১২ মে ২০২৪ সালের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে। গড় পাসের হার ৮৩.০৪। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ সব গণমাধ্যমে ফলাফল প্রকাশের পর থেকে অসংখ্য খবর এবং পরীক্ষার্থীদের হাসিমাখা ছবি প্রকাশিত হচ্ছে। একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আশঙ্কাজনকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে আরও একটি খবর। আশানুরূপ ফল না করায় পরীক্ষার্থীদের অত্মহত্যা। নিবন্ধটি লেখার সময় পর্যন্ত সারা দেশে আট পরীক্ষার্থীর আত্মহত্যার খবর পাওয়া গেছে, যা উদ্বেগজনক এবং একই সঙ্গে ভয়ের কারণ। ভয় শব্দটি এখানে উল্লেখ করার কারণ এই যে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা নিজেদের যাচাই করছে পরীক্ষায় প্রাপ্ত গ্রেড বা নম্বরের আলোকে।
বেঁচে থাকার সব তাগিদ যে মুহূর্তে ফুরিয়ে যায়, সে মুহূর্তে আত্মহননের পথ বেছে নেয় মানুষ। ইতিপূর্বে ঘটে থাকা তিক্ত অভিজ্ঞতা এবং আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি এর অন্যতম প্রধান কারণ। একজন কোমলমতি শিক্ষার্থী যখন পড়ালেখার সুদীর্ঘ পথ পেরিয়ে একটি বোর্ড পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেয়, একই সঙ্গে সেই শিক্ষার্থীর পরিবার-পরিজন এ প্রস্তুতির বড় অংশীদার হয়ে যায়। পরীক্ষায় মানসম্মত ফল লাভের জন্য অধিকাংশ শিক্ষার্থীর ওপর প্রত্যাশার চাপ থাকে। সব মা-বাবা তাঁর সন্তানের সফলতা চাইবেন, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু লক্ষণীয়ভাবে সেই চাওয়া শিক্ষার্থীর দুশিন্তা আর হতাশার কারণ হয়ে যায়। প্রত্যাশিত ফল করার অপারগতা একজন শিক্ষার্থীকে পরিবারের কাছে তথা সমাজের কাছে মূল্যহীন করে তোলে।
‘প্রত্যেক মা–বাবা চাইবেন তাঁর সন্তানের সফলতা, কিন্তু জীবনের একটিমাত্র পরীক্ষার ফলাফল সেই সফলতার মানদণ্ড কোনোভাবেই হতে পারে না। একটি পরীক্ষায় আশানুরূপ ফল না পেলেও জীবনের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে মানসিক প্রস্তুতি নেওয়ার এখনই আসল সময়।’ বলছেন সোনার তরী কিশোর–কিশোরী সংঘ নামের সেবামূলক ও কমিউনিটিভিত্তিক সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা মনোবিজ্ঞানী ফারজানা ফাতেমা রুমী। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে শিক্ষার্থীর পরিবার, মূলত মা-বাবা। এ ব্যাপারে আমাদের এখনই যে জরুরি পদক্ষেপগুলো নিতে হবে, চলুন সেগুলো দেখে নিই।
মা–বাবার কষ্টার্জিত অর্থ ও শ্রমের সাহায্যে সন্তানেরা ধীরে ধীরে বড় হয়। একটি শিশুকে পৃথিবীতে আনলে তার মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করেই আনতে হবে। মা–বাবা হিসেবে এটা আমাদের দায়িত্ব। এর বিপরীতে সন্তানের ওপর দীর্ঘ প্রত্যাশার চাপ কোনো ক্রমেই রাখা যাবে না। এমনকি আকার–ইঙ্গিতেও তাকে এ বিষয়গুলো নিয়ে কোনো নেতিবাচক বার্তা দেওয়া যাবে না।
আমাদের সমাজে থাকা কিছু অবিবেচক মানুষের কথায় প্রভাবিত না হয়ে বরং সন্তানকে সেসব মানুষের প্রভাবমুক্ত রাখার পরামর্শ দিচ্ছেন মনোবিজ্ঞানী ফারজানা ফাতেমা রুমী। তিনি আরও বলেন, কার কথাকে প্রাধান্য দেওয়া দরকার, সে বিষয়ে সন্তানদের ছোটবেলা থেকেই স্পষ্ট ধারণা দেওয়া হলে সন্তান আত্মবিশ্বাসী হয়ে বেড়ে উঠবে।
সফলতা ও বিফলতা সমান্তরালে চলবে। কিন্তু সাময়িক ব্যর্থতার ফলে মুখ থুবড়ে পড়ার কোনো অবকাশ নেই। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান। সফলতা যেমন উদ্যাপন করা হয়, ঠিক তেমনিভাবে ব্যর্থতাকে সামনের পথ পাড়ি দেওয়ার জন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে মেনে নিতে হয়, যা মানুষকে একদিন সফল হতে সাহায্য করে।
মা–বাবার পরই আসে শিক্ষকের ভূমিকা। পাঠদানের পাশাপাশি বিদ্যালয় আমাদের জীবনবোধ শিক্ষা দেবে। স্পোর্টস ডের সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান শিক্ষক যেভাবে হার–জিত নিয়ে কথা বলেন, ঠিক সেভাবেই শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। অনুপ্রেরণা দেয়, এমন পাঠদান পদ্ধতি শিক্ষার্থীর জীবনপথের পাথেয় হয়ে থাকবে। সেখান থেকে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা জানতে পারবে, একটি ব্যর্থতাই জীবনের সব আলো নিভে যাওয়ার কারণ হতে পারে না।
বর্তমান যুগে পড়ালেখার পাশাপাশি একাধিক দক্ষতার দরকার হয়, যা একজন শিক্ষার্থীর সফলতায় সহায়ক। দলবদ্ধভাবে কাজ করা, সময়ের সুব্যবস্থাপনাসহ যেকোনো সফট স্কিলকে প্রাধান্য দিয়ে একজন পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠতে বিকল্প দক্ষতার গুরুত্বের কথা আরও বেশি বেশি বলতে হবে।
ছবি: আশরাফুল আলম