এই সপ্তাহে আমার মন খুব ভালো ছিল না। আমার একসময়ের সহকর্মীর ২৫ বছরের ছেলে কাপ্তাইয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে পানিতে ডুবে মারা গেছে। আমরা সবাই স্তব্ধ-হতবিহ্বল। বলা হয়, পৃথিবীতে সবচেয়ে কষ্টের অভিজ্ঞতা হলো পিতার কাঁধে পুত্রের লাশ। সবচেয়ে কঠিন বাস্তবতা হলেও প্রায়ই কারও না কারও জীবনে এই দুর্বিষহ ঘটনা ঘটে যায়।
সন্তান হারানোর দুঃখ কেবল একজন মা–বাবার জন্য নয়, এটি একটি কঠিন অভিজ্ঞতা, যা পুরো পরিবারকে, বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী তথা সমাজকেও বিপর্যস্ত করে তোলে। প্রিয়জনের মৃত্যু মানসিক ও শারীরিকভাবে মানুষকে গভীরভাবে নাড়া দিয়ে যায়। আজকের এই লেখা প্রিয়জন হারানোর শোকের কারণে দীর্ঘমেয়াদি ট্রমায় আক্রান্ত হয় বাবা-মায়েদের নিয়ে। আসলে এই কঠিন সময়ে তাঁদের মস্তিষ্ক ও পরিচালনায় সংঘটিত পরিবর্তনগুলো আসে, তা নিয়ে আলোচনা করব।
পিটিএসডি নিয়ে আগে আলোচনা করেছি। এটা আসলে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার। এটি একটি মানসিক অস্থিতিশীলতা বা অবস্থা, যা সাধারণত একটি মারাত্মক বা ভয়াবহ অভিজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত হয়। প্রিয়জন হারানোর পর এর লক্ষণগুলো হলো দুঃস্বপ্ন ও উদ্বেগ, আবেগের সংকোচন, স্মৃতির আকুলতা, অবসাদ ও উদাসীনতা, রাগ, অসহায়ত্ব, দুশ্চিন্তা, আত্মহত্যার প্রবণতা।
প্রিয়জন হারানোর পর শরীরে স্ট্রেস হরমোন কোর্টিসলের নিঃসরণ বেড়ে যায়। ডোপামিন ও সেরোটোনিনের মাত্রা কমে যায়। ফলে মা–বাবা বারবার একই বিষয় নিয়ে ভাবতে থাকেন। মস্তিষ্কের এমিগডালা অংশটি আবেগের প্রক্রিয়াকরণের জন্য দায়ী। সন্তান হারানো মা–বাবার শোকের ফলে এমিগডালার সক্রিয়তা বেড়ে যায়, যা মানসিক চাপ ও উদ্বেগ বৃদ্ধি করে। এতে আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। মানসিক টানাপোড়েনের কারণে অনেকেই মনোযোগ ধরে রাখতে পারেন না, যা দৈনন্দিন জীবনের কাজকর্মে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
আমার আরেক পরিচিত মা–বাবা চেনা, যাঁদের শিশুসন্তান জন্মের ছয় মাস পরেই ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত হয়। শেষ হয়ে যায় তাঁদের জীবনের আনন্দ। দীর্ঘ ছয় বছর ধরে তাঁরা শিশুটিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন। সন্তান হারানোর ভয়, ব্যয়বহুল চিকিৎসা টেনে নিতে গিয়ে ধীরে ধীরে নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলেন তাঁরা। তবু শেষ রক্ষা হয়নি। বাঁচাতে পারেননি সন্তানকে। হয়ে পড়েছেন মানসিক রোগী।
কিছু মা–বাবা আছেন, যাঁদের সন্তান জন্মের পর থেকেই দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয় এবং বদলে যায় মা–বাবার পথচলার স্বাভাবিক গতিপথ। যখন একটি শিশু জন্ম থেকে অসুস্থ হয় এবং দীর্ঘ সময় ধরে গুরুতর সমস্যায় ভোগে, তখন মা–বাবাকে এই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলতে হয়। এই অবস্থায় শোকপ্রক্রিয়া শুরু হয় একেবারে শুরু থেকেই, কারণ মা–বাবা তাঁদের শিশুর ক্ষতির আশঙ্কা আগে থেকেই অনুভব করেন। তাঁরা প্রতি মুহূর্তে সদা সতর্ক হয়ে থাকেন, যা মানসিক ও শারীরিক চাপের সৃষ্টি করে। দীর্ঘমেয়াদি অসুখের শিকার শিশুদের বাবা-মায়েরা অনেক সময় নিজেদের আবেগের নিয়ন্ত্রণ রাখতে শিখে যান এবং মানসিকভাবে শক্তিশালী হওয়ার চেষ্টা করেন। তাঁরা সন্তান হারানোর পর পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার কৌশল আয়ত্ত করতে চেষ্টা করেন।
