
আমরা সবাই খুব ছোটবেলা থেকেই দেখি বা বিশ্বাস করি, যে কোনো বিরূপ পরিস্থিতি সামাল দিতে বাবা হাজির হন একজন নীরব যোদ্ধা হিসেবে। কিন্তু বাস্তবতা আরও অনেক বেশি জটিল। পরিবারকে সামলে নেওয়ার শক্তি জোগাতে বা দায়িত্বপালনের সঙ্গে যুক্ত হয় মানসিক চাপ, উদ্বেগ ও অবসাদ; যা থেকে যায় আমাদের দেখার বা বোঝার অনেক বাইরে। রগারস হেলথের এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, বাবাদের এই মানসিক অবসাদ সন্তানের মানসিক বিকাশ ও আচরণে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে।

রগারস রবার্ট উড জনসন মেডিকেল স্কুলের (Rutgers Robert Wood Johnson Medical School) সহকারী অধ্যাপক ক্রিস্টিন শিমৎজের নেতৃত্বে করা গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে আমেরিকান জার্নাল অব প্রিভেন্ট মেডিসিনে (American Journal of Preventive Medicine)। এই গবেষণায় গেছে, কোন শিশুর ৫ বছর বয়সে তার পিতা মানসিক অবসাদে ভুগলে, সেই শিশুর ৯ বছর বয়সে এসে কিছু আচরণগত সমস্যা দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে তার স্কুল জীবনে। যেমন- অস্থিরতা, রাগ, সহপাঠীদের সহযোগিতা না করা, কিছু কিছু ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাসের অভাব দেখা যাওয়া ইত্যাদি।
এই গবেষণায় অংশগ্রহণ করে ১,৪২২ জন পিতা এবং তাঁদের সন্তান। গবেষকেরা ৫ বছর বয়সে পিতার অবসাদের লক্ষণ এবং ৯ বছর বয়সে শিক্ষকের মাধ্যমে সন্তানের আচরণগত তথ্য বিশ্লেষণ করে এই তথ্য তুলে ধরেছেন। এক্ষেত্রে মায়ের মানসিক অবস্থা নিয়ন্ত্রণে রেখে, শুধু বাবার মানসিক অবস্থার প্রভাব আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
সন্তানের ওপর প্রভাব কেন পড়ে সে বিষয়ে গবেষকেরা জানান, একজন অবসাদগ্রস্ত পিতা সন্তানের প্রতি পর্যাপ্ত পরিমাণ মনোযোগ দিতে পারেন না বা আবেগ প্রকাশ করতে পারেন না। তাঁর মানসিক অস্থিরতা সন্তানের সঙ্গে সময় কাটানো, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন এবং মনোযোগ দেওয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। এতে পরিবারে মানসিক চাপ বা দ্বন্দ্বও বেড়ে যেতে পারে; যা শিশুদের মানসিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

বাবাদের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্নের চিত্র এই গবেষণায় উঠে এসেছে। এতে দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৮% থেকে ১৩% পিতা তাঁদের সন্তানের শৈশবকালে কোনো না কোনো পর্যায়ে মানসিক অবসাদে ভোগেন। আর যদি সন্তানের মা নিজেও পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হন, তবে পিতার মধ্যে এই হার বেড়ে যেতে পারে ৫০% পর্যন্ত। তবুও চিকিৎসাব্যবস্থা থেকে শুরু করে সচেতনতামূলক আলোচনার সব জায়গায় বাবার মানসিক স্বাস্থ্য উপেক্ষিতই থেকে যায়। অধ্যাপক শিমৎজ বলেন, ‘শুধু মায়ের মানসিক স্বাস্থ্য নয়, বাবাদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়েও আলোচনার দরকার আছে। ডিপ্রেশন চিকিৎসাযোগ্য এবং পুরো পরিবারের সুস্থতা নিশ্চিত করতে হলে বাবা-মায়ের দুজনের সঙ্গেই মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হওয়া প্রয়োজন।

• প্রাথমিক ধাপে শনাক্তকরণ:
বাবাদের মধ্যে ডিপ্রেশনের উপসর্গ চিহ্নিত করে সময়মতো সহায়তা প্রদান।
• বাবাদের হেলথ কেয়ার:
শিশু চিকিৎসকদের এমন প্রশিক্ষণ দেওয়া যাতে তাঁরা বাবাদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়েও কথা বলেন।
• সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি:
সমাজে খোলামেলা আলোচনা ও গণমাধ্যমে উপস্থাপন; যাতে বাবারা নিজেদের দুর্বলতা প্রকাশ করতে লজ্জা না পান।
• প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা:
বাবাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য সাপোর্ট প্রোগ্রাম, সহানুভূতিশীল কর্মস্থল এবং পিতৃত্বকালীন ছুটির নীতি বাস্তবায়ন।

অধ্যাপক শিমৎজ বলেন, এই গবেষণা থেকে আমরা বাবাদের শক্তির নতুন সংজ্ঞা খুঁজে পেয়েছি। গবেষণাটি অনেকেরই চোখ খুলে দিয়েছে। অনেকেই বুঝতে পেরেছে পিতার মানসিক সুস্থতা সন্তান ও পরিবারের ভবিষ্যতের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। বাবাদের উচিত নিজের কষ্ট গোপন না করে সাহসের সঙ্গে সাহায্য চাওয়া। এটাই হবে সত্যিকারের সামর্থ্যের প্রতিফলন। আমরা বিশ্ব বাবা দিবসকে শুধু উদ্যাপন নয়, বাবাদের অনুভূতি বোঝার উপলক্ষ হিসেবে গ্রহণ করতে পারি। তাহলেই সমাজ হবে আরও সহানুভূতিশীল, আরও মানবিক।
সূত্র: রগারস হেলথ গবেষণাপত্র
ছবি: পেকজেলসডটকম