সবাইকে হ্যাপি নিউ ইয়ার। আশা করছি, খুব সুন্দরভাবে সবার নতুন বছর শুরু হয়েছে। আজ কথা বলব অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজঅর্ডার (ওসিডি) নিয়ে। এটা আমাদের দেশে, যা বাংলাদেশে শুচিবাই নামে পরিচিত।
আমার কাছে মানসিক সমস্যা বা ট্রমাজনিত যত রোগী আসেন, তাঁদের বেশির ভাগের মধ্যেই ওসিডি দেখা যায়। এর লক্ষণ হলো বারবার হাত ধোয়া, দরজা বন্ধ করে নিজেকে আলাদা করে রাখা, নির্দিষ্টভাবে জিনিস স্থানান্তর করা, ঘরের জিনিস নির্দিষ্টভাবে রাখা, অযৌক্তিক ও অস্বস্তিকর চিন্তা করা, যেমন দুর্ঘটনা, রোগ বা আঘাত পাওয়ার ভয়, জীবাণু বা অসুস্থতার প্রতি অতিরিক্ত উদ্বেগ, কিছু বিষয় নিয়ে অবসেশনের কারণে হারানোর ভয় অনবরত মাথায় ঘুরতে থাকা, সম্পর্কের প্রতি বিশ্বাসহীনতা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা যায়। এসব কারণে পরিবারের সদস্যরা অনেক বেশি ভোগেন এবং বিরক্ত হন।
গবেষণার ফল থেকে জানা গেছে যে জিন, সেরোটোনিনের মাত্রা, মস্তিষ্কের কিছু নির্দিষ্ট অঞ্চল, যেমন স্ট্রিয়াটাম ও লিম্বিক সিস্টেমের কার্যকলাপে গরমিলের কারণে ওসিডি উদ্ভবের কারণ হতে পারে। স্পেসিফিক ট্রমা, মানসিক চাপ বা আবেগের কারণে শিশুসহ যে কেউ এই রোগের শিকার হতে পারে। আমার কাছে প্রচুর রোগী আসেন ওসিডি নিয়ে। আমি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাঁদের ট্রমা নিয়ে কাজ করি। ওসিডি রোগীরা নিজে থেকে কখনোই আমার কাছে আসেন না। তাঁদের পরিবারের সদস্যরা আর সামলাতে না পেরে ও ওষুধ খাওয়ার পরও কোনো উপকার না পেলে আমার শরণাপন্ন হন।
আমার সবচেয়ে জটিল রোগী যিনি ছিলেন, তিনি ৫০ বছরের একজন নারী; যাঁর শুচিবাই ছিল দীর্ঘ ২৫ বছর এবং তিনি নিজের সব ব্যবসা ধীরে ধীরে বন্ধ করে দিয়েছেন এ কারণে। এটি শুরু হয়েছিল তাঁর বাবা মারা যাওয়ার পর এবং এর কয়েক বছর পর তাঁর মা–ও মারা যান। এ সময় থেকেই তিনি বারবার হাত ধোয়া শুরু করেছিলেন। তারপর সবকিছুতেই তাঁর সমস্যা শুরু হয়। কোনো কিছুই আর হাত দিয়ে ধরতে পারতেন না। নিজের সন্তানদেরকেও, তারা তখন শিশু ছিল, ধরা বন্ধ করে দেন। বাসার সবাইকে বাধ্য করতেন বারবার হাত ধুতে। তাঁর কাজের মানুষেরাও চলে যান। অবস্থা এতটাই খারাপ হয় যে তাঁর স্বামী, যিনি উচ্চপদস্থ প্রশাসনিক কর্মকর্তা ছিলেন, তিনি চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন নিজের সন্তানদের দেখাশোনার জন্য। আমার কাছে তাঁর সন্তান তাঁকে নিয়ে এসেছিল। তার সেই শিশুসন্তানেরা বড় হয়েছেন এবং ঘর থেকে পালিয়ে বেড়াতেন। কোভিডের সময় তাঁর কোভিড হয় এবং তাঁর অবস্থা এত বেশি খারাপ হয়ে যায় যে তিনি প্রতি পাঁচ সেকেন্ডে হাত ধোয়া শুরু করেন।
প্রতিদিন তাঁর পাঁচ থেকে সাতটি করে হ্যান্ডওয়াশ, বডিওয়াশ লেগেছিল। ঘরের ভেতর ঢোকার আগে দরজা থেকে সবাইকে হাত ও পা ধুয়ে ঢুকতে হতো। এক গ্লাস পানি ঢালার আগে সেই গ্লাস ও হাত সাবান দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে পানি পান করে আবার ধুতে হতো এবং জগের হাতলও ভালোভাবে ধুতে হতো। তার ওপর সারা দিন চলত আবার কোভিড হওয়ার আতঙ্ক। দীর্ঘ ২৫ বছর পর তাঁর স্বামী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তাঁকে ডিভোর্স দেবেন। কারণ, তাঁদের সবার জন্য ঘরে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। সেই রোগী আমার কাছে দীর্ঘ দেড় বছর অনলাইন সেশন নিয়ে ধীরে ধীরে ওসিডি থেকে বের হয়ে আসেন। তাঁর ছেলে আমাকে অনেক আবেগঘন একটি ই–মেইল পাঠিয়েছিলেন তাঁর মায়ের সুস্থ হওয়ার পর, যা পড়ে আমি চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। তাঁরা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে তাঁর মা যেখানে দিনে সাতটি হ্যান্ডওয়াশ শেষ করে ফেলতেন হাত ধুতে গিয়ে, সেখানে একটি হ্যান্ডওয়াশে এখন দু–তিন সপ্তাহ চলে যায়।
