বাংলাদেশে সয়াবিন তেলে ট্রান্সফ্যাটের পরিমাণ বিভিন্ন কারণের ওপর নির্ভর করে, যেমন তেলের উৎপাদনের প্রক্রিয়া, পরিশোধনের পদ্ধতি ও ব্র্যান্ড। বাংলাদেশের বাজারে প্রচলিত সয়াবিন তেলে ট্রান্সফ্যাটের উপস্থিতি নিয়ে উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে।
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত একটি গবেষণায় (ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশের পরীক্ষাগারে পরিচালিত ও ফুড কেমিস্ট্রি অ্যাডভান্স (Food Chemistry Advances) জার্নালে প্রকাশিত) দেখা গেছে যে বোতলজাত সয়াবিন তেলের নমুনার প্রায় ৬৭ শতাংশ (১৮টির মধ্যে ১২টি) ও খোলা সয়াবিন তেলের নমুনার প্রায় ২৫ শতাংশে সহনীয় মাত্রার (২ শতাংশ) চেয়ে বেশি ট্রান্সফ্যাট পাওয়া গেছে। গড়ে এই নমুনাগুলোয় ট্রান্সফ্যাটের পরিমাণ সহনীয় মাত্রার ২ থেকে ৪ গুণ বেশি ছিল অর্থাৎ ৪ থেকে ৮ শতাংশ পর্যন্ত। কিছু ক্ষেত্রে এটি আরও বেশি হতে পারে।
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (BFSA) ২০২১ সালে ‘খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্সফ্যাটি অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণ প্রবিধানমালা’ জারি করে, যা ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয়। এতে খাদ্যে ট্রান্সফ্যাটের সর্বোচ্চ মাত্রা ২ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে গবেষণায় দেখা গেছে, অনেক সয়াবিন তেল এই মান মেনে চলছে না।
ট্রান্সফ্যাট আপনার শরীরে কী ক্ষতি করতে পারে, এটা জানলে আপনি হয়তো সতর্ক থাকতে পারবেন। এই লেখা সতর্ক করার জন্যই।
ট্রান্সফ্যাট শরীরে খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় এবং ভালো কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে দেয়। এটি ধমনিতে প্লাক (Atherosclerosis) তৈরির ঝুঁকি বাড়ায়, যা হৃদ্রোগ, হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের কারণ হতে পারে।
বৈজ্ঞানিক প্রমাণ: আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন (AHA) ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) জানিয়েছে যে প্রতিদিন মোট ক্যালরির ১ শতাংশ ট্রান্সফ্যাট গ্রহণও হৃদ্রোগের ঝুঁকি ২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়াতে পারে।
ট্রান্সফ্যাট শরীরে প্রদাহজনক প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করে, যা বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি রোগের কারণ হতে পারে, যেমন ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিস ও ক্যানসার।
বৈজ্ঞানিক প্রমাণ: ২০০৬ সালে ‘Journal of Nutrition’–এ প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে ট্রান্সফ্যাট গ্রহণের সঙ্গে সিআরপি নামক প্রদাহ সূচকের মাত্রা বৃদ্ধি পায়।
ট্রান্সফ্যাট ইনসুলিন সংবেদনশীলতা কমিয়ে দেয়, যা রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সমস্যা সৃষ্টি করে। এটি টাইপ–২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়।
বৈজ্ঞানিক প্রমাণ: ‘American Journal of Clinical Nutrition’ (২০০১)–এর একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে যাঁরা নিয়মিত ট্রান্সফ্যাট–সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করেন, তাঁদের ডায়াবেটিসের ঝুঁকি ৩১ শতাংশ বেশি।
