ঝুম বৃষ্টিতে খিচুড়ি খাওয়া যে কারণে স্বাস্থ্যকর
শেয়ার করুন
ফলো করুন

বর্ষাকালে খিচুড়ি খাওয়ার প্রচলন বাংলাদেশ ও ভারতীয় উপমহাদেশে একটি জনপ্রিয় লোকজ ঐতিহ্য। বৃষ্টির দিনে গরম–গরম খিচুড়ি খাওয়া শুধু মনোরমই নয়, আয়ুর্বেদ ও লোকজ স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকেও এটি স্বাস্থ্যকর, যদি সঠিকভাবে প্রস্তুত করা হয়। জম্পেশ আড্ডায়ও খিচুড়ি হতে পারে স্বাস্থ্যকর খাবার। আয়ুর্বেদ ও লোকজ স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে খিচুড়ি খাওয়ার স্বাস্থ্যগত দিকগুলো বিস্তারিত আলোচনা করা যাক।

বিজ্ঞাপন

খিচুড়ি বর্ষাকালে কেন স্বাস্থ্যকর

আয়ুর্বেদমতে, বর্ষা ঋতুতে খাদ্যাভ্যাসের জন্য নির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে, যা শরীরের ত্রিদোষ (বাত, পিত্ত, কফ) ভারসাম্য রক্ষা ও দুর্বল হজমশক্তি (অগ্নিমান্দ্য) মোকাবিলা করার জন্য দেওয়া হয়। খিচুড়ি বর্ষাকালে আদর্শ খাবার হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কারণগুলো হলো:
• হালকা ও সহজে হজমযোগ্য: খিচুড়ি সাধারণত মুগডাল, চাল ও হালকা সবজি দিয়ে তৈরি করা হয়, যা হজম হয় সহজে। বর্ষাকালে জঠরাগ্নি (পাচনশক্তি) দুর্বল থাকে, তাই এই হালকা খাবার শরীরের জন্য উপযোগী।

উষ্ণ গুণ: গরম–গরম খিচুড়ি শরীরে উষ্ণতা প্রদান করে, যা বর্ষাকালের আর্দ্র ও শীতল পরিবেশে বাত ও কফ কমাতে সাহায্য করে।

খিচুড়ি বর্ষাকালে আদর্শ খাবার হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে
খিচুড়ি বর্ষাকালে আদর্শ খাবার হিসেবে বিবেচিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে

• মসলার ব্যবহার: খিচুড়িতে আদা, হলুদ, জিরা, ধনে, গোলমরিচ বা হিংয়ের মতো মসলা ব্যবহার করা হয়, যা হজমশক্তি বাড়ায়, কফদোষ কমায় ও শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি করে। আদা হজমশক্তি উন্নত করে ও পেটফাঁপা রোধ করে। হলুদে আছে অ্যান্টি–ইনফ্ল্যামেটরি ও অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল বৈশিষ্ট্য, যা বর্ষাকালে সংক্রমণ প্রতিরোধে সহায়ক। হিং গ্যাস ও ফোলা ভাব কমায়।

• ভারসাম্যপূর্ণ পুষ্টি: খিচুড়িতে চাল (কার্বোহাইড্রেট), ডাল (প্রোটিন) ও সবজি (ভিটামিন ও খনিজ) থাকে, যা শরীরের জন্য ভারসাম্যপূর্ণ পুষ্টি সরবরাহ করে। এটি বর্ষাকালে শরীরের দুর্বলতা কাটাতে সাহায্য করে।

• আম কমায়: আয়ুর্বেদে ‘আম’ বলতে শরীরে জমে থাকা বিষাক্ত পদার্থকে বোঝায়। মুগডালের মতো উপাদান আম কমাতে সাহায্য করে, যা বর্ষাকালে জমে থাকা কফ বা বাতদোষের প্রভাব কমায়।

• বর্ষা ঋতুচর্যার সঙ্গে সামঞ্জস্য: আয়ুর্বেদে বর্ষাকালে উষ্ণ, হালকা ও সামান্য তৈলাক্ত খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। খিচুড়ি এই শর্ত পূরণ করে, বিশেষ করে যদি ঘি বা অল্প তেলে রান্না করা হয়।

বিজ্ঞাপন

লোকজ স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ

স্বাস্থ্যকর বলেই লোকজ ঐতিহ্যে খিচুড়ি বর্ষাকালে জনপ্রিয়
স্বাস্থ্যকর বলেই লোকজ ঐতিহ্যে খিচুড়ি বর্ষাকালে জনপ্রিয়

লোকজ ঐতিহ্যে খিচুড়ি বর্ষাকালে জনপ্রিয় হওয়ার পেছনে শুধু স্বাদ নয়, ব্যবহারিক ও স্বাস্থ্যগত কারণও রয়েছে:
• উষ্ণতা ও আরাম: বৃষ্টির দিনে শরীর ঠান্ডা ও আর্দ্র পরিবেশের সংস্পর্শে আসে, যা ঠান্ডা লাগা বা সর্দির ঝুঁকি বাড়ায়। গরম খিচুড়ি শরীরকে উষ্ণ রাখে এবং আরাম দেয়, যা শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।

• সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী: খিচুড়ি তৈরি করতে সাধারণ উপাদান, যেমন চাল, ডাল ও স্থানীয় সবজি লাগে, যা বর্ষাকালে সহজলভ্য। এটি লোকজ সমাজে সাশ্রয়ী ও পুষ্টিকর খাবার হিসেবে গৃহীত।

