মাত্র ৩০ মিনিট পানিতে ভিজিয়ে রেখে আম খেলে বাঁচবেন যেসব স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে
শেয়ার করুন
ফলো করুন

বাংলাদেশের মানুষের আবেগ আর স্বাদের সঙ্গে যেন জড়িয়ে আছে এই একটি ফল। ছোট থেকে বড়, সব বয়সী মানুষই এই মৌসুমজুড়ে আম খাওয়ার আনন্দে মেতে ওঠে। কাঁচা আমের টক-মিষ্টি আচার হোক কিংবা পাকা আমের রসালো মধুর স্বাদ, এটি সবার মন জয় করে নেয় মুহূর্তেই। কিন্তু এই স্বাদের আনন্দের মধ্যেই লুকিয়ে থাকতে পারে কিছু অদৃশ্য স্বাস্থ্যঝুঁকি, যদি না আমরা এ বিষয়ে একটু বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করি।
আমরা প্রায়ই দেখে থাকি, পুরোনো দিনের মানুষজন আম কেনার পর সেগুলো পানিতে ভিজিয়ে রাখেন অন্তত ৩০ মিনিট। অনেকেই এটাকে নিছক একটা পারিবারিক রীতি বা লোকাচার মনে করলেও, এর পেছনে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্যগত ব্যাখ্যা।

আম প্রকৃতিগতভাবে ‘উষ্ণ প্রকৃতির’ ফল
আম প্রকৃতিগতভাবে ‘উষ্ণ প্রকৃতির’ ফল

আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা থেকে শুরু করে আধুনিক পুষ্টিবিদ্যাও বলে যে আম খাওয়ার আগে পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখলে শরীরে এর অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর প্রভাব দেখা যায়। এই অভ্যাস শুধু শরীরকে ‘ঠান্ডা’ রাখতেই সাহায্য করে না, বরং আমে থাকা কিছু প্রাকৃতিক ক্ষতিকর উপাদান (যেমন: ফাইটিক অ্যাসিড, আঠালো রেজিন, কাঁচা আমের দুধের মতো রস) পানিতে ভিজিয়ে রাখার ফলে ধুয়ে যায়। এতে হজমের সমস্যা, গ্যাস বা অ্যালার্জির ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়।
চলুন এ বিষয়ে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক—

বিজ্ঞাপন

আম ভিজিয়ে রেখে খাওয়ার পেছনে আয়ুর্বেদের ব্যাখ্যা

আমে নানা ধরণে জীবাণু ও রাসায়নিক পদার্থ থাকতে পারে
আমে নানা ধরণে জীবাণু ও রাসায়নিক পদার্থ থাকতে পারে

প্রাচীন আয়ুর্বেদ শাস্ত্র অনুযায়ী, আম প্রকৃতিগতভাবে ‘উষ্ণ প্রকৃতির’ ফল। অর্থাৎ এটি খাওয়ার ফলে শরীরে কিছুটা উত্তাপ তৈরি হয়, যা গ্রীষ্মকালে শরীরের জন্য অতিরিক্ত মনে হতে পারে। বিশেষ করে যাঁদের পেটে গ্যাস, অম্বল বা হজমের সমস্যা আছে, তাঁদের ক্ষেত্রে এই তাপীয় প্রভাব আরও মারাত্মক হতে পারে। এ কারণে বলা হয়, আম খাওয়ার আগে অন্তত ২০ থেকে ৩০ মিনিট পানিতে ভিজিয়ে রাখা উচিত। এতে আমের উষ্ণতা কিছুটা প্রশমিত হয় এবং আমাদের শরীর ‘শীতল’ হয়ে ওঠে। শুধু তাই নয়, এই প্রক্রিয়ায় আম আরও বেশি রসালো ও কোমল হয়, যা আমাদের খাওয়ার সময় বাড়তি তৃপ্তি যোগ করে।