আমি কাজ করেছিলাম ওই নারীর ট্রমা নিয়ে। তিনি তাঁর মা-বাবার একমাত্র সন্তান। তাঁদের হারানোর পর তিনি ট্রমাটাইজড হয়ে পড়েন। সবকিছু তাঁর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তিনি নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রণ নিতে চেয়েছেন। সাবকনশাস মাইন্ড শুরু করে মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেওয়া। অন্য কিছুর ওপর নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না, তাই তাঁরা নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করেন। শুরু হয় খাওয়া কন্ট্রোল দিয়ে। তারপর মনে হয়, তাঁর আত্মা ও শরীর শুচি নয়। আত্মাকে তো আর পরিষ্কার করতে পারেন না, তাই শুরু হয় শরীরকে শুদ্ধ করার চেষ্টা। এ জন্য তিনি বারবার হাত ধুতেন। এটা বাড়তেই থাকে। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকে নিজের ওপর এবং অন্য সবার ওপর অবিশ্বাস।
এ ধরনের রোগীদের সবচেয়ে বড় বাধা হলো তাঁরা নিজে। কারণ, তাঁরা কাউকে বিশ্বাস করতে পারেন না। এমনকি চিকিৎসক, থেরাপিস্ট, সাইকোলজিস্ট—কাউকে নন। শুরু থেকেই ওষুধ খেলে তাঁরা ভালো হতে পারেন, কিন্তু অবিশ্বাসের কারণে সেটা করেন না। কারণ, তাঁদের মনে হতে থাকে, ওষুধের সঙ্গে কিছু মেশানো আছে এবং তাঁকে হয়তো মেরে ফেলতে চান বা ওষুধ খেলে তাঁর বড় কোনো ধরনের ক্ষতি হয়ে যাবে, এসব ভেবে তাঁরা কোনোভাবেই ওষুধ খেতে চান না।
আমার একজন পুরুষ রোগী ছিলেন; যাঁর সমস্যা ছিল কাপড়ে। তাঁর মনে হতো কিছু কাপড় আছে, যা পরলেই তাঁর ক্ষতি হবে। এভাবে শুরু হলেও তিনি ঘরের সবার কাপড় পরা নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেন। তারপর অফিসের পিয়ন ও তাঁর সহকর্মীদের কাপড় নিয়ন্ত্রণ শুরু করেন। অবস্থা প্রকট হলে তাঁর স্ত্রী তাঁকে ছেড়ে চলে যান। তিনি নিজে কেবল একটি শার্ট পরতেন। আর তাঁর স্ত্রীর অনুমতি ছিল কেবল একটি সালোয়ার–কামিজ পরার। সেটাকেই বারবার ধুয়ে পরতে হতো। কখনো কখনো ভেজা অবস্থাতেই আবার পড়তে হতো।
সেভাবেই তাঁর কাছে এটাকে পরিশুদ্ধ মনে হতো। তাঁর বোন ও মা তাঁকে আমার কাছে নিয়ে এসেছিলেন। সেই রোগীকেও আমি অনলাইনে চিকিৎসা করেছি এবং তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়েছেন।
অনেক বছর আগে কোনো এক হরতাল বা ধর্মঘটের সময় তিনি যে বাসে ছিলেন, সেই বাসে আগুন দেওয়া হয়েছিল। তিনি বেঁচে গেলেও বাসের কয়েকজন পুড়ে যান। তাঁর প্রথম মনে হয়েছিল, সেদিন যে শার্টটি তিনি পরেছিলেন, সেটির রং আর টেক্সচারের কারণেই তিনি বেঁচে যান। দীর্ঘ এক বছর চিকিৎসার পর তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন।
এই রোগীদের জন্য দরকার অনেক ভালোবাসা আর ধৈর্য। মানুষের ওপর অবিশ্বাসের কারণে জীবনে অনেক বড় কোনো ক্ষতির কারণে ওসিডি শুরু হয়। তাই ইতিবাচক কথা বলা, প্রতিদিন মেডিটেশন করা, উৎসাহিত করা খুব প্রয়োজন। সেই সঙ্গে তাঁদেরকে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য রাজি করানোটাও জরুরি। রোগী যখন আতঙ্ক থেকে বের হয়ে যাবেন, তখন ধীরে ধীরে সুস্থ হতে শুরু করবেন।
লেখক: একাধারে নেচারোপ্যাথিক ডাক্তার, পুষ্টিবিদ, কিনেজিওলজিস্ট, ট্রমা রিলিজ থেরাপিস্ট, অটিজম স্পেশালিস্ট, মাইন্ড সেট ট্রেইনার। তিনি কাজ করছেন লন্ডনের ১০, হারলে স্ট্রিট ক্লিনিক এবং অনলাইনেও আছে তাঁর উপস্থিতি।
ই–মেইল: [email protected] ওয়েবসাইট: https://shahmikaagoon.com
ছবি: পেকেজেলসডটকম
নোট: সব ছবিই প্রতীকী