বিশ্ব সংগীত দিবস: গানের সুর যেভাবে মন ও মস্তিষ্ককে ভালো রাখে
শেয়ার করুন
ফলো করুন

১৯৮২ সাল থেকে প্রতিবছর ২১ জুন বিশ্ব সংগীত দিবস পালিত হয়ে আসছে। এর শুরুটা হয় ফ্রান্সে। সে সময়ের ফরাসি সংস্কৃতিমন্ত্রী জ্যাক ল্যাং এমন একটি দিন বিশেষভাবে নির্ধারণ করতে চেয়েছিলেন, যেখানে সংগীতকে তার সব রূপেই উদ্‌যাপন করা হবে। ধারণাটি দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে; আর তা হবে না–ইবা কেন! সুর আসলে এক সহজাত বিষয়। আর সেই সঙ্গে সংগীতও।

কিছু গানের আছে ক্ষত সারানোর ক্ষমতা, মনকে শান্ত করার শক্তি
কিছু গানের আছে ক্ষত সারানোর ক্ষমতা, মনকে শান্ত করার শক্তি
পেকজেলস ডট কম

আমরা সবাই যেমন মায়ের ঘুমপাড়ানি গান শুনে বড় হয়েছি, তেমনি প্রেম বা বিচ্ছেদ মানেও সেই গানের সুর। ভাষাশহীদদের প্রতি হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসাস্বরূপ আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর সুর দেওয়া আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো বা ছেলে হারানো এরিক ক্ল্যাপটনের টিয়ার্স ইন হেভেন; এই গানগুলোর আছে ক্ষত সারানোর ক্ষমতা, মনকে শান্ত করার শক্তি। এই যে আমরা অজান্তেই গুনগুনিয়ে উঠি গানের সুরে, তা আসলে আমাদের মন ও মস্তিষ্ককে ভালো রাখে অত্যন্ত কার্যকরভাবে।

বিজ্ঞাপন

সংগীতবিদ ডক্টর ডানা সোয়ারব্রিক কর্মরত আছেন ইউনিভার্সিটি অব অসলো সেন্টার ফর ইন্টার ডিসিপ্লিনারি রিসার্চ ইন রিদম অ্যান্ড মোশনে। তাঁর রিসার্চের বিষয়বস্তু, কনসার্ট বা  সংগীতের পরিবেশনা ও মূর্ছনা কীভাবে মানুষের মধে৵ ঐক্য নিয়ে আসে, বেঁধে রাখে সবাইকে। তাঁর গবেষণায় উঠে আসে, বিবর্তনের সময় থেকে যে জনগোষ্ঠী যত বেশি  সংগীতের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল, তারা একসঙ্গে আরও বেশি গঠনমূলক কাজ করেছে, জীবনের পথে এগিয়ে গিয়েছে।

লাইভ কনসার্টগুলো আসলে সামাজিক বন্ধন গড়ে তোলে
লাইভ কনসার্টগুলো আসলে সামাজিক বন্ধন গড়ে তোলে
পেকজেলস ডট কম

সংগীত বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করতে রসদ জোগায়। মিউজিক অ্যান্ড সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় ডক্টর ডানা সোয়ারব্রিক একদল শ্রোতার ওপর জরিপ করে মতামত দেয় যে তাঁর গবেষণা বলে, লাইভ কনসার্টগুলো আসলে সামাজিক বন্ধন গড়ে তোলে।

বিজ্ঞাপন

ফিরে দেখি ১৯৭১ সালের দিকে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সম্প্রচারিত প্রতিটি গান মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে, উদ্বাস্তু শিবিরের মানুষের মধ্যে কীভাবে মনোবল বৃদ্ধি করেছিল, সে গল্প আমরা সবাই জানি। যুদ্ধ কখনোই শান্তি বয়ে আনতে পারে না, কাউকে মানসিকভাবে ভালো রাখতে পারে না।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সম্প্রচারিত প্রতিটি গান মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বৃদ্ধি করেছিল
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সম্প্রচারিত প্রতিটি গান মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বৃদ্ধি করেছিল
উইকিমিডিয়া কমন্স

এ জন্যই ভিয়েতনাম যুদ্ধের পটভূমিতে লেখা ‘উই শ্যাল ওভারকাম’ গানের চরণগুলো সারা বিশ্বের মানুষের কাছে সম্প্রীতির ট্যাগলাইনে পরিণত হয়েছে। বহু গণসংগীত, দেশাত্মবোধক গান আর বিপ্লব ও মানবতার ধারণা থেকে লেখা  সংগীতের সুর মানুষের মধে৵ অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে, নিজের অধিকার আদায় করতে এমনকি যুদ্ধে নিজের জীবন দিতে উদ্বুদ্ধ করে আসছে মানুষকে যুগে যুগে। গানের সুরের এমনই প্রভাব পড়ে আমাদের মন ও মস্তিষ্কের ওপর।

