহে) করসলের কিছু যৌগ (যেমন অ্যাসিটোজেনিন) ক্যানসার কোষের বৃদ্ধি কমাতে করতে পারে বলে দেখা গেছে। এই যৌগগুলো ক্যানসার কোষের শক্তি উৎপাদনব্যবস্থা (মাইটোকন্ড্রিয়া) বাধাগ্রস্ত করতে পারে বলে ধারণা করা হয়। তবে এই গবেষণাগুলো প্রাণী বা কোষ পর্যায়ে সীমিত, এবং মানবদেহে এর কার্যকারিতা বা নিরাপদ মাত্রার বিষয়ে কোনো প্রমাণ নেই।
• ল্যাবে ক্যানসার কোষ ধ্বংস করা আর বাস্তবে ফল খেয়ে ক্যানসার সারানো সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রাকৃতিক ফল থেকে প্রাপ্ত যৌগের মাত্রা ক্যানসার চিকিৎসার জন্য অপ্রতুল এবং সেগুলো পরিপাকতন্ত্রে শোষিত হয় কি না, তা অনিশ্চিত। কোনো ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল (মানবদেহে পরীক্ষা) এখনো প্রমাণ করেনি যে করসলে ক্যানসার সারে।
• করসল বীজ ও পাতায় অ্যানোনাসিন নামক একটি নিউরোটক্সিক যৌগ থাকে, যা অত্যধিক পরিমাণে খেলে পার্কিনসন্স–জাতীয় স্নায়বিক সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। ফলটি অ্যান্টিক্যানসার ওষুধের সঙ্গে প্রতিক্রিয়া করতে পারে বা কেমোথেরাপির কার্যকারিতা কমাতে পারে।
• আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটির মতে, করসলকে ক্যানসারের চিকিৎসা হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা দেওয়ার মতো যথেষ্ট প্রমাণ নেই। ক্যানসার একটি জটিল রোগ এবং এর চিকিৎসায় প্রমাণভিত্তিক–পদ্ধতি (কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি, ইমিউনোথেরাপি) অনুসরণ করা জরুরি।
• ক্যানসার রোগীদের উচিত কোনো প্রাকৃতিক পদ্ধতি ব্যবহারের আগে অনকোলজিস্ট (ক্যানসারবিশেষজ্ঞ) এর সঙ্গে পরামর্শ করা। করসল বা কোনো সম্পূরককে চিকিৎসার বিকল্প হিসেবে দেখা উচিত নয়।
• ল্যাব গবেষণায় করসল সম্ভাবনা থাকলেও বাস্তবে এটি ক্যানসার নিরাময় করে না। বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত ‘চিকিৎসার পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপন গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু কোনো ফল “অলৌকিক নিরাময়” এর দাবি ভিত্তিহীন।’
• করসল বীজ ও পাতায় অ্যানোনাসিন নামক একটি নিউরোটক্সিক যৌগ থাকে, যা অত্যধিক পরিমাণে খেলে পার্কিনসন্স জাতীয় স্নায়বিক সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। ফলটি অ্যান্টিক্যানসার ওষুধের সঙ্গে প্রতিক্রিয়া করতে পারে বা কেমোথেরাপির কার্যকারিতা কমাতে পারে।
• আমেরিকান ক্যানসার সোসাইটির মতে, করসলকে ক্যানসারের চিকিৎসা হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা দেওয়ার মতো যথেষ্ট প্রমাণ নেই। ক্যানসার একটি জটিল রোগ এবং এর চিকিৎসায় প্রমাণভিত্তিক পদ্ধতি (কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি, ইমিউনোথেরাপি) অনুসরণ করা জরুরি।
• ক্যানসার রোগীদের উচিত কোনো প্রাকৃতিক পদ্ধতি ব্যবহারের আগে অনকোলজিস্টের (ক্যানসার বিশেষজ্ঞ) সঙ্গে পরামর্শ করা। করসল বা কোনো সম্পূরককে চিকিৎসার বিকল্প হিসেবে দেখা উচিত নয়।
• ল্যাব গবেষণায় করসল সম্ভাবনা থাকলেও বাস্তবে এটি ক্যানসার নিরাময় করে না। বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত চিকিৎসার পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপন গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু কোনো ফলে সেবনে অলৌকিকভাবে নিরাময়ের দাবি ভিত্তিহীন।
করসলের ঔষধি গুণের কারণে আপনি কিছু উপকার পাবেন, তার মধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের সুগার লেভেল কমানোর জন্য একটি উত্তম পথ্য।
• করসলে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট থাকে। যেমন ভিটামিন সি, ফ্ল্যাভোনয়েডস এবং অন্যান্য ফেনোলিক যৌগ। অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট আমাদের শরীরের কোষকে ফ্রি র্যাডিক্যাল নামক ক্ষতিকর অণু থেকে রক্ষা করে।
• করসলে প্রদাহবিরোধী যৌগ রয়েছে। শরীরের দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ বিভিন্ন রোগের সাথে জড়িত। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে করসল ফলের নির্যাস প্রদাহ সৃষ্টিকারী সাইটোকিনের উৎপাদন কমাতে পারে, যা আর্থ্রাইটিস এবং অন্যান্য প্রদাহজনিত রোগের উপশমে সাহায্য করতে পারে।
• করসলে পটাশিয়াম আছে। পটাশিয়াম শরীরে সোডিয়ামের ভারসাম্য বজায় রাখতে এবং রক্তনালিকে প্রসারিত করতে সাহায্য করে, যার ফলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে।
এটি মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে যদিও করসলের অনেক সম্ভাব্য স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে, তবুও এটি কোনো রোগের চিকিৎসা বা সম্পূর্ণ নিরাময়ের বিকল্প নয়।
• স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি: করসলের একটি যৌগ অ্যানোনাসিন স্নায়ুতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, যা পার্কিনসন রোগের মতো উপসর্গ সৃষ্টি করতে পারে।
• অনুমোদনের অভাব: করসলকে ক্যানসার চিকিৎসার জন্য কোনো আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদন দেয়নি, এবং মানবদেহে এর কার্যকারিতা সম্পর্কে পর্যাপ্ত বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই।
করসল ফলের নির্যাস ল্যাবরেটরি ও প্রাণীতে ক্যানসার কোষের বিরুদ্ধে কিছু প্রতিশ্রুতিশীল ফলাফল দেখিয়েছে, তবে মানবদেহে এর কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা সম্পর্কে পর্যাপ্ত বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। অতএব, করসলকে ক্যানসার নিরাময়ের প্রাকৃতিক প্রতিকার হিসেবে বিবেচনা করা বৈজ্ঞানিকভাবে সমর্থিত নয়। করসলের গুঁড়া ও ক্যাপসুল খাওয়ার ক্ষেত্রে সর্তক থাকবেন।
এটি মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে যদিও করসল ফলের অনেক সম্ভাব্য স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে, তবুও এটি কোনো রোগের চিকিৎসা বা সম্পূর্ণ নিরাময়ের বিকল্প নয়।
লেখক: খাদ্য ও পথ্যবিশেষজ্ঞ; প্রধান নির্বাহী, প্রাকৃতিক নিরাময় কেন্দ্র।
ছবি: উইকিপিডিয়া