হঠাৎ প্রেশার বেড়ে গেল, নানা আয়োজনে প্রেশার কমানোর চেষ্টা করা হয়। এর মধ্যে আছে তেঁতুল মেশানো পানি পান করার পদ্ধতি, যেটা আমরা অনেকেই জানি। এটাকে একপ্রকার ঘরোয়া নিদান বলা যায়। অবশ্য এখন আধুনিক যুগ, নানা ওষুধে সায়লাব। তারপরও মানুষ এই তেঁতুলপানি পান করে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আসলে কি তেঁতুলপানিতে প্রেশার কমে? এর বৈজ্ঞানিক ভিত্তিটাই–বা কী?
তেঁতুলের পানি খেলে উচ্চ রক্তচাপ কমানোর সম্ভাবনা নিয়ে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করা হলো।
তেঁতুলে প্রচুর পটাশিয়াম থাকে, যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। পটাশিয়াম শরীরে সোডিয়ামের প্রভাব কমিয়ে রক্তনালির প্রসারণে সাহায্য করে। ফলে রক্তচাপ হ্রাস পেতে পারে। তেঁতুলে থাকা পলিফেনল (যেমন টার্টারিক অ্যাসিড) অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে। এটি অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমিয়ে রক্তনালির স্বাস্থ্য উন্নত করতে পারে, যা উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি হ্রাস করে। তেঁতুলের দ্রবণীয় ফাইবার রক্তে খারাপ কোলেস্টেরল এলডিএল কমাতে সাহায্য করে, যা হৃদ্রোগ ও উচ্চ রক্তচাপের সঙ্গে যুক্ত।
কিছু প্রাণীর ওপর গবেষণায় তেঁতুলের নির্যাস রক্তচাপ কমাতে দেখা গেছে। যেমন ইঁদুরের ওপর করা একটি গবেষণায় তেঁতুলের নির্যাস রক্তনালি শিথিল করে রক্তচাপ হ্রাসের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। তবে মানবদেহে এ–সম্পর্কিত গবেষণা এখনো সীমিত।
তেঁতুলপানি পান করলে শরীরে নানাবিধ উপকার হতে পারে। তেঁতুলে থাকা ভিটামিন, মিনারেল, অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট ও ফাইবার স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।
• হজমশক্তি বৃদ্ধি: তেঁতুলে ফাইবার বেশি থাকে, যা পাচনতন্ত্রের কার্যকারিতা বাড়ায় এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। এটি প্রাকৃতিক ল্যাক্সেটিভ হিসেবে কাজ করে, পেট পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। তেঁতুলের অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল গুণাগুণ অন্ত্রের ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া দমনে ভূমিকা রাখে।
• হৃদ্যন্ত্রের স্বাস্থ্য ভালো রাখে: তেঁতুলে থাকা পটাশিয়াম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং সোডিয়ামের ক্ষতিকর প্রভাব কমায়। পলিফেনল ও ফ্ল্যাভোনয়েড রক্তনালির প্রদাহ কমিয়ে হৃদ্রোগের ঝুঁকি হ্রাস করে। এটি খারাপ কোলেস্টেরল এলডিএল কমাতে সাহায্য করে, যা ধমনির স্বাস্থ্য রক্ষা করে।
• রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায়: তেঁতুলে ভিটামিন সি ও অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট (যেমন টার্টারিক অ্যাসিড) থাকে, যা ফ্রি রেডিক্যালের বিরুদ্ধে লড়াই করে। এটি শরীরের ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী করে সংক্রমণ ও ক্রনিক রোগ (যেমন ক্যানসার) প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে।
