নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস: নতুন মায়ের মনের খবর রাখছেন তো?
শেয়ার করুন
ফলো করুন

মা হওয়ার পর একজন নারীকে হরমোনের উথাল-পাথাল প্রবাহের মধ্য দিয়ে যেতে হয়৷ বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা, দিন-রাত বাচ্চার যত্ন নেওয়া, দুধ খাওয়ানো, ঘুমের অভাবের সঙ্গে যোগ হয় সামাজিক চাপ আর নিজের শারীরিক সৌন্দর্য নিয়ে হীনমন্যতা। নতুন মায়ের শারীরিক স্বাস্থ্য নিয়ে তবুও কিছু সচেতনতা রয়েছে আমাদের দেশে, কিন্তু তাঁর মনের খবর কয়জন রাখি আমরা? আর এই অসচেতনতার সুযোগেই প্রসব পরবর্তী বা পোস্ট প্রাটাম ডিপ্রেশন এক নীরব ঘাতকের মতো গ্রাস করে নেয় অনেক নতুন মাকে। হুমকির মুখে পড়ে নবজাতক আর মায়ের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা।

প্রতি বছর ২৮ মে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস পালিত হয়ে আসছে

নিরাপদ মাতৃস্বাস্থ্য, মাতৃমৃত্যুহার কমানো ও নবজাতকের স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যেই প্রতি বছর ২৮ মে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস পালিত হয়ে আসছে। ২০১৫ সাল থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ উদ্যোগটিকে টেকসই উন্নয়নের অন্তর্ভুক্ত করে। বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী সংগঠন যেমন ইউনিসেফ, বিশ্ব ব্যাংক,ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন আর পপুলেশন কন্ট্রোল এই দিবসটি পালন করে। প্রতি বছর ২৮ মে বাংলাদেশ সরকার এই দিবসটি উপলক্ষে নানা কর্মসূচি নিয়ে থাকেন।

বিজ্ঞাপন

মাতৃত্বকাল নারীর জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ন সময়। গর্ভধারণ ও গর্ভকালীন অবস্থায় অনেক ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা যায়। সেজন্য স্ত্রীরোগবিদ্যা বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের তত্বাবধানে  নিয়মিত চেকআপ এবং ফলোআপে থেকে সুনির্দিষ্ট নিয়মগুলো মেনে চলতে হয়। পাশাপাশি পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ, পর্যাপ্ত বিশ্রাম আর প্রসব পরবর্তীকালীন সময়ে মা ও শিশুর যত্ন নেওয়া বিষয়ে সচেতন থাকা জরুরি। প্রসব পরবর্তী সময়ে মায়ের শারীরিক যত্নের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখার প্রতি তীব্র গুরুত্ব আরোপ করেছেন সাইকোসোশ্যাল কাউন্সিলর সৈয়দা এহসানা রহমান।

সন্তান জন্মদানের  পুর্বে ও পরবর্তী সময়ে দেহে হরমোনের পরিবর্তনের কারণে ডিপ্রেশন হতে পারে
সন্তান জন্মদানের পুর্বে ও পরবর্তী সময়ে দেহে হরমোনের পরিবর্তনের কারণে ডিপ্রেশন হতে পারে


তাঁর মতে, সন্তান জন্মদানের পুর্বে ও পরবর্তীসময়ে দেহে হরমোনের পরিবর্তনের কারণে মৃদু থেকে প্রবল ডিপ্রেশন হতে পারে। এছাড়া, গর্ভকালীন দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি বা অবসাদ, বুকের দুধ খাওয়ানোর চ্যালেঞ্জ এবং প্রসবোত্তর অন্যান্য জটিলতার কারণেও এ সময় প্রসব পরবর্তী বিষণ্ণতা দেখা দিতে পারে।

বিজ্ঞাপন

হরমোনের পরিবর্তন ছাড়াও যে সকল কারণে প্রসব পরবর্তী বিষণ্ণতার জন্য দায়ী হয় সেগুলো দেখে নিন এক নজর।

•নবজাতক সন্তানের যত্নের ক্ষেত্রে পারিপার্শিক সহযোগিতার অভাব।

•নির্ধারিত সময়ের পূর্বে  শিশুর জন্ম বা স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে জন্ম হওয়া।

প্রসব পরবর্তী বিষণ্ণতার জন্য দায়ী হতে পারে নানা বিষয়
প্রসব পরবর্তী বিষণ্ণতার জন্য দায়ী হতে পারে নানা বিষয়

•অপ্রত্যাশিত গর্ভধারণ।

•শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের পূর্ব অভিজ্ঞতা।

•ঘুমের সমস্যা ও ক্লান্তি।

•একাকিত্ববোধ বা মানসিক সহযোগিতার অভাব।

এই সমস্যাগুলো মাতৃত্বকালীন সময়ে কমবেশি অনেকেই মোকাবেলা করে থাকেন। যথাযথভাবে এই চ্যালেঞ্জগুলোর বিষয়ে যত্নশীল হলে প্রসব পরবর্তী বিষণ্ণতার হাত থেকে প্রশান্তি লাভ সম্ভব। সে জন্য কিছু বিষয় খেয়াল রাখতে হবে।

পারিবারিক সাপোর্ট

পৃথিবীর প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান পরিবার। এক সময় যৌথ পরিবারের সংস্কৃতি থাকলেও বর্তমান সময়ে আমরা নিউক্লিয়ার পরিবারের রূপরেখা সর্বত্রই দেখতে পাই। যৌথ পরিবারে বড় ও ছোট আত্মীয় স্বজনের উপস্থিতিতে মাতৃত্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সহজ ছিল। সেই পরিস্থিতি আর এখন ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। কিন্তু একটি পরিবারের কন্যা বা পুত্রবধূ যিনিই মা হননা কেন, তাঁর প্রতি পরিবারের সকলের আন্তরিকতা দেখানো অত্যন্ত প্রয়োজন। প্রসূতি মায়ের মনে এমনিতেই নানা রকম দুশ্চিন্তা ও আশংকা চলতে থাকে। সে সময় পারিবারিক সাপোর্ট মায়ের মনে স্থিরতা আনে।