ট্রান্সফ্যাট লিভারে ফ্যাট জমতে সাহায্য করে, যা নন–অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজের দিকে নিয়ে যায়। এটি দীর্ঘ মেয়াদে লিভারের কার্যক্ষমতা নষ্ট করতে পারে।
বৈজ্ঞানিক প্রমাণ: ২০১৭ সালে ‘Hepatology’ জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় ট্রান্সফ্যাট ও লিভারে ফ্যাট জমার সরাসরি সম্পর্ক পাওয়া গেছে।
ট্রান্সফ্যাট শরীরে বিপাকপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে এবং চর্বি জমার প্রবণতা বাড়ায়, বিশেষ করে পেটের চারপাশে (Visceral Fat), যা স্থূলতা ও বিপাকীয় সমস্যার কারণ।
বৈজ্ঞানিক প্রমাণ: ২০০৭ সালে ‘Obesity’ জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে ট্রান্সফ্যাট গ্রহণকারী প্রাণীদের ওজন বৃদ্ধি অন্যান্য চর্বির তুলনায় বেশি হয়।
গবেষণায় ট্রান্সফ্যাট গ্রহণের সঙ্গে স্তন ক্যানসার ও প্রোস্টেট ক্যানসারের ঝুঁকির সম্পর্ক পাওয়া গেছে। এটি প্রদাহ ও অক্সিডেটিভ স্ট্রেস বৃদ্ধির কারণে ঘটে।
তথ্য: ‘European Journal of Cancer Prevention’ (২০০৮)–এর একটি গবেষণায় বিস্তারিত দেওয়া আছে।
কৃত্রিম: মার্জারিন, শর্টেনিং, প্রক্রিয়াজাত খাবার (যেমন চিপস, কেক, বিস্কুট, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই) ও ফাস্ট ফুড।
প্রাকৃতিক: মাংস ও দুগ্ধজাত পণ্যে অল্প পরিমাণে (তবে এর প্রভাব কৃত্রিম ট্রান্সফ্যাটের মতো তীব্র নয়)।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)–এর স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী, দৈনিক মোট ক্যালরির ১ শতাংশের কম ট্রান্সফ্যাট গ্রহণ করা উচিত এবং সম্ভব হলে সম্পূর্ণ বর্জন করা উচিত। ২০১৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘REPLACE’ নামে একটি উদ্যোগ চালু করে, যার লক্ষ্য ২০২৩ সালের মধ্যে খাদ্য সরবরাহ থেকে কৃত্রিম ট্রান্সফ্যাট নির্মূল করা। অনেক দেশ (যেমন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত) ইতিমধ্যে এটি নিষিদ্ধ করেছে।
সয়াবিন তেল পরিশোধনের সময় উচ্চ তাপমাত্রা ব্যবহার করা হলে ট্রান্সফ্যাট তৈরি হয়। বাংলাদেশে অনেক কারখানায় আধুনিক প্রযুক্তি থাকলেও প্রক্রিয়ার ত্রুটির কারণে এটি ঘটতে পারে।
আংশিক হাইড্রোজেনেশন: যদি তেল আংশিকভাবে হাইড্রোজেনেটেড হয়, তবে ট্রান্সফ্যাটের পরিমাণ বাড়ে।
• খোলা সয়াবিন তেলে ট্রান্সফ্যাটের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম (গড়ে ২ শতাংশ বা তার কাছাকাছি)। কারণ, এগুলো সাধারণত কম প্রক্রিয়াজাত হয়।
• বোতলজাত তেলে বেশি (৪ থেকে ৮ শতাংশ বা তার বেশি)। কারণ, এগুলো বেশি পরিশোধিত এবং দীর্ঘ সংরক্ষণের জন্য প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়।
বাংলাদেশে বোতলজাত সয়াবিন তেলে ট্রান্সফ্যাটের পরিমাণ নিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে এবং ফলাফল থেকে জানা গেছে যে অনেক ক্ষেত্রে এটি ২ শতাংশের বেশি, গড়ে ৪ থেকে ৮ শতাংশ পর্যন্ত। তবে নিয়মিত ও ব্যাপক পরীক্ষার মাধ্যমে এই তথ্য আরও নিশ্চিত করা প্রয়োজন। ভোক্তাদের সচেতনতা বাড়াতে ও নীতি কার্যকর করতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ আরও জোরদার করা দরকার।
তাই এটি এড়িয়ে চলা এবং প্রাকৃতিক ও স্বাস্থ্যকর তেল, যেমন অলিভ ওয়েল, নারকেল তেল ইত্যাদি ব্যবহার করা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
লেখক: খাদ্য ও পথ্য–বিশেষজ্ঞ; প্রধান নির্বাহী, প্রাকৃতিক নিরাময় কেন্দ্র
ছবি: পেকজেলসডটকম ও ইনস্টাগ্রাম