শুধু শিশু বা বয়স্করা নয়, সব বয়সীদের জন্যই দুধকে আদর্শ খাদ্য বলা হয়। এই জাদুকরি পানীয় দুধে একাধারে শর্করা (ল্যাকটোজ), আমিষ, ফ্যাট—সব কটি ভিটামিন ও মিনারেল আছে। কাঁচা দুধে ভিটামিন সি থাকলেও ফুটালে বা পাস্তুরিত করলে দুধের ভিটামিন সি আর পাওয়া যায় না। ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, পটাশিয়াম, জিংক, ভিটামিন এ এবং ভিটামিন ডি-এর সবচেয়ে ভালো উৎসগুলোর একটি এই দুধ।
এখন প্রায়ই দেখা যায়, কিশোর-কিশোরী ও তরুণ বয়সীরা নিয়মিত দুধ পান করে না। দুধ যেন শুধুই শিশুদের জন্য বা রোগীর পথ্য। জেনে রাখা ভালো, মানুষের শরীরে হাড়ে ক্যালসিয়াম জমা হয় ৩৫ বছর বয়স পর্যন্ত। এরপর আর ক্যালসিয়াম জমা হয় না, বরং ক্ষয় হতে থাকে বিভিন্ন মাত্রায়। তাই জন্ম থেকে ৩৫ বছর পর্যন্ত প্রতিদিন ১-২ গ্লাস দুধ খেলে পরবর্তী সময়ে হাড়ের বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ করে দীর্ঘদিন পর্যন্ত কর্মক্ষম থাকা সম্ভব।
অন্যদিকে গর্ভের সন্তানের হাড়ের গঠন আর পরবর্তী জীবনে তার সঠিক উচ্চতা ও সুগঠিত দেহ নিশ্চিত করতে হবু মাকে প্রতিদিন দুধ খেতে হবে। সন্তান জন্ম দেওয়ার পর বুকের দুধের পরিমাণ বাড়াতেও দুধ পান করা খুব কার্যকর। মা দুধ না খেলে শিশু পর্যাপ্ত পরিমাণে বুকের দুধ পাবে না, পুষ্টিহীনতায় ভুগবে।
মানুষের জীবনের প্রথম খাবারই হলো দুধ। শিশুর জন্য মায়ের দুধের কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির ৯৫ শতাংশ তৈরি হয়ে যায় তার জন্মের প্রথম পাঁচ বছরের মধ্যে। আর মস্তিষ্কের কোষের বৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য দুধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা খাবার। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দুধের বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান শরীরে ভিন্ন ভিন্ন কাজের জন্য প্রয়োজন হয়।
আমিষ
১৮ বছর বয়স পর্যন্ত শরীরের উচ্চতাসহ অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বৃদ্ধি ও সঠিকভাবে কাজ করতে সবচেয়ে বেশি দরকার প্রোটিন, যা দুধে মিলবে প্রচুর পরিমাণে। দুধে দুই ধরনের প্রোটিন থাকে—
অদ্রবণীয় প্রোটিন: ‘কেসিন’ (দুধের ৮০%) আর দ্রবণীয় প্রোটিন ‘ওয়ে’ (দুধের ২০%)। দুধে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় সব কটি অ্যামিনো নিউট্রিয়েন্ট, যা দিয়ে আমিষ গঠিত হয়, সেগুলো সঠিক আনুপাতিক হারে থাকে। তাই দুধের আমিষ একাধারে শরীরের মাংসপেশি আর মস্তিষ্ক গঠন করতে খুবই কার্যকর। আবার শরীরে সব এনজাইম, হরমোন ও অ্যান্টিবডি তৈরির জন্য প্রয়োজন হয় এই মিল্ক প্রোটিন।
বিভিন্ন ধরনের দুধে বিভিন্ন মাত্রায় ফ্যাট থাকে। যেমন পূর্ণ ননিযুক্ত, কম ননিযুক্ত, ননিমুক্ত ইত্যাদি। তবে দুধের এই চর্বি বা ফ্যাট শরীরে বাড়তি শক্তি দেয়, এ জন্য ছাত্রছাত্রী, যারা খেলাধুলা করে, যাদের শারীরিক পরিশ্রম বেশি হয়, তাদের জন্য পূর্ণ ননিযুক্ত দুধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি খাবার। তবে যাদের ওজন বেশি, হার্টের সমস্যা রয়েছে বা রক্তে কোলেস্টেরল বাড়তি, তারা ননিছাড়া দুধ পান করলে ভালো।
দুধের শর্করা হলো ল্যাকটোজ, যা শরীরে শক্তি দেয়। তবে যাদের ল্যাকটোজ ইনটলারেন্সের সমস্যা থাকে, তাদের জন্য ল্যাকটোজমুক্ত দুধ, দই, ছানা খাওয়া ভালো। তবে কখনো ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স হয় অনেকটা নিজেদের তৈরি করা। যেমন দীর্ঘদিন দুধ না খেতে থাকলে শরীরে ল্যাকটোজ নামের এনজাইমের কাজ কমে গিয়ে এই অবস্থা হয়ে থাকে। এ অবস্থা থেকে ফিরে আসতে হলে ধীরে ধীরে প্রথমে দুধের তৈরি খাবার (যেমন পায়েস, ফিরনি, পুডিং, চিজ, মাখন, দই ইত্যাদি) অল্প অল্প করে খাওয়া শুরু করে পরবর্তী সময়ে সরাসরি দুধ পান করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
একমাত্র ভিটামিন সি ছাড়া সব কটি ভিটামিনই দুধে আছে। বিশেষ করে ভিটামিন এ, বি কমপ্লেক্স, ফলিক অ্যাসিড এতে রয়েছে পর্যাপ্ত। আবার সব কটি মিনারেল বা খনিজ পদার্থ, বিশেষ করে ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ফসফরাস ও ম্যাগনেশিয়াম যথেষ্ট পরিমাণে থাকে দুধে।
দুধের ক্যালসিয়াম আমাদের মজবুত হাড়, নখ ও দাঁতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। হাড়ের বিভিন্ন ক্ষয়রোগ (যেমন অস্টিওপরোসিস) প্রতিরোধ করতে পারে দুধ। শরীরের রক্তের হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ঠিক রেখে শরীরে অক্সিজেনের অফুরান জোগান নিশ্চিত করে আয়রন। এটিও দুধে পাওয়া যায় যথেষ্ট।
লেখক: প্রধান পুষ্টিবিদ ও বিভাগীয় প্রধান, পুষ্টি বিভাগ, বারডেম হাসপাতাল।