প্রাচীন গ্রিস, রোম, মিসরে মুলা ছিল মানুষের অন্যতম প্রধান খাদ্য। গ্রিসে পিরামিড নির্মাণের শ্রমিকদের মজুরি হিসেবে পেঁয়াজ, রসুনের পাশাপাশি মুলাও দেওয়া হতো। পৃথিবীতে এত সুস্বাদু উপাদেয় সবজি থাকতে এই নিরস সবজিটাই কেন ঝোলাতে চায় সবাই, তা বোঝা আসলেই কঠিন।
মুলা অনেকে পছন্দ না করলেও মুলার কিন্তু রয়েছে দারুণ সব পদ। পূর্ণিমা ঠাকুরের ‘ঠাকুর বাড়ির রান্না’ আর কবিতা চৌধুরীর ‘রাজবাড়ির রান্না’ বইয়ে মুলা দিয়ে ঝোল, অম্বল, বাটা, কষা, রসা, ঝুরি, মুড়ি ভাজি, চচ্চড়ি, শুঁটকি কত রকম যে রান্নার রেসিপি রয়েছে , তা দেখলে ‘মুলাভীতি’ খানিকটা কমবে বৈকি।
প্রত্নতাত্ত্বিকেরা একেবারে আদি বুনো জাতের মুলার নমুনা পেয়েছেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। সে হিসেবে এই অঞ্চলকেই মুলার আদিভূমি বলা যেতে পারে। তবে ইতিহাসে প্রথম এর উল্লেখ পাওয়া যায় ৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকে গ্রিক ও রোমান কৃষিবিদেরা প্রথম ছোট, বড়, লম্বা, খাটো, গোল, পানসে, মিষ্টি ও ঝাল মুলা জাতের শ্রেণিবিন্যাস করেন।
প্রাচীনকাল থেকেই সারা বছরই চাষ হয় মুলার। এক মাস থেকে দুই বছর পর্যন্ত সময় লাগে মুলা সংগ্রহের উপযুক্ত হতে। তবে বেশি সময় মাটির নিচে রাখলে তিতা হয়ে যায়। সালাদ, রান্না বা শাক হিসেবে খাওয়া হয়। আবার তেলের জন্য মুলার একটি জাতের বীজও উৎপাদন করা হয়।
মুলার ব্যবহার নিয়ে বলতে গেলে অবধারিতভাবেই এসে যায় গ্রিসের প্রসঙ্গ। সেখানে মুলা শুধু খাওয়াই হতো না, কাউকে শাস্তি দেওয়ার জন্যও ব্যবহার করা হতো! ইংরেজিতে ‘রাফানিডোসিস’ নামের একটি শব্দ আছে। এ নিয়ে বিস্তারিত জানতে গুগল করে দেখতে পারেন।
প্রাচীন এথেন্সের রম্যনাট্যকার অ্যারিস্টোফেনিস তাঁর এক হাস্যরসাত্মক নাটকে রূপকার্থে এটি ব্যবহার করেন। সাধারণভাবে ভরা মজলিশে কাউকে অপমান করা বোঝাতেও মুলা ঝোলানোর কথা বলা হয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়। সে কারণেই হয়তো কালের পরিক্রমায় ‘মুলা ঝোলানো’ প্রবচনের আবির্ভাব।
মুলার পুষ্টিগুণ
৯০% ভাগ পানিসমৃদ্ধ মুলায় আছে অ্যাসকরবিক অ্যাসিড, ফলিক অ্যাসিড ও প্রচুর খনিজ ও ভিটামিন। এতে খুবই কম পরিমাণ আছে স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও কোলেস্টেরল। মুলায় আরও রয়েছে ছত্রাক ও ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার প্রয়োজনীয় উপকরণ। গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান আর খনিজে সমৃদ্ধ মুলায় আরও পাওয়া যায় পটাশিয়াম, ভিটামিন সি, ফোলেট, ফাইবার, ম্যাঙ্গানিজ, কপার, ম্যাগনেশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন বি৬, রিবোফ্লোভিন ও সোডিয়াম। ফলে বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে রয়েছে মুলার কার্যকর ভূমিকা।
রক্তের দূষণ পরিষ্কার করার দারুণ ক্ষমতা রয়েছে মুলার, যা আমাদের লিভার ও পাকস্থলীর সমস্ত দূষণ ও বর্জ্য পরিষ্কার করে থাকে। মুলা বিলিরুবিনের পরিমাণ কমিয়ে তাকে একটি গ্রহণযোগ্য মাত্রায় নিয়ে আসে, যা জন্ডিসের চিকিৎসার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। মুলা রক্তকণিকায় অক্সিজেনের সরবরাহ বাড়িয়ে তোলে। ফলে জন্ডিসের কারণে আমাদের শরীরের রক্তকণা ভেঙে যাওয়ার হার কমে যায়।
