অনেক অনেক ধন্যবাদ আর ভালোবাসা সবাইকে। গেল পর্ব লেখা প্রকাশের পর অনেকের ই–মেইল পেয়েছি। খুব ভালো লেগেছে। কারণ, এই ২০২৫–এ এসে এত অস্থিরতার মধ্যেও লেখার ভক্তদের কাছ থেকে ই–মেইল পাওয়া অনেক বড় পাওয়া বলে মনে করি। সফলতা এবং এর সঙ্গে নিজের সম্পর্ক নিয়ে আরও বিশদভাবে জানতে চেয়েছেন আপনারা। আজ আমি সফলতা এবং এতে আপনার ভূমিকা এবং কেবল আপনারই ভূমিকা নিয়ে লিখব।
আমাদের শিশুবেলা থেকেই সফল হওয়ার স্বপ্ন দেখানো হয়। আমরা স্কুলে ভর্তি হই জীবনে কিছু হওয়ার আশায়। স্কুলে শেখানো হয় যে জীবনে সফল হতে হবে। সে জন্য ভাষা, ব্যাকরণ, গণিত, বিজ্ঞান, ভূগোলসহ অনেক কিছুই শেখানো হয়। কিন্তু সফল হওয়ার উপায় শেখানো হয় না।
কেবলই বলা হয় যে কঠিন পরিশ্রম করলে তবেই সফলতা মিলবে। আসলে আপনি জীবনে সফল হবেন কি না, কোন বিষয়ে কতটুকু সফল হবেন, তা নির্ভর করে আপনার মানসিকতার ওপর। মানুষের সফলতার পঁচানব্বই ভাগ নির্ভর করে তার আত্মবিশ্বাসের ওপর। সে নিজেকে নিজে কীভাবে দেখে, নিজের ওপর কতটা নির্ভর করে, তার ওপর। বাকি পাঁচ ভাগ নির্ভর করে পরিশ্রমের ওপর। আপনার সফলতা আরও নির্ভর করে আপনার চিন্তার ওপর। চিন্তাই পরিণত হয় বস্তুতে।
পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত কোনো কিছুরই হঠাৎ করে উদয় হয়নি। সবার আগে তা এসেছে ব্যক্তির চিন্তায়। কেউ যদি কোম্পানির মালিক হতে চায়, সেটি নিয়ে সবার আগে ভেবেছে, তারপর সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে সে এর যোগ্য কি না। যে নিজেকে যোগ্য ভেবেছে, সে ক্রমাগত চেষ্টা করে গেছে বলেই তার পক্ষে কোম্পানির মালিক হওয়া সম্ভব হয়েছে। একই অফিসে আরেকজন হয়তো ভেবেছে, আমি পিয়ন হওয়ার যোগ্যতা রাখি। সে সেভাবেই চিন্তা করেছে এবং নিজেকে অফিসের পিয়ন হিসেবে আবিষ্কার করেছে।
আমাদের জীবনে যখন খুব কঠিন সময় আসে, আমরা তখন অনেকেই হাল ছেড়ে দিই। নিজেকে দুর্বল ভাবি বা অনেকেই অন্যকে দোষারোপও করে। অনেকের মতো, আমার জীবনেও খুব কঠিন সময় এসেছিল; সে সময় আমাকে বাসা থেকে বের করে দেওয়া হয়। আমি আমার অটিস্টিক সন্তানকে নিয়ে দেড় বছর রিফিউজি হোস্টেলে ছিলাম। আমার নিজের কেনা বাড়ি, ব্যবসা, চাকরি সবকিছু হারিয়েছিলাম। বিনিময়ে আমি সারাক্ষণ আমার স্বামী এবং তাঁর তখনকার বান্ধবীকে বারবার দায়ী করেছি।
আমার কেবলই মনে হচ্ছিল, সবকিছু ওদের দোষ। ওরা আমার কাছ থেকে সবকিছু ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। এ সময় আমি বারবার নিজেকে শেষ করে দেওয়ারও চেষ্টা করেছি।
এরপর একদিন বা একরাত আসে যাকে আমি বলি ওয়েক আপ কল। আমি জানতে পারি যে আমাদের ভালো–মন্দ সবকিছুর জন্য আসলে আমরাই দায়ী। আমি নিজেকে ভিন্নভাবে দেখার চেষ্টা করি। এরপর আমি প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করি বিশ্ববিখ্যাত মাইন্ডসেট ট্রেইনারদের কাছ থেকে। লুইস হে, আমান্ডা রবার্টস, বব প্রোক্টর, লিসা নিকোলাস, জন আসারাফ, জ্যাক কনফিল্ড, জোডি স্পেন্সার, টনি রবিনসন, ডেন গ্রেসিয়েসি, তাসা চেন, ইব্রাহিম হিক্স, ডরিন ভারচু, জো ভাইটালিটি, কার্ল ডসনের মতো মেন্টরদের কাছ থেকে।
