হজম ভালো হলে ওজন বাড়ে নাকি কমে
শেয়ার করুন
ফলো করুন

আমাদের অনেকের ধারণা আছে যে, খাবার ঠিক মত হজম হলে ওজন বাড়ে; কিন্তু বাস্তব দিক হলো এর উল্টো। হজম সমস্যার সঙ্গে ওজন বাড়ার সম্পর্ক আছে এবং এর পেছনে বৈজ্ঞানিক কারণগুলো শরীরের বিপাক প্রক্রিয়া, হরমোন এবং জীবনযাত্রার ওপর নির্ভর করে। হজম সমস্যা ওজন বাড়ার ক্ষেত্রে পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখে, বিশেষ করে বিপাক হার কমিয়ে, হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে এবং অন্ত্রের স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলে। তবে ওজন বৃদ্ধি শুধু হজম সমস্যার কারণে নয়; বরং খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক কার্যকলাপ এবং সামগ্রিক জীবনযাত্রার সমন্বয়ে ঘটে। পরিমিত খাদ্যাভ্যাস ও সুস্থ জীবনযাত্রা হজম সমস্যা এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে।

খাদ্যাভ্যাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
খাদ্যাভ্যাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ

যে কারণে ওজন বাড়তে পারে

বিপাক হারে প্রভাব: হজম সমস্যা, যেমন কোষ্ঠকাঠিন্য বা ধীর হজমপ্রক্রিয়া, শরীরের বিপাক হার বা মেটাবলিক রেট কমিয়ে দিতে পারে। যখন হজমপ্রক্রিয়া মন্থর হয়, তখন শরীর দক্ষতার সঙ্গে ক্যালরি ব্যবহার করতে পারে না; ফলে অতিরিক্ত ক্যালরি চর্বি হিসেবে জমা হয়। দীর্ঘস্থায়ী কোষ্ঠকাঠিন্যের কারণে শরীরে টক্সিন জমা হতে পারে, যা বিপাকীয় প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে এবং ওজন বাড়তে পারে।

বিজ্ঞাপন

ইনসুলিন প্রতিরোধ: হজম সমস্যা, বিশেষ করে অন্ত্রের স্বাস্থ্যের অবনতি (যেমন, গাঁট মাইক্রোবায়োমের ভারসাম্যহীনতা), ইনসুলিন প্রতিরোধের কারণ হতে পারে। ইনসুলিন প্রতিরোধ হলে শরীরে গ্লুকোজ সঠিকভাবে ব্যবহৃত হয় না, যা চর্বি সঞ্চয় বাড়ায়। দুর্বল হজমের কারণে রক্তে শর্করার মাত্রার অস্থিরতা ইনসুলিনের নিঃসরণ বাড়ায়, যা চর্বি জমার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে।
গাট মাইক্রোবায়োমের ভূমিকা: অন্ত্রে উপস্থিত উপকারী ব্যাকটেরিয়া খাবার হজম ও পুষ্টি শোষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। হজম সমস্যা, যেমন ডিসবায়োসিস (অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়ার ভারসাম্যহীনতা), ক্যালরি শোষণের হার বাড়িয়ে দিতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, কিছু ধরনের অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া বেশি ক্যালরি শোষণ করে, যা ওজন বৃদ্ধির কারণ হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ ফার্মিকিউটস ব্যাকটেরিয়ার প্রাধান্য বেশি হলে চর্বি সঞ্চয় বাড়ে।

বিজ্ঞাপন

হরমোনের ভারসাম্যহীনতা: হজম সমস্যা, বিশেষ করে দীর্ঘস্থায়ী কোষ্ঠকাঠিন্য বা গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সমস্যা, হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে। যেমন:
• কর্টিসল: দীর্ঘস্থায়ী হজম সমস্যা স্ট্রেস বাড়ায়, যা কর্টিসল হরমোনের নিঃসরণ বাড়ায়। উচ্চ কর্টিসল পেটের চর্বি জমার কারণ হতে পারে।
• লেপটিন ও গ্রেলিন: এই হরমোনগুলো ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণ করে। হজম সমস্যা এই হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করলে ক্ষুধা বাড়তে পারে, ফলে বেশি খাওয়া এবং ওজন বৃদ্ধি ঘটে।
পানিশূন্যতা ও ফোলাভাব: হজম সমস্যার কারণে শরীরে পানি ধরে রাখা বা ফোলাভাব হতে পারে, যা ওজন বাড়ার মতো মনে হয়। যদিও এটি চর্বি নয়, তবুও এটি সাময়িকভাবে ওজন বাড়িয়ে দেখাতে পারে। কোষ্ঠকাঠিন্যের কারণে মল শরীরে জমে থাকলে তা ওজনের ওপর প্রভাব ফেলে।