অর্শ রোগের প্রধান কারণ হচ্ছে কোষ্ঠকাঠিন্য। মুলায় খাবার হজম করার শক্তিশালী উপাদান আঁশ প্রচুর পরিমাণ থাকায় তা অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে এই রোগের আশঙ্কাকে নির্মূল করে । আর এতে যে পানি রয়েছে, তা পরিপাকক্রিয়াকে গতিশীল করে।
ওজন হ্রাস
আজকাল সবাই ওজন কমাতে চান। ওজন কমাতে বিভিন্ন রকমের খাবার খান বা ডায়েট করেন। মুলাও কিন্তু ওজন কমাতে সহায়তা করে। মুলায় ক্যালরির পরিমাণ খুব কম। এতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ আঁশ, পানি ও হজমযোগ্য শর্করা। এটা ডায়েটিংয়ের জন্য অত্যন্ত উপকারী, কারণ মুলায় ক্ষুধা নিবারণ হয়। মুলা কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে শরীরের হজমশক্তি বাড়ায় ও ওজন কমায়।
গবেষণায় দেখা গেছে, ক্যানসার প্রতিরোধে মুলা খুবই কার্যকর। এতে রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণ ভিটামিন সি, অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট। শরীরের দূষণ দূর করার ক্ষমতাসম্পন্ন মুলা মুখগহ্বর, পাকস্থলী, বৃহদন্ত্র, কিডনি ও কোলন ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য অত্যন্ত উপকারী। ক্যানসারের কোষ নির্মূল করতে এর অবদান রয়েছে।
শ্বেতরোগের চিকিৎসায় মুলা অত্যন্ত কার্যকর। আয়ুর্বেদিক শাস্ত্র অনুযায়ী অ্যান্টিকারসিনোজিনিক উপাদানসমৃদ্ধ মুলার বীজ আদার রস ও ভিনেগারে ভিজিয়ে আক্রান্ত জায়গায় লাগালে দারুণ কাজ করে। এ ছাড়া কাঁচা মুলা চিবিয়ে খেলেও ভালো কাজ করে।
প্রচুর পরিমাণ খনিজ ও ভিটামিনে পূর্ণ মুলা ত্বকের বিভিন্ন সমস্যায় অত্যন্ত উপকারী। বিভিন্ন ক্ষত সারানো ছাড়া কাঁচা মুলা ফেসপ্যাক ও ক্লিনজার হিসেবেও দারুণ উপকারী।
মৌমাছি কামড়ালে অথবা যেকোনো পোকামাকড় কামড় দিলে মুলার রস লাগিয়ে দেবেন। সঙ্গে সঙ্গে ফোলা ও ব্যথা কমে যাবে।
কিডনির অকার্যকারিতা প্রতিরোধে মুলা অত্যন্ত উপকারী। এতে রয়েছে খুব দ্রুত যেকোনো সংক্রমণ দূর করার আশ্চর্য ক্ষমতা। মুলায় থাকে প্রচুর পানি, যা কিডনিতে গিয়ে কিডনিকে ডিটক্সিফাই করে।
আমাদের শ্বাসনালি বিভিন্ন কারণে সংক্রমিত হয়। অ্যালার্জি, ইনফেকশন, ঠান্ডা এ রকম সমস্যা নির্মূল করাসহ বিভিন্ন সংক্রমণ প্রতিরোধ করতেও সাহায্য করে মুলা।
যকৃৎ ও পিত্তথলির চিকিৎসায় মুলা অত্যন্ত কার্যকর। মুলা বিলিরুবিন, পিত্তরস, এনজাইম ও অ্যাসিড উৎপাদন ও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
এ ছাড়া নিশ্বাসের দুর্গন্ধ, ক্ষুধা বৃদ্ধি, হুপিং কাশি, গলায় ক্ষত, অ্যাসিডিটি, বমিভাব, মূত্রনালির প্রদাহ ও মাথাব্যথার জন্য মুলা অত্যন্ত উপকারী। কাঁচা মুলা আলসার ও বিভিন্ন সংক্রমণ থেকেও রক্ষা করে।
এত সব জানার পর আসছে শীতে মুলার মৌসুমে মুলা রাখতে পারেন খাদ্যতালিকায়। মুলার গন্ধ নিয়ে যাঁরা অস্বস্তিতে থাকেন, তাঁদের জন্য টিপস হচ্ছে, মুলা সামান্য ভাপিয়ে পানি ঝরিয়ে রান্না করলেই গন্ধটা চলে যাবে।
ছবি: পেকজেলসডটকম