অন্যদিকে আকস্মিক মৃত্যুর ঘটনা বাবা-মায়েদের জন্য সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত হয়ে আসে। এটি তাঁদের জন্য একটি বিস্ফোরক ঘটনা। একমুহূর্তে সবকিছু শেষ হয়ে যায়—এ রকম অনুভূতি তাঁদের মধ্যে তৈরি হয়। এই অভিজ্ঞতা শোকের প্রক্রিয়াকে দ্রুততর করবে, এক সেকেন্ডের মধ্যে তাঁদের জীবন উথালপাতাল হয়ে যায়। মা–বাবা বিষয়টিকে বোঝার চেষ্টা করেন, কিন্তু বুঝতে পারেন না, মানার চেষ্টা করেন; কিন্তু মানতে পারেন না। কোনো যুক্তিতর্ক কোনো কিছু কাজে আসে না। মা–বাবা সম্পূর্ণ সময় সংগ্রাম করে যান। অনেক সময় তাঁরা নিজেদের আঘাত করেন বা আত্মহত্যার চেষ্টা করেন।
প্রশিক্ষণ নেওয়ার সময় আমি গ্রিভেন্স ও লসের ওপর আলাদাভাবে ট্রেনিং নিয়েছিলাম। যে কারণে আমি এ ধরনের রোগীদের নিয়ে কাজ করে থাকি। আমার যাঁরা শিক্ষক ও মেন্টর ছিলেন, তাঁরা শুধুই এই বিষয় নিয়ে কাজ করেন। শোকগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সাহায্য করেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে দেখেছি তাঁদের কাজ করার ধরন বাংলাদেশি মা–বাবা এবং পরিবারের ওপর কাজ করে না।
ক্যানসারে ৩৩ বছরের সন্তান হারানো এক বাংলাদেশি মা সেশনের সময় চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন যে ‘ওরা বলে আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছে। কী আর করবেন, এ ধরনের কথা আমার কলিজা ছিঁড়ে দেয়।’ যাঁরা সন্তানহারা মা–বাবাকে সান্ত্বনা দিতে আসেন, তাঁরা নিজের অজান্তেই এমন কিছু কথা বলেন, যা মা–বাবাকে আরও বেশি কষ্ট দেয়। তাই মা–বাবাকে স্পেস দিতে হবে এবং কোনো ধরনের উপদেশ দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
কারণ, তাঁরা যা হারিয়েছেন, তা যে কোনো যুক্তিতর্কের ঊর্ধ্বে। আপনার কোনো শব্দের চেয়ে শুধু আপনার নিস্তব্ধতা ওই মা–বাবাকে বেশি সাহায্য করবে। কিছু কিছু সময় শব্দের চেয়ে নিঃশব্দ বেশি উপকার করে।
যেসব মা–বাবার আরও সন্তান থাকে, তারা অনন্যোপায় হয়ে কিছুটা হলেও সাংসারিক কাজকর্ম করতে থাকে। কিন্তু যাঁদের একটি বা দুটিমাত্র সন্তান, তাঁদের জন্য এটি খুবই কঠিন যাত্রা। তবু আমার অনুরোধ থাকবে, কোনো থেরাপিস্ট বা কাউন্সিলরের কাছে গিয়ে কথা বলুন, সাহায্য নিন। জীবন অনেক কঠিন খেলা খেলে ফেলেছে আপনার সঙ্গে, তবু চেষ্টা করুন যত দিন জীবনের ভেতর আছেন, জীবনকে আলিঙ্গন করে নিতে।
লেখক: একাধারে নেচারোপ্যাথিক ডাক্তার, পুষ্টিবিদ, কিনেজিওলজিস্ট, ট্রমা রিলিজ থেরাপিস্ট, অটিজম স্পেশালিস্ট, মাইন্ড সেট ট্রেইনার। তিনি কাজ করছেন লন্ডনের ১০, হারলে স্ট্রিট ক্লিনিক এবং অনলাইনেও আছে তাঁর উপস্থিতি।
ই–মেইল: [email protected]
ছবি: চ্যাটজিপিটি