• হজমে সহজ: লোকজ বিশ্বাসে, বর্ষাকালে পেটের সমস্যা (যেমন ডায়রিয়া, গ্যাস) বেশি দেখা যায়। খিচুড়ি হালকা ও পেটের জন্য আরামদায়ক বলে এটি এই সময়ে পছন্দের খাবার।

• সংক্রমণ প্রতিরোধ: লোকজ ঐতিহ্যে খিচুড়িতে আদা, হলুদ বা গোলমরিচের মতো উপাদান ব্যবহার করা হয়, যা ঠান্ডা, সর্দি বা জ্বর প্রতিরোধে সহায়ক বলে বিশ্বাস করা হয়।

আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ

আধুনিক পুষ্টি ও স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকেও খিচুড়ি বর্ষাকালে স্বাস্থ্যকর খাবার হিসেবে বিবেচিত। খিচুড়িতে কার্বোহাইড্রেট (চাল), প্রোটিন (ডাল) এবং ফাইবার ও ভিটামিন (সবজি) থাকে। এটি শরীরের শক্তি সরবরাহ করে এবং বর্ষাকালে দুর্বল রোগ প্রতিরোধক্ষমতা শক্তিশালী করতে সহায়ক।  হলুদ, আদা ও গোলমরিচের মতো মসলায় অ্যান্টি–ইনফ্ল্যামেটরি ও অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা বর্ষাকালে সংক্রমণের ঝুঁকি কমায়। মুগডাল ও চালের সংমিশ্রণ হজমে সহজ ও পেটের জন্য আরামদায়ক। এটি বর্ষাকালে ডায়রিয়া বা পেটের সমস্যার ঝুঁকি কমায়। খিচুড়িতে পানির পরিমাণ বেশি থাকে, যা শরীরকে হাইড্রেটেড রাখতে সাহায্য করে। বর্ষাকালে পরিষ্কার পানির অভাবে হাইড্রেশন গুরুত্বপূর্ণ। কাঁচা শাক বা সালাদের তুলনায় খিচুড়ি রান্না করে খাওয়া হয়, যা জীবাণু সংক্রমণের ঝুঁকি কমায়।
খিচুড়ি যাতে বর্ষাকালে সর্বাধিক স্বাস্থ্যকর হয়, তার জন্য নিম্নলিখিত পরামর্শ মেনে চলা যেতে পারে:

আধুনিক পুষ্টি ও স্বাস্থ্যবিজ্ঞান মতে খিচুড়ি বর্ষাকালে স্বাস্থ্যকর খাবার
আধুনিক পুষ্টি ও স্বাস্থ্যবিজ্ঞান মতে খিচুড়ি বর্ষাকালে স্বাস্থ্যকর খাবার

• ডাল: মুগ বা মসুর ডাল ব্যবহার করুন। কারণ, এগুলো হজমে সহজ ও আম কমায়।
• চাল: পুরোনো চাল বা বাসমতী চাল ব্যবহার করুন। কারণ, এগুলো হালকা কফ কমায়।
• সবজি: কুমড়ো, গাজর, বেগুন বা লাউয়ের মতো হালকা সবজি যোগ করুন। কাঁচা শাক এড়িয়ে চলুন।
• মসলার ব্যবহার: আদা, হলুদ, জিরা, ধনে, গোলমরিচ বা হিং ব্যবহার করুন। এগুলো হজমশক্তি বাড়ায় এবং সংক্রমণ প্রতিরোধ করে।
• পরিমিত তেল/ঘি: অল্প পরিমাণে ঘি বা তেল ব্যবহার করুন। অতিরিক্ত তেল বর্ষাকালে কফ বাড়াতে পারে।
• পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা: সব উপাদান ভালোভাবে ধুয়ে নিন এবং পরিষ্কার পানি ব্যবহার করুন; কারণ, বর্ষাকালে জীবাণু সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি।
• হালকা রাখুন: খিচুড়ি খুব ঘন বা ভারী না করে হালকা রাখুন, যাতে হজমে সুবিধা হয়।
• পরিবেশন: গরম–গরম খিচুড়ি পরিবেশন করুন। ঠান্ডা খিচুড়ি বর্ষাকালে উপযোগী নয়।

সতর্কতা

খিচুড়ি স্বাস্থ্যকর কিছু বিষয়ে সতর্ক থাকতে হয়
খিচুড়ি স্বাস্থ্যকর কিছু বিষয়ে সতর্ক থাকতে হয়

খিচুড়ি সাধারণত স্বাস্থ্যকর। তবু কিছু বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। অতিরিক্ত তেল বা ভারী মসলা পিত্তদোষ বাড়াতে পারে এবং পেটে অস্বস্তি সৃষ্টি করতে পারে। দূষিত পানি বা সবজি ব্যবহার করলে খিচুড়ি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। খিচুড়ি হজমে সহজ হলেও অতিরিক্ত খেলে পেটফাঁপা বা ভারী লাগতে পারে। যাদের পিত্ত প্রকৃতি বা অম্লতার সমস্যা আছে, তাদের জন্য অতিরিক্ত মসলা বা টক উপাদান (যেমন টমেটো) এড়ানো উচিত।
তাই এবার বর্ষায় বৃষ্টিমুখর ছুটির দিনে হয়ে যাক খিচুড়ি।

লেখক: খাদ্য ও পথ্যবিশেষজ্ঞ; প্রধান নির্বাহী, প্রাকৃতিক নিরাময় কেন্দ্র

ছবি: হাল ফ্যাশন ও সামাজিক মাধ্যম

প্রকাশ: ২০ জুন ২০২৫, ০১: ০০
বিজ্ঞাপন