মাত্র তিন মাস আগেও বাংলাদেশের মানুষ এই শব্দটির সঙ্গে সেভাবে পরিচিত ছিল না। কিন্তু শব্দটি এখন সবার শোনা। কারা এই জেন–জি? আমরা ওদের বলতে পারি ডিজিটাল জেনারেশন। ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের ভেতর যে শিশুরা জন্ম নিয়েছে, বড় হচ্ছে তারা এই জেনারেশনের তরুণ-তরুণী বা কিশোর-কিশোরী। আর আমাদের যাদের জন্ম আশি-নব্বই দশকে তারা তাদের বাবা-মা, খালা-মামা, চাচা-ফুফু বা তাদের শিক্ষক, ডাক্তার, থেরাপিস্ট।
জেনারেশন জি হলো সেই জেনারেশন, যারা জন্মের পর থেকে স্মার্টফোন, স্মার্ট টেলিভিশন, শক্তিশালী টেকনোলজি, সোশ্যাল মিডিয়া, ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, জুম, গুগল সার্চ ইঞ্জিন, ভিডিও কল, ফেস টাইম, অনলাইন ক্লাস, অনলাইন স্কুল, অনলাইন কলেজ, অনলাইন চাকরি, ফ্রিল্যান্সিং, ডিজিটাল মিডিয়া, ডিজিটাল কারেন্সি, অঢেল জ্ঞান অর্জনের সুযোগ নিয়ে বড় হওয়া প্রথম প্রজন্ম।
এই জেনারেশনের পজিটিভ দিকগুলোই বেশি। তবু কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। আমি নিজেকে সৌভাগ্যের অধিকারী মনে করি; কারণ, আমি জেন–জিদের সঙ্গে তাদের বাবা-মায়েদের সঙ্গে পনেরো বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছি। এই জেনারেশনের অর্ধেকের বেশি শিশু নানা মানসিক রোগ বা শারীরিক রোগে ভুগছে; অথবা এই জেনারেশনের এক-তৃতীয়াংশের রয়েছে নানা ধরনের ডিজঅ্যাবিলিটি। আবার ওরা ওদের ডিজেবল ভাই-বোনদের সঙ্গে থেকে জীবনযাপন করতে শিখেছে। এই প্রজন্ম সবচেয়ে বেশি পারিবারিক ভাঙন দেখেছে, ডিভোর্স দেখেছে। আবার মা–বাবার অ্যাটেনশন, ভালোবাসা, কোয়ালিটি সময়, স্কুল ছুটিতে বেড়াতে যাওয়া—এসবও উপভোগ করেছে।
তাহলে প্রশ্ন হলো, এত সুবিধা নিয়ে বড় হওয়া প্রজন্মের মধ্যে এত হতাশা কেন? কেন তারা একাকিত্বে ভোগে? কেন ক্রনিক হেলথ কন্ডিশন এই শিশু–কিশোরদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা যেতে পারে। জেনারেশন জিদের বেশির ভাগ শিশু হাসপাতালে জন্মগ্রহণ করেছে। জন্মের পর মায়ের মুখ দেখার আগে দেখেছে মাস্ক পরা ডাক্তারের মুখ। এদের বেশির ভাগ অ্যান্টিবায়োটিক অতিরিক্ত মাত্রায় ব্যবহারের শিকার। টন্সিলাইটিস, এডিনয়েডস, অ্যালার্জি, অ্যাজমা, ইমিউন সিস্টেম ড্যামেজ, অটোইমিউন ডিজিজ, থাইরয়েড, ভিটামিন ডিসহ প্রধান কিছু ভিটামিন ও মিনারেলসের অভাব, গাট হেলথ ইস্যু, খাবারের সেন্সিটিভিটি, ইনটলারেন্স, আইবিএস, সিলিয়াক ডিজিজ, নিউরোডিজঅর্ডার, মিনারেল টক্সিসিটি, দাঁতের সমস্যা, টুরেট সিনড্রোম, টিকস, অ্যাংজাইটি, অ্যাগ্রোফোবিয়া, মোবাইল ফোন বা ভিডিও গেমস অ্যাডিকসন, প্রকাস্টিনেশন ও ডিপ্রেশন, একাকিত্ব, অটিজম, হাইপারঅ্যাকটিভিটি, মুড সুইং, কম ফোকাস স্প্যান—এসব হেলথ কন্ডিশনের একটি বা কয়েকটি নিয়ে বড় হচ্ছে জেনারেশন জি।