নিয়মিত ব্যয়াম করা উচিৎ
নিয়মিত ব্যয়াম করা উচিৎ

পুষ্টি শোষণে সমস্যা: দুর্বল হজম প্রক্রিয়া শরীরের পুষ্টি শোষণে বাধা দেয়, যার ফলে শরীর প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায় না। এটি ক্ষুধা বাড়িয়ে দিতে পারে। কারণ, শরীর পুষ্টির ঘাটতি পূরণের জন্য বেশি খাবার গ্রহণের সংকেত দেয়। এর ফলে অতিরিক্ত ক্যালরি গ্রহণ ও ওজন বৃদ্ধি ঘটে।
জীবনযাত্রার প্রভাব: হজম সমস্যা প্রায়ই খাদ্যাভ্যাসের (যেমন প্রক্রিয়াজাত খাবার, ফাইবারের অভাব) বা শারীরিক নিষ্ক্রিয়তার সঙ্গে যুক্ত। এই জীবনযাত্রা ওজন বাড়ার ঝুঁকি বাড়ায়। ফাইবার কম খাওয়া বা পর্যাপ্ত পানি না পান করা হজমকে ধীর করে দেয়, যা ওজন বৃদ্ধিতে অবদান রাখে।

যেভাবে হজম সমস্যা ও ওজন বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করবেন

শাকসবজি ও টক দই উপকারি
শাকসবজি ও টক দই উপকারি

• ফাইবারসমৃদ্ধ খাবার: শাকসবজি, ফল, ওটস ও গোটা শস্য খান, যা হজম উন্নত করে। হজম সমস্যা উন্নত করতে চাইলে দিনে নিজের ওজনের সঙ্গে তুলনা করে ফল খাবেন। যেমন ৭০ কেজি ওজন হলে ৭০০ গ্রামের মতো ফল খাবেন দুপুরের আগে। খেয়াল রাখতে হবে রাতে খাওয়ার পরে ফল খেলে ওজন বাড়ার আশঙ্কা থাকে, যার কারণে ডায়াবেটিক রোগীদের ক্ষেত্রে রাতে ফল খাওয়া একদম নিষেধ।
• পর্যাপ্ত পানি: প্রতিদিন ২-৩ লিটার পানি পান করুন, যা কোষ্ঠকাঠিন্য কমায়। শরীরটাকে পানিময় রাখতে হলে সারা দিন ধীরে ধীরে পানি পান করার অভ্যাস গড়তে হবে।
• প্রোবায়োটিক: দই বা প্রোবায়োটিক–সমৃদ্ধ খাবার খান, যা অন্ত্রের স্বাস্থ্য উন্নত করে। দুপুরে খাওয়ার পরে টক দই চমৎকার পথ্য।
• নিয়মিত ব্যায়াম: শারীরিক কার্যকলাপ বিপাকীয় হার বাড়ায় এবং হজম উন্নত করে।
ওজন কমানোর অনেক ধরনের চেষ্টার মধে৵ হজমশক্তি ঠিক না করে কোনোভাবেই অন্য রাস্তায় গিয়ে সুবিধা হবে না, তাই ওজন কমাতে চাইলে নানা ডায়েট মেনে চললেও হজমশক্তি ঠিক করা ছাড়া ভালো উপায় নেই।

লেখক: খাদ্য ও পথ্যবিশেষজ্ঞ; প্রধান নির্বাহী, প্রাকৃতিক নিরাময় কেন্দ্র।

ছবি: পেকজেলসডটকম

প্রকাশ: ২৩ মে ২০২৫, ০১: ০০
বিজ্ঞাপন