নেহারি স্বাস্থ্যকর হলেও সবার জন্য নয় যে কারণে
শেয়ার করুন
ফলো করুন

কোরবানি ঈদ এলেই আমরা কেবল মাংস নয়, ওই পশুর নানা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ খাওয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত হয়ে উঠি। এই যেমন, গরুর পা দিয়ে নেহারি রান্না হয়েই থাকে। এখন প্রশ্ন জাগে, নেহারি কি খাওয়া যাবে? নেহারি একটি জনপ্রিয় দক্ষিণ এশীয় খাবার, যা সাধারণত গরু, মহিষ বা ছাগলের পা দিয়ে তৈরি করা হয় এবং এটি দীর্ঘ সময় ধরে ধীরে ধীরে রান্না করা হয়। ফলে এটি পুষ্টিকর এবং স্বাদে সমৃদ্ধ হয়। নেহারির স্বাস্থ্য উপকারিতা নির্ভর করে এর উপাদান এবং প্রস্তুত প্রণালির ওপর। এই সময়ে আমরা জেনে নিতে পারি নেহারির স্বাস্থ্য উপকারিতার সম্পর্কে।

বিজ্ঞাপন

প্রোটিনের উৎস

উচ্চমানের প্রোটিনের একটি চমৎকার উৎস
উচ্চমানের প্রোটিনের একটি চমৎকার উৎস

নেহারি মূলত হাড় ও মাংস দিয়ে তৈরি, যা উচ্চমানের প্রোটিনের একটি চমৎকার উৎস। প্রোটিন শরীরের টিস্যু মেরামত, পেশি গঠন এবং অ্যানজাইম ও হরমোন উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মাংসে থাকা প্রোটিনে অ্যামিনো অ্যাসিড থাকে, যা শরীরের জন্য অপরিহার্য। উদাহরণস্বরূপ, লাইসিন ও লিউসিন পেশি সংশ্লেষণে সহায়তা করে। পর্যাপ্ত প্রোটিন গ্রহণ পেশিভর বজায় রাখতে এবং শরীরের বিপাকীয়ের হার বাড়াতে সহায়ক।

বিজ্ঞাপন

হাড়ের স্বাস্থ্যে সহায়ক

নেহারি হাড়ের মজ্জা বা হাড়ের সঙ্গে রান্না করা হয়, যা কোলাজেন, জেলাটিন এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদানে সমৃদ্ধ। এগুলো হাড়, জয়েন্ট ও ত্বকের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। হাড়ের মজ্জায় থাকা কোলাজেন হাইড্রোলাইজড হয়ে জেলাটিনে রূপান্তরিত হয়, যা জয়েন্টের কার্টিলেজ মেরামত করতে এবং প্রদাহ কমাতে সহায়তা করে। কোলাজেন সাপ্লিমেন্ট জয়েন্টের ব্যথা কমাতে এবং অস্টিও–আর্থ্রাইটিসের উপসর্গ উপশমে সহায়ক।

মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের উৎস

আছে মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টস
আছে মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টস

নেহারিতে ব্যবহৃত মাংসে আয়রন, জিংক, ভিটামিন বি১২ এবং অন্যান্য মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট থাকে, যা শরীরের বিভিন্ন কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ। আয়রন হিমোগ্লোবিন উৎপাদনে সহায়তা করে, যা অক্সিজেন পরিবহনে কাজ করে। আয়রন (মাংস থেকে প্রাপ্ত) শরীরে সহজে শোষিত হয়। জিংক রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং কোষ বিভাজনে সহায়তা করে। ভিটামিন বি১২ স্নায়ুতন্ত্রের স্বাস্থ্য এবং রক্তকণিকা উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ।

মসলার স্বাস্থ্য উপকারিতা

নেহারিতে ব্যবহৃত মসলা, যেমন হলুদ, আদা, রসুন, জিরা, ধনে ইত্যাদি অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট ও অ্যান্টি–ইনফ্ল্যামেটরি উপাদানে সমৃদ্ধ। এতে হলুদ থাকায় হলুদের কারকিউমিন প্রদাহ কমায় এবং অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। কারকিউমিন হৃদ্‌রোগ এবং ক্যানসারের ঝুঁকি কমাতে পারে। আদা ও রসুন, এগুলো হজমশক্তি বাড়ায় এবং রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।

হজমশক্তি বাড়ায়

নেহারির ধীরে ধীরে রান্নার প্রক্রিয়া এবং মসলার ব্যবহার হজমশক্তি উন্নত করতে সহায়তা করে। জেলাটিন এবং কোলাজেন পাকস্থলীর আস্তরণকে শক্তিশালী করে এবং অন্ত্রের স্বাস্থ্য উন্নত করে। জেলাটিনে থাকা অ্যামিনো অ্যাসিড গ্লাইসিন অন্ত্রের প্রদাহ কমাতে এবং গ্যাস্ট্রিক আলসার প্রতিরোধে সহায়ক।

ক্যালোরি ও শক্তি: নেহারি একটি উচ্চ ক্যালোরিযুক্ত খাবার, যা শক্তির একটি ভালো উৎস। বিশেষ করে শীতকালে এটি শরীরকে উষ্ণ রাখতে সহায়তা করে।