যিনিই মা হননা কেন, তাঁর প্রতি পরিবারের সকলের আন্তরিকতা দেখানো অত্যন্ত প্রয়োজন
যিনিই মা হননা কেন, তাঁর প্রতি পরিবারের সকলের আন্তরিকতা দেখানো অত্যন্ত প্রয়োজন
মায়ের সুস্থতার জন্য ন্যুনতম ছয় ঘন্টা নিরবিচ্ছিন্ন ঘুম নিশ্চিত করা প্রয়োজন
মায়ের সুস্থতার জন্য ন্যুনতম ছয় ঘন্টা নিরবিচ্ছিন্ন ঘুম নিশ্চিত করা প্রয়োজন

যথাযথ বিশ্রাম

প্রসব পরবর্তী  সময়ে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় নবজাতক শিশুটি ঘুমিয়ে গেলে মা অন্যান্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এ ক্ষেত্রে মোবাইল বা অন্য যে কোনো ডিভাইস দূরে রেখে শিশুর পাশাপাশি মা খানিকটা সময় ঘুমিয়ে নিতে পারেন। মায়ের সুস্থতার জন্য ন্যুনতম ছয় ঘন্টা নিরবিচ্ছিন্ন ঘুম নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সংসারের কাজে সাহায্য করে বাবারা এটি নিশ্চিত করতে পারেন।

একঘেয়েমি কাটানো

প্রসব পরবর্তী সময়ে সাধারণত মা ও শিশু দীর্ঘ সময় ঘরেই থাকে। সকাল থেকে রাত অবধি কেবল নবজাতকের সঙ্গে থাকা এবং শিশুর রুটিনের সঙ্গে মায়ের অভ্যস্ত হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে একঘেয়েমি আসতে পারে। এ সময় তাঁর দৈনন্দিন কাজে কিছুটা বিরতি দেওয়া প্রয়োজন। সুন্দর কোন স্থানে বেড়াতে গেলে বা অন্তত নিকটস্থ পার্ক থেকে খানিকটা সময় হেঁটে আসলে নতুন মায়ের মন প্রশান্ত থাকবে এবং দৈনন্দিন রুটিনের একঘেয়েমি থেকে ছুটি মিলবে। এটি মানসিক সুস্থতার জন্য খুব জরুরি।    

শিশুর রুটিনের সঙ্গে মায়ের অভ্যস্ত হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে একঘেয়েমি আসতে পারে
শিশুর রুটিনের সঙ্গে মায়ের অভ্যস্ত হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে একঘেয়েমি আসতে পারে
গৃহস্থালি কাজে অতিরিক্ত সময় না দিয়ে সে সময় নিজের যত্ন নেওয়া হতে পারে অনেক উপকারি
গৃহস্থালি কাজে অতিরিক্ত সময় না দিয়ে সে সময় নিজের যত্ন নেওয়া হতে পারে অনেক উপকারি

কোনো কাজের জন্য অতিরিক্ত চাপ না নেওয়া

নবজাতক শিশুর যত্নের পাশাপাশি দেখা যায় মা পরিবারের অনেক কাজ করে থাকেন। ঘর গোছানো, পরিস্কার করা থেকে শুরু করে রান্না ঘরে অনেকটা সময় চলে যায়। এক্ষেত্রে প্রায়োরিটি অনুযায়ী কাজ করাটা খুব জরুরি, বললেন সৈয়দা এহসানা রহমান। গৃহস্থালি কাজে অতিরিক্ত সময় না দিয়ে সে সময় নিজের যত্ন নেওয়া হতে পারে অনেক উপকারি। সেটা একটি ছোট্ট টি ব্রেক, ত্বক ও চুলের যত্ন অথবা বিশ্রাম করা হতে পারে । এ সময়ে এমন কাজগুলো বেছে নেওয়া যা শরীর ও মনকে ভালো রাখে।  

বাচ্চার বাবার কার্যকর ভূমিকা পালন

ব্যস্ত এই সময়ে একা হাতে সন্তান লালন পালন ও পরিবার সামলানো প্রায় অসম্ভব। সে জন্য একটি শিশুর জন্মের আগে থেকে প্রসূতি মায়ের যত্ন এবং মনোবল বৃদ্ধিতে বাবার পক্ষ থেকে শতভাগ সহযোগিতা তাঁর মনের আশঙ্কা দূর করতে সহায়তা করবে।

প্রসূতি মায়ের যত্ন এবং মনোবল বৃদ্ধিতে বাবার পক্ষ থেকে শতভাগ সহযোগিতার কোনো বিকল্প নেই
প্রসূতি মায়ের যত্ন এবং মনোবল বৃদ্ধিতে বাবার পক্ষ থেকে শতভাগ সহযোগিতার কোনো বিকল্প নেই

পরিশেষে মনে রাখতে হবে, সুস্থ মা মানেই সুস্থ ও হাসিখুশি শিশু এবং এর সবটাই নির্ভর করে আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক পরিমন্ডলের সাপোর্ট সিস্টেমের ওপর।

পরামর্শক: সাইকোসোশ্যাল কাউন্সিলর, রয়েল মাল্টি কেয়ার কন্সাল্টেশন সেন্টার, মৌলভি বাজার

প্রকাশ: ২৮ মে ২০২৪, ১৭: ০৫
বিজ্ঞাপন