বিজ্ঞাপন

অ্যান্টি-নিউট্রিয়েন্ট ও রাসায়নিক দূষণ থেকে মুক্তি

গাছ থেকে সদ্য পাড়া আমের কাণ্ডে থাকা সাদা রস বা আঠার মধ্যে থাকে একধরনের অ্যান্টি-নিউট্রিয়েন্ট, যার নাম ফাইটিক অ্যাসিড। এই পদার্থ শরীরের জন্য খুব উপকারী নয়, বরং অনেক সময় এটি আমাদের পেটের গন্ডগোল, গলা চুলকানো, অস্বস্তিকর অ্যালার্জি কিংবা হজমের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে যাঁদের হজমের সমস্যা আছে বা গলা সংবেদনশীল, তাঁদের জন্য এটা অনেকটা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।

শুধু ধুয়ে নিলে সব ময়লা দুর হয় না
শুধু ধুয়ে নিলে সব ময়লা দুর হয় না

এই আমকে যদি সরাসরি খাওয়া হয়, তবে এই ফাইটিক অ্যাসিড ও অন্যান্য আঠালো পদার্থ সরাসরি শরীরে প্রবেশ করতে পারে, যা অনেক ক্ষেত্রে অস্বস্তি বা পেট ফাঁপা, গ্যাসের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। তাই আম ভিজিয়ে রাখার মাধ্যমে এই অ্যান্টি-নিউট্রিয়েন্টগুলোর প্রভাব অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। আরেকটি বড় সমস্যা হচ্ছে, বর্তমানে বাজারে পাওয়া বেশির ভাগ আমই অর্গানিক নয়, অর্থাৎ এগুলো চাষে ব্যবহৃত হয় কীটনাশক ও বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ। যদিও এসব রাসায়নিক পদার্থ আমাদের শরীরে সরাসরি ক্ষতি করতে পারে। কিন্তু আম ভিজিয়ে রাখার মাধ্যমে অনেকাংশেই এই রাসায়নিক পদার্থগুলো ধুয়ে ফেলে সেই ক্ষতিটা কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব। এতে করে আপনার শরীরে বিষক্রিয়ার ঝুঁকিও কমে যায়।

পাচনে সহায়ক ও খেতে লাগে আরও সুস্বাদু

আমের মিষ্টি স্বাদ ও এর রসালো গঠন আমাদের অনেকেরই প্রিয়। কিন্তু পানিতে ভিজিয়ে রাখা আম খেলে কেবল এর স্বাদই বাড়ে না, বরং তা আমাদের শরীরের জন্যও হয়ে ওঠে অনেক বেশি উপকারী। অনেকেই বলেন, ভিজিয়ে রাখা আম খেতে আরও নরম, শীতল ও রসালো লাগে। এই নরমভাব আমকে সহজপাচ্য করে তোলে, বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের জন্য, যাঁদের দাঁত ও হজমশক্তি তুলনামূলকভাবে দুর্বল থাকে। শুধু তাই নয়, গরমের দিনে আমাদের শরীরের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা অনেক সময় বেড়ে যায়, যা থেকে ক্লান্তি, মাথাব্যথা, এমনকি হিট স্ট্রোক পর্যন্ত হতে পারে। ভিজিয়ে রাখা আম শরীরকে প্রাকৃতিকভাবে ঠান্ডা রাখতে সাহায্য করে, কারণ এতে জমে থাকা উত্তেজক বা অতিরিক্ত ‘উষ্ণ’ প্রভাব অনেকাংশে প্রশমিত হয়ে যায়।

আম পানিতে ভিজিয়ে রেখে খেলে উপকার পাওয়া যায়
আম পানিতে ভিজিয়ে রেখে খেলে উপকার পাওয়া যায়