নেহারি খাওয়ার উপযুক্ত সময়

সকালে (নাশতা বা ব্রাঞ্চ): সকালের নাশতা হিসেবে খাওয়া হয়। কারণ, এটি উচ্চ ক্যালরিযুক্ত এবং শক্তির উৎস। সকালে খাওয়া হলে শরীর সারা দিন এই শক্তি ব্যবহার করতে পারে। সকালে বিপাকীয়ের হার বা মেটাবলিক রেট সাধারণত বেশি থাকে, তাই ভারী খাবার হজম করা সহজ হয়। দিনের শুরুতে উচ্চ প্রোটিনযুক্ত খাবার খাওয়া রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে এবং দীর্ঘ সময় তৃপ্তি প্রদানে সহায়ক।

রাতে খাওয়া এড়িয়ে চলা: নেহারি রাতের খাবার হিসেবে খাওয়া উচিত নয়। কারণ, এটি ভারী ও উচ্চ ক্যালরিযুক্ত। রাতে বিপাকীয় হার কমে যায়, তাই ভারী খাবার হজম করতে সমস্যা হতে পারে, যা অ্যাসিড রিফ্ল্যাক্স বা ঘুমের সমস্যার কারণ হতে পারে। রাতে ভারী খাবার খেলে ইনসুলিন সংবেদনশীলতা কমতে পারে এবং ক্যালরি চর্বি হিসেবে জমা হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে।

যাঁরা নেহারি খেতে পারবেন না

নেহারি সবার জন্য উপযুক্ত না–ও হতে পারে, বিশেষ করে নির্দিষ্ট স্বাস্থ্য সমস্যাযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য।

উচ্চ কোলেস্টেরল বা হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি: নেহারিতে চর্বিযুক্ত মাংস ব্যবহৃত হয়, যা এলডিএল (খারাপ) কোলেস্টেরল বাড়াতে পারে। যাঁদের হৃদ্‌রোগ, উচ্চ কোলেস্টেরল বা ট্রাইগ্লিসারাইডের সমস্যা আছে, তাঁদের নেহারি এড়িয়ে চলা উচিত বা চর্বিহীন মাংস দিয়ে তৈরি নেহারি খাওয়া উচিত। স্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং কোলেস্টেরল–সমৃদ্ধ খাবার হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।

উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত ব্যক্তি: নেহারিতে লবণ এবং মসলার পরিমাণ বেশি থাকতে পারে, যা রক্তচাপ বাড়াতে পারে। যাঁদের উচ্চ রক্তচাপ আছে, তাঁদের লবণ কমানোর জন্য বিশেষভাবে তৈরি নেহারি খাওয়া উচিত। অতিরিক্ত সোডিয়াম গ্রহণ রক্তচাপ বাড়ায় এবং হৃদ্‌যন্ত্রের ওপর চাপ সৃষ্টি করে।

হজমের সমস্যাযুক্ত ব্যক্তি: নেহারি ভারী এবং তৈলাক্ত খাবার, যা হজম করতে সময় লাগে। যাঁদের গ্যাস্ট্রিক, অ্যাসিড রিফ্ল্যাক্স (জিইআরডি) বা ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম (আইবিএস) আছে, তাঁরা নেহারি খেলে পেটে অস্বস্তি বা বুকজ্বালা অনুভব করতে পারেন। উচ্চ চর্বিযুক্ত খাবার পাকস্থলী খালি হওয়ার সময় বাড়ায়, যা জিইআরডির উপসর্গ বাড়াতে পারে।

গাউট বা ইউরিক অ্যাসিডের সমস্যাযুক্ত ব্যক্তি: নেহারিতে ব্যবহৃত লাল মাংসে পিউরিন বেশি থাকে, যা ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বাড়িয়ে গাউটের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। পিউরিন–সমৃদ্ধ খাবার ইউরিক অ্যাসিড উৎপাদন বাড়ায়, যা জয়েন্টে স্ফটিক জমা করে ব্যথা সৃষ্টি করে।

শিশু ও গর্ভবতী নারী: শিশুদের জন্য নেহারি অতিরিক্ত মসলাদার ও ভারী হতে পারে, যা তাদের হজমশক্তির জন্য উপযুক্ত নয়। গর্ভবতী নারীদের অতিরিক্ত মসলাদার বা তৈলাক্ত নেহারি এড়িয়ে চলা উচিত। কারণ, এটি পেটে অস্বস্তি বা হজমের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। তবে পরিমিত পরিমাণে হালকা মসলাযুক্ত নেহারি খাওয়া যেতে পারে, যদি ডাক্তারের পরামর্শ থাকে।

নেহারি একটি পুষ্টিকর খাবার, যা প্রোটিন, মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট ও অ্যান্টি–অক্সিডেন্টে সমৃদ্ধ। এর হাড়ের মজ্জা ও মসলা জয়েন্ট, হাড় ও হজমশক্তির জন্য উপকারী। তবে স্বাস্থ্য উপকারিতা পুরোপুরি পেতে এটি পরিমিতভাবে এবং সুষম খাদ্যের অংশ হিসেবে খাওয়া উচিত।
লেখক: খাদ্য ও পথ্য; প্রধান নির্বাহী, প্রাকৃতিক নিরাময় কেন্দ্র

ছবি: হাল ফ্যাশন ও সংগ্রহ

প্রকাশ: ০৮ জুন ২০২৫, ০১: ০০
বিজ্ঞাপন