এরা বাস্তব আর ভার্চ্যুয়াল পৃথিবী বৈপরীত্যের ধকলে সামঞ্জস্য বিধান করতে অনেক সময় ব্যর্থ হয়; তাই হতাশা দানা বাঁধে। এই প্রজন্মের বেশির ভাগই ছোট থেকেই প্রোগ্রাম করা, তাই তারা সত্য-মিথ্যা নিয়ে কনফিউজড বা সন্ধিহান থাকে। ইচ্ছে করেই এই প্রজন্মকে কনফিউশনের মধ্যে রাখা হয়। খুব পরিকল্পিতভাবে সার্চ ইঞ্জিনগুলোয় কুকিজ ব্যবহার্য করা হয়; এআই সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়। সারাক্ষণ মনিটর করা হয় ওদের স্ক্রিনটাইম, ওরা কে কী দেখছে সেটা; আর ওরা যেটা দেখে, তাকে সেই বিষয়ের ভিডিও, আর্টিকেল, তথ্য বেশি বেশি করে পাঠানো হয়। এদেরকে এই ফ্যান্টাসির জগৎ থেকে আর সহজে বের হতে দেওয়া হয় না। এরা বিচরণ করে গোলকধাঁধার মধ্যে।
এরপর একে বলা হয় ছেলেটি বা মেয়েটি তার নিশ ফলো করছে। অতিরিক্ত ডেটা ও তথ্যের কারণে মস্তিষ্ক ক্লান্ত হয়ে পড়ে। কারণ, প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি তথ্য, ছবি, ভিডিও মস্তিষ্ককে প্রতি ঘণ্টায় স্ক্যান করতে হয়। আরেকটি বিষয় হলো, যে যে বিষয় বিশ্বাস করতে চায় তাকে সেই বিষয় নিয়েই তথ্য তৈরি করে দেওয়া। কেউ যদি বিশ্বাস করে, ব্রিটিশরা ভারতবর্ষে আসার কারণে দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষতি হয়েছে, তাহলে তার কাছে হাজার হাজার তথ্য-উপাত্তসহ প্রমাণ আসতেই থাকবে বোঝানোর জন্য যে আসলে কত বেশি ক্ষতি হয়েছিল।
কিন্তু আরেকজন যদি বিশ্বাস করে যে ইংরেজরা আসায় ভারতবর্ষ বা দক্ষিণ এশিয়ার উপকার হয়েছে, তাহলে হাজার হাজার তথ্যপ্রমাণ সামনে আসতেই থাকবে। সুপারকম্পিউটারের এসব কারসাজির কারণে একজনের সত্য ও আরেকজনের সত্যের মধ্যে থাকে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। এতে তৈরি হয় অবিশ্বাস ও হতাশা। এই কাজ সুনিপুণভাবে করে থাকে সুপারকম্পিউটার পারসোনালাইজড ডেটা তৈরির নামে।
জেন–জি অনেক বুদ্ধিদীপ্ত একটি প্রজন্ম। তারা দেশ বা মানচিত্রের সীমায় আবদ্ধ নয়। তাই তারা বন্ধুত্ব করে বা সম্পর্ক করে সারা বিশ্বের সমবয়সীদের সঙ্গে। তারা ভার্চ্যুয়াল বন্ধুত্ব বা ভার্চ্যুয়াল ভালোবাসায় বিশ্বাস করে। আমি একজন থেরাপিস্ট, পুষ্টিবিদ ও নেচারোপাথিক। ফলে যেসব কিশোর-কিশোরী বা তরুণ আমার কাছে সেবা নিতে এসেছে, তাদের সঙ্গে কথা বলার অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি এই প্রজন্মের অনেকেই খুব বাজেভাবে তাদের অনলাইন বন্ধুদের বুলিংয়ের শিকার।
