ওজন কমানো, বলতে গেলে সামাজিক মাধ্যমের সূচনা থেকেই সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। এখন ইউটিউব থেকে শুরু করে সব সোশ্যাল মিডিয়ায় এটা নিয়ে কথা হয়। ওজন কমানোর আছে নানা পদ্ধতি। কোন পদ্ধতি আসলে কাজ করে, তা নিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। কিছু মূল বিষয় মাথায় রাখলে, বিভিন্ন পরামর্শে বিভ্রান্ত না হয়ে এগুলো মেনে চললে পাবেন উপকার।
অতিরিক্ত ওজন কারোরই কাম্য নয়। সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকতে প্রয়োজন সঠিক ওজন। আমাদের খাদ্যাভ্যাস ও দৈনন্দিন জীবনের ধরনের কারনে আমাদের ওজন বেড়ে যায়। এই বাড়তি ওজন থেকে হতে পারে নানা ধরনের রোগ, তাই সঠিক ওজন বজায় রাখা অত্যন্ত প্রয়োজন।
সুষম খাদ্যাভ্যাস মেনে চলুন
ওজন কমানোর প্রথম ধাপ হল সুষম খাদ্যাভ্যাস। খাদ্যতালিকায় পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রোটিন, শাকসবজি, ফলমূল আর হোল গ্রেইন যোগ করুন। প্রোটিন ওজন কমানোর ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ; কারণ এটি ক্ষুধা কমায় এবং দীর্ঘ সময় পেট ভরা রাখে। প্রোটিনের ভালো উৎস হতে পারে মুরগির মাংস, ডিম, মাছ, ডাল, ছোলা ইত্যাদি।
নিয়মিত ব্যায়াম করুন
শারীরিক ব্যায়াম ওজন কমানোর জন্য অপরিহার্য। প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিটের জন্য যেকোনো ধরনের ব্যায়াম করুন। হাঁটা, দৌড়ানো, সাইকেল চালানো, যোগব্যায়াম—এগুলো থাকতে পারে দিনের তালিকায়। ব্যায়াম শুধু ওজন কমায় না, এটি শরীরের মেটাবলিজম বাড়ায়।
পানি পান করুন
ওজন কমানোর জন্য পর্যাপ্ত পানি পান করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পানি শরীর থেকে টক্সিন বের করে দেয় এবং মেটাবলিজম বাড়ায়। প্রতিদিন ৮-১০ গ্লাস পানি পান করার চেষ্টা করুন। খাবার খাওয়ার ৩০ মিনিট আগে পানি পান করলে ক্ষুধা কমে যায় এবং অতিরিক্ত খাওয়া হয় না।
নিয়মিত ঘুম
সুস্থ শরীরের জন্য পর্যাপ্ত ঘুম অত্যন্ত জরুরি। নিয়মিত ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানোর চেষ্টা করুন। ঘুমের অভাব মেটাবলিজম কমিয়ে দেয় এবং ক্ষুধা বৃদ্ধির হরমোন বাড়িয়ে দেয়, যা বেশি খাওয়ার প্রবণতা তৈরি করে।
চিনিযুক্ত খাবার ও পানীয় পরিহার করুন
চিনিযুক্ত খাবার ও কোমল পানীয় ওজন বাড়ানোর জন্য অনেকাংশে দায়ী। কোমল পানীয়, মিষ্টি, ক্যান্ডি, পেস্ট্রিজাতীয় খাবার যতটা সম্ভব পরিহার করুন। এগুলো উচ্চ ক্যালরিযুক্ত এবং শরীরের চর্বি জমার হার বাড়িয়ে দেয়। কোমল পানীয় ও চিনিযুক্ত পানীয় পরিহার করে প্রাকৃতিক পানীয় যেমন লেবু-পানি, ডাবের পানি আর তাজা ফলের রস পান করুন। এগুলো কম ক্যালরিযুক্ত এবং শরীরকে হাইড্রেটেড রাখে।
হোল গ্রেইন খাবার খান
হোল গ্রেইন খাবার যেমন ব্রাউন রাইস, ওটমিল, ভুষিসহ গমের রুটি ওজন কমাতে সহায়ক। এগুলোতে ফাইবার থাকে, যা হজমপ্রক্রিয়া ধীর করে এবং পেট দীর্ঘ সময় ভরা রাখে।
খাবার একবারে না খেয়ে অল্প অল্প করে খাওয়া
সঠিক পোর্শনের খাবার ওজন কমাতে বেশি কার্যকর। প্রতিদিন ৫-৬ বেলা খাবার খান, যাতে প্রোটিন ও ফাইবারসমৃদ্ধ খাবার থাকে। এতে আপনার মেটাবলিজম বাড়ে এবং ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণ হয়।
গ্রিন টি
এতে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আছে, যা মেটাবলিজম বাড়ায় এবং ফ্যাট বার্ন করতে সহায়তা করে। প্রতিদিন ২-৩ কাপ সবুজ চা পান করার চেষ্টা করুন।
পর্যাপ্ত শাকসবজি ও ফল খান
শাকসবজি ও ফল ওজন কমাতে খুবই সহায়ক। এগুলোতে ফাইবার এবং ভিটামিন-এ, সি ও কে থাকে, যা শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় এবং ওজন কমাতে সাহায্য করে। শাকসবজি ও ফলমূল খেলে পেট ভরা থাকে আর অতিরিক্ত ক্যালরি গ্রহণের প্রবণতা কমে।
স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট
স্ট্রেস ওজন বাড়ার একটি অন্যতম কারণ । স্ট্রেস থেকে মুক্তি পেতে ধ্যান, যোগব্যায়াম ও শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যায়াম করতে পারেন। এগুলো মানসিক শান্তি দেয় এবং ওজন কমাতে সহায়তা করে।
খাবারের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করুন
খাবারের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা ওজন কমানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। খাওয়ার সময় ছোট প্লেট ব্যবহার করুন; এটা খাবারের পরিমাণ কম রাখতে সাহায্য করবে। এ ছাড়া, খাবার খাওয়ার সময় মনোযোগ দিয়ে খাবেন, যাতে আপনি খাবারের স্বাদ পুরোপুরি উপভোগ করতে পারেন।
সক্রিয় থাকুন
দৈনন্দিন জীবনে বাড়িতে সক্রিয় থাকার চেষ্টা করুন। লিফটের পরিবর্তে সিঁড়ি ব্যবহার করুন, কাছাকাছি জায়গায় হাঁটুন, এবং ্লম্বা সময় ধরে বসে থাকতে হলে সেসময় ঘন ঘন উঠুন ও হাঁটুন। এভাবে সক্রিয় থাকা মেটাবলিজম বাড়ায় এবং ওজন কমা্য।
স্বাস্থ্যকর স্ন্যাকস খাওয়া
স্ন্যাকস খাওয়ার সময় স্বাস্থ্যকর খাবার যেমন বাদাম, ফল বা দই বেছে নিন। এগুলো কম ক্যালরিযুক্ত আর পুষ্টিসমৃদ্ধ।
হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস
ওজন কমালে হৃদরোগের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। অতিরিক্ত ওজন উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চ কোলেস্টেরল ও টাইপ টু ডায়াবেটিসের মতো সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে যা হার্টের অসুখের ঝুঁকি বাড়ায়। ওজন কমালে এই সমস্যাগুলো কমে আর হৃৎপিণ্ড সুস্থ থাকে।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ
ওজন কমানোর মাধ্যমে টাইপ টু ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। শরীরের ওজন কমানোর ফলে ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়ে, যা রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়ক।
উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ
ওজন কমানোর মাধ্যমে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। ওজন কমালে রক্তনালিতে চাপ কমে এবং রক্ত সঞ্চালন সহজ হয়, ফলে উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা কমে।
হাড় ও অস্থিসন্ধির সুরক্ষা
অতিরিক্ত ওজন হাড় ও অস্থিসন্ধির ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে, যা আর্থ্রাইটিস আর অন্যান্য জয়েন্টের সমস্যার কারণ হতে পারে। ওজন কমালে এই চাপ কমে এবং হাড় ও অস্থিসন্ধি সুস্থ থাকে।
শ্বাসকষ্ট হ্রাস ও ভালো ঘুম
ওজন কমানোর ফলে শ্বাসকষ্ট কমে আর ভালো ঘুম হয়। অতিরিক্ত ওজন ঘুমের সময় শ্বাসকষ্ট ও নাক ডাকা্র মতো সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, যা ওজন কমালে আপনা হতেই কমে যায়।
মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি
ওজন কমানোর ফলে মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়। অতিরিক্ত ওজন কমালে আত্মবিশ্বাস বাড়ে এবং মানসিক চাপ কমে। ওজন কমানোর মাধ্যমে নিজেকে আরো আত্মবিশ্বাসী করে তোলা যায়।
শক্তি ও সক্রিয়তা বৃদ্ধি
ওজন কমালে শরীরে শক্তি ও সক্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। অতিরিক্ত ওজন কমলে শরীর হালকা হয় এবং কাজ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
ওজন কমানো একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া, যাতে সময় ও ধৈর্যের প্রয়োজন। সঠিক খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম ও স্বাস্থ্যকর জীবনধারার সাহায্যে আপনি অবশ্যই ওজন কমাতে সফল হবেন। নিজেকে সময় দিন এবং লক্ষ্য রাখুন, ধীরে ধীরে পরিবর্তন আনুন এবং নিজের প্রতি সদয় থাকুন।
সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া
ছবি: পেকজেলসডটকম