• রক্তশূন্যতা প্রতিরোধ: তেঁতুলে আয়রন থাকে, যা লোহিত রক্তকণিকা উৎপাদনে সহায়তা করে। এতে উপস্থিত ম্যাগনেশিয়াম ও ফসফরাস রক্ত সঞ্চালন উন্নত করে।
• ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়ক: তেঁতুলের অ্যালফাঅ্যামাইলেজ ইনহিবিটর কার্যক্রম রক্তে শর্করার মাত্রা কমাতে পারে (প্রাণী ও টেস্টটিউব গবেষণায় প্রমাণিত)। এর ফাইবার গ্লুকোজ শোষণ ধীর করে, যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য উপকারী।
• ওজন নিয়ন্ত্রণ: তেঁতুলের ফাইবার পেট ভরা রাখে এবং অতিরিক্ত খাওয়ার প্রবণতা কমায়। এতে ক্যালরি কম থাকায় ওজন কমানোর জন্য ডায়েটে যোগ করা যেতে পারে।
• ত্বক ও চুলের যত্ন: অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট ত্বকের বার্ধক্য প্রতিরোধ করে এবং ব্রণ কমায়। তেঁতুলের পানি ত্বক মসৃণ করতে ও সানবার্ন থেকে রক্ষা করতে ব্যবহৃত হয়। ভিটামিন বি ও জিঙ্ক চুলের গোড়া শক্ত করে খুশকি দূর করে।
• জয়েন্টের ব্যথা ও প্রদাহ কমায়: তেঁতুলের অ্যান্টিইনফ্ল্যামেটরি গুণাগুণ আর্থ্রাইটিস, গাউট বা জয়েন্টের ব্যথা উপশমে সাহায্য করে। গবেষণায় দেখা গেছে, তেঁতুলের নির্যাস প্রদাহ সৃষ্টিকারী এনজাইম (COX2) কমিয়ে দেয়।
• লিভার ও কিডনি ডিটক্স: তেঁতুলের অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট লিভারের বিষাক্ত পদার্থ দূর করতে সাহায্য করে। এটি প্রস্রাবের পরিমাণ বাড়িয়ে কিডনি থেকে টক্সিন বের করতে পারে (মৃদু ডাইইউরেটিক প্রভাব)।
• ঠান্ডা, কাশি ও গলার ব্যথায় উপকারী: তেঁতুলপানি গরম করে গার্গল করলে গলাব্যথা ও টনসিলের প্রদাহ কমে। ভিটামিন সি সর্দিকাশির লক্ষণ উপশমে ভূমিকা রাখে।
২০-৩০ গ্রাম তেঁতুল (বীজ ছাড়া) ১ গ্লাস গরম পানিতে ভিজিয়ে রাখুন ৩০ মিনিট। ভালো করে চিপে ছেঁকে নিন। স্বাদ অনুযায়ী সামান্য মধু বা গুড় মিশিয়ে দিনে ১-২ বার পান করুন।
তেঁতুলপানি সাধারণত নিরাপদ, তবে এর অম্লীয় প্রকৃতি গ্যাস্ট্রিক সমস্যা তৈরি করতে পারে। এ ছাড়া যাঁরা ইতিমধ্যে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ (যেমন ACE inhibitors) বা রক্তপাতরোধী ওষুধ (যেমন ওয়ারফারিন) গ্রহণ করছেন, তাঁদের জন্য তেঁতুলপানি অত্যধিক পান ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপে তেঁতুলের সরাসরি প্রমাণিত প্রভাব এখনো বৃহৎ পরিসরের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের মাধ্যমে যাচাই হয়নি। বর্তমান গবেষণাগুলো প্রাথমিক বা পরোক্ষ পর্যায়ে রয়েছে। তেঁতুলপানি অম্লীয় হওয়ায় অতিরিক্ত সেবনে গ্যাস্ট্রিক, অ্যাসিডিটি বা দাঁতের এনামেল ক্ষয় হতে পারে।
তেঁতুলপানি একটি সহায়ক উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে, কিন্তু এটি উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসার বিকল্প নয়। ওষুধ, ব্যায়াম, লবণনিয়ন্ত্রিত ডায়েট এবং চিকিৎসকের পরামর্শ প্রাথমিক গুরুত্ব পাবে। নতুন কোনো ঘরোয়া পদ্ধতি চেষ্টা করার আগে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করুন।
তথ্যসূত্র: জার্নাল অব এথনোফার্মাকোলজি, ফুড অ্যান্ড ফাংশান এবং ফাইটোথেরাপি রিসার্চে প্রকাশিত কয়েকটি গবেষণা।
লেখক: খাদ্য ও পথ্যবিশেষজ্ঞ, প্রধান নির্বাহী, প্রাকৃতিক নিরাময় কেন্দ্র