বুলিং, থ্রেট দেওয়া, খুব বাজেভাবে ট্রল করা, মিম বানিয়ে হেনস্তা করা, কাউকে স্টক করা, গালিগালাজ করে ভয়েস মেসেজ করে পাঠানো, সেক্সচুয়াল গ্রুপে যুক্ত করিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনা চলতেই থাকে। এতে অনেক শিশুই (১৮ বছরের নিচে) এতে তীব্র অপমানিত বোধ করে, ভীত হয়, হতাশায় ভোগে, লজ্জিত থাকে। এ থেকে তারা ক্লিনিক্যালি ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটি, সেপারেশন অ্যাংজাইটি, ইম্পস্টার সিনড্রোমে ভুগতে থাকে। তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের অভাব কিংবা নিজেকে নিজের ক্ষতি করার প্রবণতা দেখা যায়। এরা ক্ষুধামান্দ্যে ভোগে। নিজেকে সবকিছু থেকে সরিয়ে রাখতে চায়। অ্যাগ্রোফোবিয়া, অ্যানোরেক্সিয়া ও আত্মহননে চিন্তায় বিভোর থাকে।
আমি নিজেও অবাক হয়ে ভেবেছি একটি শিশু কীভাবে আরেকটি শিশুকে এতটা নিষ্ঠুরভাবে বুলিং করে! আমার মনে হয়েছে এই শিশুদের ওভারলোডেড মস্তিষ্ক মূলত চলছে মস্তিষ্কের এমিগডালা অংশ দিয়ে সারভাইভাল মোডে। তাই তাদের কারও কারও ব্যবহারে দায়বদ্ধতার অভাব রয়েছে ভীষণভাবে।
এই প্রজন্মের একটি বড় অংশ পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত; কেউ কেউ এক্সপোজড। সেক্স অফেন্ডারস বেড়ে গেছে, বেড়েছে পিডোফিলিয়াও। কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই গত এক বছরে নিবন্ধিত সেক্স অফেন্ডার বেড়েছে ৪৩ হাজার এবং অনিবন্ধিত জানা সেক্স অফেন্ডারের সংখ্যা হলো ৮০ হাজার। না জানা আছে হয়তো অযুত। এই প্রজন্মের সম্পর্ক গড়া এবং ভাঙার একটা বড় কারণ হলো কমিটমেন্টের অভাব, বন্ধুত্বহীনতা, বহুগামিতা, অবিশ্বাস, সেক্স করার ধরন। আবেগের ভারসাম্যহীনতার মতো করেই যৌনতার ভারসাম্যহীনতাও বেড়েছে এই প্রজন্মে। বেড়েছে বিভিন্ন ধরনের যৌন রোগও।
খাবারের সঙ্গে সুন্দর সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি
জেন–জিদের বেশির ভাগ শিশুই ছোটবেলায় মোবাইল দেখে খেতে অভ্যস্ত। মায়েরা মোবাইল দেখিয়ে তাদের খাইয়েছে। এটা মায়েদের জন্য ছিল অনেক সহজ। এর খারাপ দিক হলো খাবারের সঙ্গে সুন্দর একটা সম্পর্ক এই শিশুদের গড়ে ওঠেনি। এই প্রজন্মের একটি বড় অংশ ইটিং ডিজঅর্ডারে ভুগছে। তারা ফাস্ট ফুডে আসক্ত। তারা ভুগছে আইবিএস, আইবিডি, সিলিয়াক, ডাইভার্টিকিউলাইটিস, ক্রোন ডিজিজ, ক্রনিক কনস্টিপেশন, অ্যানাল ফিশারসহ গাট হেলথ ও কোলনজনিত নানান সমস্যায়। বলা যায়, কেবল খাবারের অভ্যাস ঠিক না থাকায় এই প্রজন্মের একটি বড় অংশ অপুষ্টিতে ভুগছে।
