আমাদের বিদেশি ফলের প্রতি আগ্রহ অনেক বেশি। আত্মীয়স্বজনের অসুস্থতায় আমার বিদেশি ফল নিয়েই দেখতে যাই, দেশি ফল নিতে গেলে হীনম্মন্যতায় ভোগী। কে কী বলেন, কী মনে করেন। অথচ আমরা খাদ্যগুণ হিসেবে বিবেচনা করে ফল খেলে এবং রোগীকে খেতে দিলে অনেক বিদেশি ফলের চেয়ে দেশি ফলের গুণ বিবেচনায় দেশি ফলই উত্তম পছন্দ হওয়া উচিত ছিল। এই সিরিজে এর আগে আমরা আপেল আর পেয়ারা নিয়ে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করেছি। এবার আলোচনা করা যাক বিদেশি ফল আঙুর আর আমাদের দেশি ফল আমড়া নিয়ে।
আঙুর ও আমড়া—দুটিই পুষ্টিকর ফল, তবে কোনটি ‘ভালো’, সেটা নির্ভর করে আপনার স্বাস্থ্যের চাহিদা, স্বাদের পছন্দ ও উদ্দেশ্যের ওপর। পুষ্টিগুণে আঙুরের চেয়ে আমড়ায় বেশি থাকে ফাইবার, পটাশিয়াম ও ফ্যাট। ভিটামিন সি আঙুরের চেয়ে আট গুণ বেশি আমড়ায়। ভিটামিন এ ছয় গুণ বেশি আঙুরের চেয়ে আমড়ায়। শুধু ক্যালোরি ও কার্বোহাইড্রেট সামান্য বেশি আঙুরে। অথচ পুষ্টি বিবেচনায় আমরা কিন্তু কম হলেও আঙুরই খেতে আগ্রহী। আমড়া দেশি ফল অনেকটা অবহেলায় বছরে একটি বা দুটি খাওয়া হয়।
এবার দেখে নেওয়া যাক আঙুর ও আমড়ার পুষ্টিগুণ, উপকারিতা, অপকারিতা ও পার্থক্যে তুলনা। তাহলে বোঝা সহজ হবে কোনটি কখন ভালো হতে পারে।
আমড়ায় পলিফেনল ও ভিটামিন সির নিরীখে আঙুরের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী অ্যান্টি–অক্সিডেন্টের উৎস। তবে রেসভেরাট্রলের ক্ষেত্রে এটি আঙুরের তুলনায় বেশ পিছিয়ে। আঙুরে রেসভেরাট্রল ও ফ্ল্যাভোনয়েডের জন্য বিখ্যাত, বিশেষ করে লাল ও কালো আঙুরে অ্যান্থোসায়ানিনের উপস্থিতি এটিকে আলাদা করে।
(উৎস: ইএসডিএ ডেটাবেস ও অন্যান্য নির্ভরযোগ্য উৎস)
• অ্যান্টি–অক্সিডেন্টসমৃদ্ধ: লাল আঙুরে রেসভেরাট্রল ক্যানসার প্রতিরোধ, হৃদ্রোগের ঝুঁকি কমায় ও বার্ধক্য রোধে সহায়ক।
• হৃদ্রোগের জন্য উপকারী: পটাশিয়াম ও ফ্ল্যাভোনয়েড রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
• চোখ ও ত্বকের স্বাস্থ্য: ভিটামিন কে এবং অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট ত্বক ও চোখের জন্য ভালো।
• হজমশক্তি: হালকা ফাইবার হজমে সহায়তা করে, তবে আমড়ার তুলনায় কম।
• স্বাদ: মিষ্টি-টক স্বাদ, সরাসরি খাওয়া বা সালাদে ব্যবহারের জন্য জনপ্রিয়।
• ভিটামিন সি–সমৃদ্ধ: আঙুরের তুলনায় আমড়ায় ভিটামিন সি প্রায় আট গুণ বেশি, যা রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায় এবং ত্বকের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে।
• হজমশক্তি উন্নত: ফাইবার কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে ও পাকস্থলীর স্বাস্থ্য রক্ষা করে।
• ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ: নিম্ন গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ও পলিফেনল রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
• ওজন কমাতে সহায়ক: কম ক্যালোরি ও বেশি ফাইবার ওজন নিয়ন্ত্রণে কার্যকর।
• ক্যানসার প্রতিরোধ: পলিফেনল ও অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট ক্যানসার প্রতিরোধে সহায়ক।
• চিনির পরিমাণ বেশি: ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য অতিরিক্ত খাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ।
• কম ফাইবার: হজমশক্তির জন্য আমড়ার তুলনায় কম কার্যকর।
• দাম: বাংলাদেশে আমদানি করা আঙুর ব্যয়বহুল।
• এলার্জি: কারও কারও আঙুরে এলার্জি (ত্বকে চুলকানি) হতে পারে।
• অ্যাসিডিটি: অতিরিক্ত খেলে অ্যাসিডিটি বা পেটে অস্বস্তি হতে পারে।
• দাঁতের ক্ষতি: টক স্বাদের কারণে দাঁতের অ্যানামেল ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
• অপরিপক্ব আমড়া: অপরিপক্ব আমড়া খেলে পেটের সমস্যা হতে পারে।
• এলার্জি: কারও কারও ত্বকে ফুসকুড়ি বা এলার্জি হতে পারে।
• আপনি মিষ্টি-টক স্বাদ পছন্দ করেন ও সরাসরি ফল খেতে চান। রেসভেরাট্রলের মতো নির্দিষ্ট অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট চান, যা হৃদ্রোগ ও বার্ধক্য রোধে সহায়ক। হালকা ক্যালোরিযুক্ত স্ন্যাক চান, যা হজমে সহজ হয় তাহলে আঙুর খান।
• আপনার ভিটামিন সি বেশি প্রয়োজন (রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বা ত্বকের জন্য)। ওজন কমানো বা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ আপনার লক্ষ্য। হজমশক্তি বাড়াতে বেশি ফাইবার চান। সাশ্রয়ী, স্থানীয় ও টক স্বাদের ফল পছন্দ করেন (আচার বা চাটনির জন্যও উপযুক্ত)। বাংলাদেশের স্থানীয় ফলের প্রতি সমর্থন জানাতে চান তাহলে আমড়া খান।
আমাদের মধ্যে বেশি দামের বিদেশি ফলের প্রতি দুর্বলতার ট্যাবু আছে, এটা ভাঙতে হবে। আমাদের দেশি ফলে গুণের যে বেশুমার ভান্ডার রয়েছে, তা গ্রহণের মাধ্যমে আমরা নিজেদের সুস্বাস্থ্য ও দেশজ ফলের প্রতি যত্নবান হতে আজ থেকে চেষ্টা শুরু করি। বিশেষ করে শিশুদের দেশি ফল খাওয়ার ক্ষেত্রে উৎসাহ জোগাই। স্বাদ সামর্থ্য অনুযায়ী মানুষ বেশি দামি বিদেশি ফল খেতেই পারে, তবে গুণের বিবেচনায় ফল খেতে হলে অবশ্যই দেশি ফলের প্রতি যত্নবান হওয়া দরকার।
খাদ্য ও পথ্য বিশেষজ্ঞ: প্রধান নিবার্হী, প্রাকৃতিক নিরাময়কেন্দ্র
ছবি: পেকজেলসডটকম, সঞ্চয়িতা ও উইকিপিডিয়া