যারা একটি ফুলকে বাঁচাবে বলে
শেয়ার করুন
ফলো করুন

নাদিমা জাহান

কোন সে অদম্য উদ্দীপনায় বলীয়ান হয়ে দেশের সিভিলিয়ান বা সাধারণ মানুষ সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে! যুদ্ধ মানুষের ওপর কী প্রভাব রেখে যায়? যুদ্ধ শেষে কেন জীবন স্বাভাবিক হতে চায় না? যে কিশোরটি রক্ত দেখলে ভয় পায়, সে অস্ত্র হাতে নেয় শত্রুসেনাকে পরাস্ত করার প্রত্যয় নিয়ে। যে নরমসরম মানুষটি কারও গায়ে হাত পর্যন্ত তোলেন না, তিনি উল্লাসে ফেটে পড়েন যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর লাশ গুনতে গিয়ে। নিরীহ যুবকটি যুদ্ধে গিয়ে ভয়ডরের সংজ্ঞাই যেন ভুলে যান। দিনের পর দিন খাওয়াদাওয়ার কষ্ট, বহু নির্ঘুম রাত আর অসম্ভব কষ্টদায়ক দিনযাপন—এর কিছুই যেন কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না আরাম-আয়েশে বড় হওয়া মা-বাবার আদরের ধনীর দুলালটির ওপর।

বিজ্ঞাপন

যুদ্ধের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ নিয়ে সেই গত শতাব্দী থেকেই গবেষণা হয়ে আসছে।
আজ থেকে ঠিক ৫২ বছর আগে এই দিনেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে গোটা জাতি ঝাঁপিয়ে পড়ে যুদ্ধে। মুক্তির জন্য এরূপ যুদ্ধ যুগে যুগে হয়ে আসছে দুনিয়াজুড়ে। লিবারেশন সাইকোলজির জনক ইগনাচিও মার্টিন-বারো ১৯৮০ সালে এই মুক্তিকামী সাধারণ মানুষের স্বাধীনতা লাভের অদম্য আকাঙ্ক্ষা আর তা বাস্তবায়নে সংঘটিত আন্দোলন ও সম্মুখসমরে অংশগ্রহণ নিয়ে সাড়া জাগানো তত্ত্ব উপস্থাপন করেন সবার সামনে।

এল সালভাদরবাসী এই সোশ্যাল সাইকোলজিস্ট বলেন, দিনের পর দিন বঞ্চিত, অত্যাচারিত আর কোণঠাসা হতে থাকলে একসময় নিরস্ত্র আর আপাতদৃষ্টিতে দুর্বল ও নিরীহ সাধারণ জনগণ মরিয়া হয়ে ওঠে। এ সময় তারা অত্যন্ত শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলে, প্রত্যাঘাত করতে দ্বিধা করে না আর অদম্য শক্তিতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তেও পিছপা হয় না। সাধারণ সাইকোলজির তত্ত্বকে পেরিয়ে, ব্যক্তিস্বার্থের বাইরে গিয়ে গোষ্ঠীগত লক্ষ্যই সাধারণ মানুষকে যুদ্ধে অংশগ্রহণের উদ্দীপনা দেয়। ঠিক এ রকম ঘটনাপ্রবাহই দেখি আমরা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বঞ্চনার ইতিহাসে। আর ২৫ মার্চের কালরাত থেকে শুরু হওয়া পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ এ ক্ষেত্রে বিস্ফোরকের ভূমিকা পালন করেছে।

বিজ্ঞাপন

বিলেতের অক্সফোর্ড রিসার্চ সেন্টারের এক দীর্ঘ গবেষণা বলে, মানবিক আবেগের অনুভূতিগুলো যুদ্ধের ক্ষেত্রে অত্যন্ত জোরালো ভূমিকা রাখে। যুদ্ধে অংশ নেওয়া সবাই অত্যন্ত তীব্র সব মনস্তাত্ত্বিক অবস্থার মধ্য দিয়ে যায়। ভয়, শঙ্কা, ক্রোধ, আক্রোশ,  প্রতিশোধপরায়ণতা, জিঘাংসা—এমন সব নেতিবাচক অনুভূতি বিধ্বস্ত করে দেয় মনকে। আবার গৌরব, সাফল্যের গর্ব, জয়ের আনন্দ, উল্লাস, প্রতিশোধ নিতে পারার সন্তুষ্টির অনুভূতি একধরনের শক্তির সঞ্চার করে, ক্ষমতার অনুভূতি জাগায়।

বিশেষজ্ঞরা এই যুদ্ধের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবের সুদূরপ্রসারী ভূমিকার প্রমাণ বারবারই পেয়েছেন। ‘আবার তোরা মানুষ হ’ ছবির ঘটনার মতোই তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে, শিক্ষাজীবন আবার শুরু করতে বহু রকমের প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছেন। আর এর অনেকটা জুড়ে ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত মনের অপারগতা আর অদেখা ক্ষত। শারীরবৃত্তীয় লক্ষণ, যেমন হরমোনের ভারসাম্যহীনতা, শ্বাসকষ্টের অনুভূতি, অনিয়মিত হৃৎস্পন্দন, দৃষ্টি ও শ্রবণক্ষমতা হ্রাস, ইউরিনারি কন্ট্রোল হারানো, যৌনক্ষমতা হারানো ইত্যাদি খুবই বেশি দেখা যায় যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মানুষের মধ্যে।

সম্প্রতি বিভিন্ন গবেষণার ফলাফল থেকে দেখা যায়, ইমোশনাল ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি হয় যুদ্ধক্ষেত্রে। এ থেকে বিশ্বাসহীনতা, নিষ্ঠুরতা, হতাশা, অবসাদ, অপরিমিত দুশ্চিন্তা, অনিয়ন্ত্রিত রাগের মতো ভয়ংকর সব মানসিক কষ্টের সম্মুখীন হতে হয় সম্মুখসমর থেকে ফিরে আসা যোদ্ধাদের সারাটি জীবন ধরে। তবু মানুষ মুক্তি চায়, স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখে। হয়তো একটি ফুলকে বাঁচাবে বলেই মুক্তিযুদ্ধ করে।
তথ্যসূত্র: লিবারেশন সাইকোলজি নেটওয়ার্ক, অক্সফোর্ড রিসার্চ সেন্টার, সায়েন্টিফিক আমেরিকান।

নোট: সব ছবি প্রতীকী

ছবি: সালাহ আহমেদ

প্রকাশ: ২৬ মার্চ ২০২৩, ১২: ০৪
বিজ্ঞাপন