আমি প্রচুর কাজ করি নিজের অবচেতন মনের ওপর। বুঝতে পারি যে আমাদের মনোজগৎ গঠিত হয়ে যায় পাঁচ বছর বয়সের ভেতরই। তারপর সারা জীবন আমরা আমাদের অবচেতন মনে তৈরি প্রোগ্রামের ঘানি টানি। বেশির ভাগ সময় দেখা যায় যে পরিবারের সন্তানদের সঙ্গে তাদের মা–বাবা, নানা-নানি বা দাদা–দাদির জীবনের অনেক মিল পাওয়া যায়। এর কারণ হলো, শিশুরা তাদের প্রিয় মানুষদের জীবনের ব্লুপ্রিট তাদের নিজেদের মতো করে সাজিয়ে নেয়। এ কারণে দেখা যায়, কেউ বারবার হোঁচট খাচ্ছে। কেউ বারবার ব্যবসায় হেরে যাচ্ছে; আবার কেউ জীবনে খুব সহজেই জিতে যায় বা যেকোনো কাজেই সফল হয়।
আমার ক্ষেত্রে কী হয়েছিল, তা বলি। আমি জন্মানোর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আগুন লেগে সবকিছু পুড়ে গিয়েছিল। আগুন কে লাগিয়েছিল বা কোথা থেকে লেগেছিল, সে প্রশ্ন করার আগেই গ্রামের মানুষ মেনে নিয়েছিল, যেহেতু আমি জন্মানোর পর আগুন লেগেছে, তাই আমি একটি অপয়া শিশু। আমিও নিজেকে সেটাই মেনে বড় হচ্ছিলাম। পৃথিবীর যেখানে যত দুর্ঘটনা ঘটত, আমি নিজেকে তার জন্য দায়ী মনে করতাম।
এ রকম অনেক শিশু এবং অনেক মানুষ আপনারা আশপাশে দেখবেন যাদের সবকিছুর জন্য দায়ী করা হয় এবং তারা তা মেনে নেয়। ফলে আমাদের মতো শিশু ও মানুষেরা নিজেদের গুটিয়ে রাখে। তাদের নিজেদের সঙ্গে ভালো কিছু হবে, তা আশা করতে ভয় পায়। কারণ, নিজেকে তারা ভালো কিছুর দাবিদার বলে ভাবতেই পারে না। ফলে নিজেকে বারবার প্রমাণ করার চেষ্টা চলতে থাকে।
অন্যদের কাছে নিজেকে ভালো প্রমাণ করার জন্য মরিয়া থাকে এ ধরনের মানুষ। আসলে তারা নিজের কাছেই নিজেকে বারবার প্রমাণ করতে চায়। এতে করে তারা এমন সব মানুষ ও ঘটনাকে নিজের দিকে আকর্ষণ করতে থাকে, যারা এসে বারবার তাদের কঠিন সময় দেবে, তাদের সবকিছুর জন্য দায়ী করবে এবং তাদের নিজেকে বারবার প্রমাণ করতে হবে। সেটা সম্পূর্ণই নিজের সঙ্গে, নিজের ভেতর নিজের লড়াই। কিন্তু বাহ্যিকভাবে মনে হয়, অন্য কেউ আপনার ক্ষতি করছে। আসলে আপনি নিজেই নিজের নেতিবাচক ইনার প্রোগ্রামিং থেকে বের হতে পারছেন না।
আমি আমার অসংখ্য ট্রমার ওপর কাজ করেছি এবং নিজের ইনার প্রোগ্রাম বদলে ফেলেছি। নিজেকে আমি আর কোনো কিছুর জন্য দোষী মনে করি না। আমার সাবেক স্বামীর সেই বান্ধবী কোথায় আছেন জানি না, কিন্তু মনে হয় তিনি আমার জীবনের শিক্ষক হয়ে এসেছিলেন। কারণ, আমার নিজেকে নিজে চেনা ও জানার লড়াইটা শুরু হয়েছিল আমার সংসার হারানোর পর। নিজের সঙ্গে নিজের সম্পর্ককে নতুনভাবে তৈরি করার জন্য নিজেকে সুযোগ করে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। প্রতিদিন আমি ছয় ঘণ্টা নিজের মানসিক গঠনের ওপর কাজ করি। আপনিও অন্যকে ও নিজেকে দোষারোপ না করে, নিজের নেতিবাচক ইনার প্রোগ্রামকে বদলে নিজেকে সফলতার পথে নিয়ে আসার চেষ্টা করুন। দেখবেন, আপনার পৃথিবীটাই বদলে গেছে, সুন্দর হয়ে গেছে।
লেখক: একাধারে নেচারোপ্যাথিক ডাক্তার, পুষ্টিবিদ, কিনেজিওলজিস্ট, ট্রমা রিলিজ থেরাপিস্ট, অটিজম স্পেশালিস্ট, মাইন্ড সেট ট্রেইনার। তিনি কাজ করছেন লন্ডনের ১০, হারলে স্ট্রিট ক্লিনিক এবং অনলাইনেও আছে তাঁর উপস্থিতি।
ই–মেইল: [email protected]
ছবি: পেকজেলসডটকম