এ কারণে অনেকেই মনে করেন, এই প্রক্রিয়া আমকে শুধু সুস্বাদু নয়, বরং ‘শরীরবান্ধব’ও করে তোলে। যাঁরা পেটের সমস্যায় ভোগেন, যেমন ফোলা ভাব, গ্যাস, বদহজম, অ্যাসিডিটি ইত্যাদি, তাঁদের জন্য পানিতে ভিজিয়ে রাখা আম খাওয়া বিশেষভাবে উপকারী। এভাবে খেলে আম হালকা ও কোমল হয়ে যায়, ফলে তা হজমপ্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করে না এবং পরিপাকতন্ত্রকেও আরাম দেয়। বিশেষ করে ইফতারের পর বা দুপুরের খাবারের পর ঠান্ডা ভেজানো আম খেলে পেটও ঠান্ডা থাকে, খাবারের পর ভারও লাগে না। সুতরাং আমের মৌসুমে যদি আপনি সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর উপায়ে আম উপভোগ করতে চান, তবে পানিতে ভিজিয়ে রাখার অভ্যাসটি আজই করে ফেলুন।

আরও কিছু বাড়তি উপকার

আম পানিতে ভিজিয়ে রাখলে শুধু শরীরের ভেতরের উপকারই হয় না, বরং তা আমাদের শরীরে বাইরের দিক থেকেও এনে দেয় বাড়তি নিরাপত্তা ও সতেজতা। বাজার থেকে আনা আমের গায়ে  ধুলাবালি, মাটি, কীটপতঙ্গের বর্জ্য বা রাসায়নিক পদার্থ স্প্রে করা থাকে, যেগুলো সরাসরি ধোয়ার মাধ্যমে সব সময় পুরোপুরি দূর করা সম্ভব হয় না। তবে পরিষ্কার পানিতে অন্তত ২০ থেকে ৩০ মিনিট ভিজিয়ে রাখলে এগুলোর অনেকটাই স্বাভাবিকভাবে ধুয়ে যায়।

পরিষ্কার পানিতে অন্তত ২০ থেকে ৩০ মিনিট ভিজিয়ে রাখলে অনেক ময়লা ও জীবাণু ধুয়ে যায়
পরিষ্কার পানিতে অন্তত ২০ থেকে ৩০ মিনিট ভিজিয়ে রাখলে অনেক ময়লা ও জীবাণু ধুয়ে যায়

এ ছাড়া অনেক সময় ফলকে টাটকা রাখার জন্য কিছু অসাধু বিক্রেতা ফরমালিনজাতীয় রাসায়নিক ব্যবহার করেন, যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। আম ভিজিয়ে রাখলে এসব রাসায়নিকের প্রভাব কিছুটা হলেও হ্রাস পায়। এতে করে আম খাওয়ার ঝুঁকি কিছুটা কমে আসে। পাশাপাশি, পানিতে ভিজিয়ে রাখা আম যখন ফ্রিজে রাখা হয়, তখন তা আরও ঠান্ডা, রসালো ও সতেজ হয়ে ওঠে। গরমের দিনে এমন ঠান্ডা আম খাওয়ার মজাই আলাদা! এতে একদিকে যেমন আমাদের শরীর ঠান্ডা থাকে, অন্যদিকে গ্রীষ্মের ক্লান্তিও অনেকটাই কমে আসে।

ফলের রাজা আম শুধু স্বাদে নয়, পুষ্টিতেও অনন্য। তবে একটু অসতর্কতা বা অবহেলার কারণে এই সুস্বাদু ফলই হয়ে উঠতে পারে স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ। তাই আম খাওয়ার আগে পানিতে ভিজিয়ে রাখার এই প্রাচীন অভ্যাস আজও সমানভাবে জরুরি ও বৈজ্ঞানিকভাবে সমর্থিত। এতে যেমন শরীর থাকে নিরাপদ, তেমনি বাড়ে ফলের স্বাদ ও সতেজতা। তাই এবারের গরমে আম উপভোগ করার আগে মাত্র আধা ঘণ্টা সময় দিয়ে আম ভিজিয়ে রাখুন ও নিশ্চিন্তে এই ফলের স্বাদ উপভোগ করুন।

তথ্যসূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া

ছবি: পেকজেলসডটকম

প্রকাশ: ১১ জুন ২০২৫, ১০: ০৩
বিজ্ঞাপন