এদেরই আবার আরেকটা অংশ খুবই স্বাস্থ্যসচেতন। তারা জিম করছে, ফিটনেস বজায় রাখার জন্য ডায়েট করছে, প্রাকৃতিকভাবে তৈরি খাবার খাচ্ছে। পাশ্চাত্যে তাই জেন–জি প্রজন্মের কাছে যোগব্যায়াম, মেডিটেশন, সাউন্ড থেরাপি, ল অব অ্যাট্রাকশন, মাইন্ড ট্রেইনিং, চায়নিজ হারবাল, আয়ুর্বেদিক লাইফস্টাইল, ডিটক্স ও রিস্টোরিং, পুষ্টি ও ভিটামিন থেরাপি, প্রোটিন শেক, ভেজিটেবল জুস ইত্যাদি খুব জনপ্রিয়।
এদের সবকিছুই অনন্য
জেন–জি প্রজন্মের সমস্যা যেমন ইউনিক, তাদের চিকিৎসাপদ্ধতিও তেমনি ভিন্ন এবং অনেক অ্যাডভান্স লেবেলে হতে হয়। শুধু একটি মাধ্যমে ট্রেনিং নিয়ে জেন–জি প্রজন্মের চিকিৎসা সম্ভব না। আমি নিজেকে অনেক সৌভাগ্যের অধিকারী মনে করি। কারণ, আমি প্রয়োজনীয় সব ধরনের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম বলেই সফলতার সঙ্গে জেন–জিদের সেবা দিতে সক্ষম হচ্ছি। এরা এমন একটি প্রজন্ম, যারা জানে যে খুশি হলে ডোপামিন নিঃসরণ হয় আর দুঃখ পেলে অ্যাড্রিনালিন, টেনশন করলে করটিসল রিলিজ হয়। কিন্তু তারা হয়তো জানে না যে তারা খুব পরিকল্পিত বাণিজ্যিকীকরণের ডোপামিন রাশের শিকার। জানলেও কীভাবে নিজেকে বের করে আনতে হবে, তা সঠিকভাবে বুঝতে পারে না। জন্মের পর থেকে হাই রেজল্যুশন টেলিভিশন বা হাই রেজল্যুশন ফোন, মজাদার কার্টুন, নার্সারি রাইমস—এসব খুব সহজভাবেই বাবা-মায়েরা শিশুদের দিয়েছে এবং শিশুরা ক্রমাগত ডোপামিন নিঃসরণের কারণে কৃত্রিম আনন্দ উপভোগে অভ্যস্ত হয়ে বড় হয়েছে।
ডিজিটাল বন্ধুত্ব, ডিজিটাল ভালোবাসা, ডিজিটাল ব্রেকআপ, দ্রুত মানসিকভাবে ভেঙে পড়াটা তাই স্বাভাবিক। অনেক বছর ধরে এই জেনারেশন জি নিয়ে কাজ করে আমি যা উপলব্ধি করেছি, তা হলো এই প্রজন্মকে তাই জুজুর ভয় দেখানো যায় না, ভূতের ভয় দেখিয়ে বা পুলিশের ভয় দেখিয়ে চুপ করিয়ে রাখা যায় না। এই প্রজন্মের মূল্যবোধ খুব প্রখর। তারা সত্যের সন্ধান করে। এই প্রজন্ম প্রতিবাদীও। এরা মানবতার কথা, বর্ণবাদহীনতার কথাও কিন্তু সবচেয়ে বেশি বলে। আমাদের দেশের সাম্প্রতিক পটপরিবর্তনে এদের ভূমিকাই তো দারুণ এক প্রমাণ।
লেখক: একাধারে নেচারোপ্যাথিক ডাক্তার, পুষ্টিবিদ, কিনেজিওলজিস্ট, ট্রমা রিলিজ থেরাপিস্ট, অটিজম স্পেশালিস্ট, মাইন্ড সেট ট্রেইনার। তিনি কাজ করছেন লন্ডনের ১০, হারলে স্ট্রিট ক্লিনিকে এবং অনলাইনেও আছে তাঁর উপস্থিতি।
ছবি: হাল ফ্যাশন