যুদ্ধ থেকে এবার  ফিরে আসি জীবনে। শিশুর জন্মের সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্কের বিকাশ হতে থাকার প্রাথমিক সময়কালে তার পাঁচটি ইন্দ্রিয়ই সচল হতে শুরু করে। প্রকৃতি থেকে সে যা কিছু শোনে, সবই তার নিউরনে জমা হতে থাকে থরে থরে। মায়ের কণ্ঠস্বর,পাখির ডাক, ট্রাফিকের ক্যাকাফোনি—এই সবকিছুই তাঁর নিউরনে থেকে যায়; কিন্তু সুমধুর সুর শিশুর মস্তিষ্ককে সুস্থ ও সুষমভাবে বিকশিত করতে অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা পালন করে—বলছে নানা গবেষণার ফলাফল। এক থেকে তিন বছর বয়সে উপনীত হওয়ার পর সুর শিশুর ফোকাস আর মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।

মায়ের ঘুমপাড়ানি গান শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশে ভূমিকা রাখে
মায়ের ঘুমপাড়ানি গান শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশে ভূমিকা রাখে
পেকজেলস ডট কম

পাশাপাশি মোটর দক্ষতাভিত্তিক কাজ যেমন কোনো কিছু হাত দিয়ে ধরা, কেউ ডাকলে তাকানো ও প্রতিক্রিয়া দেওয়া, ভাষার মাধ্যমে যোগাযোগ দক্ষতা অর্জনসহ অনেক কিছু দ্রুত শেখে শিশু যদি সুরের সঙ্গে তার পরিচয় থাকে। তবে এখানে মনে রাখা জরুরি, উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সির সাউন্ড সিস্টেম, ডিজে বিটস বা যেকোনো ডিজিটাল ডিভাইসে চলতে থাকা একতরফা ও ক্রমাগত উচ্চ ভলিউমের গানের সুর শিশুর দৃষ্টি ও শ্রবণেন্দ্রিয়ের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। মস্তিষ্কের স্থায়ী ক্ষতি আর অটিজমের জন্যও দায়ী হতে পারে এগুলো বলেন গবেষকেরা। ঘুমপাড়ানি গান, মিষ্টি সুর ও ছন্দের ছড়া, মজার মজার প্রচলিত গান শিশুদের জন্য বেছে নেওয়া যায়।

যেকোনো বয়সের ক্ষেত্রে প্রশান্তিদায়ক গান শুনলে সেরোটোনিন ও অক্সিটোসিনের মতো হরমোন নিঃসরিত হয়। আর এসব হ্যাপি হরমোন আমাদের স্ট্রেস কমায়, মন ভালো রাখে। তাই এ কথা বলাই যায়, রক্তচাপ কমাতে, উদ্বেগ কমাতে ও আরামদায়ক অনুভূতি তৈরি করতে সহায়ক হতে পারে গানের সুর। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর মিউজিক অ্যান্ড মেডিসিন, আটলান্টা জার্নালের বিভিন্ন গবেষণাপত্রে উঠে এসেছে দারুণ সব তথ্য! মিউজিক থেরাপির মধ্য দিয়ে দীর্ঘস্থায়ী ব্যথায় ভুগছেন এমন রোগীদের ব্যথা উপশম করা সম্ভব হয়। শারীরিক ব্যথা থেকে মনোযোগ সরিয়ে নেওয়া, মনের আবেগকে বের করে নিয়ে আসার মাধ্যম হিসেবে যন্ত্রসংগীত শোনা বা বাদ্যযন্ত্র বাজানো বেশ উপকারী, বলা হচ্ছে এসব গবেষণায়। এ–ও বলা হচ্ছে, গানের সুরের মাধ্যমে পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার নিয়ন্ত্রণ করাও সম্ভব হয়। প্যালিয়েটিভ কেয়ারের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক ভূমিকা রাখতে পারে গানের সুর। মৃত্যুপথযাত্রী আর যন্ত্রণাক্লিষ্ট মানুষগুলোর মনে আরাম দেয় সংগীত। একই কথা বলা যায় হৃদয়ভাঙা বা দীর্ঘদিনের হতাশায় ডুবে থাকা মানুষের ক্ষেত্রেও। মাদকাসক্তি নিরাময়েও মিউজিক থেরাপি কার্যকর বলে প্রমাণ মিলেছে।

গানের সুর শরীর ও মনের ব্যথা ভুলিয়ে দেয়
গানের সুর শরীর ও মনের ব্যথা ভুলিয়ে দেয়
পেকজেলস ডট কম

যখন এই লেখা লিখছি, তখন ছোট্ট ব্লুটুথ স্পিকারে মার্কিন স্যাক্সোফোনবাদক কেনি জির ‘দ্য সং বার্ড’ সুরটি বাজছে। সে সুরের মূর্ছনার সঙ্গে কি–বোর্ডের শব্দ মিলেমিশে নতুন কোনো সুর তৈরি করছে, যা আমার লেখাটিকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। সুর আদতে সর্বজনীন। সংগীত নিজেই এক ভাষা। আর মনকে ভালো রাখতে, মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বাড়াতে জীবনের সব পর্যায়েই তা অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

লেখক: সাইকোসোশ্যাল কাউন্সিলর

প্রকাশ: ২১ জুন ২০২৪, ০৬: ০০
বিজ্ঞাপন