পর্ব ১
ইংল্যান্ডের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার তৃতীয় মাস্টার্স ডিগ্রি করার সময় খরচ চালানোর জন্য কয়েকটি কেয়ার হোমে কাজ করছিলাম। এর একটিতে বেশির ভাগ বৃদ্ধরা ছিলেন। তাঁরা ইহুদি এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শিশু, তরুণ বা তরুণী ছিলেন। অনেক অত্যাচারের মধ্য দিয়ে গেছেন তাঁরা। আমি দিনের শিফটে কাজ করতাম। মাঝেমধ্যে রাতের শিফটেও করতে হতো। দিনের বেলা যে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে খুব শান্ত–মিষ্টি করে কথা বলতে দেখেছি, তাঁরাই রাতের বেলা যেন দানব-দানবীতে পরিণত হতেন। এক নারী চিৎকার করে বলতেন, ‘ছেড়ে দাও আমাকে।’
তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, তিনি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে ছিলেন; কিন্তু ছাড়া পাওয়ার পর তাঁকে আর কেউ গ্রহণ করেনি। বরং তাঁকে দেশদ্রোহী বলতে শুরু করে। তিনি অনেক কষ্ট করে ইংল্যান্ডে পৌঁছান। এখানে এসে তিনি কাজ করেছেন, বাড়ি কিনেছেন; কিন্তু বিয়ে করেনি বা আর কোনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারেননি। দীর্ঘ সময়ের অত্যাচারের কারণে তাঁর নানা রকম শারীরিক ও মানসিক সমস্যা শুরু হয়। এ পৃথিবীতে আপনজন বলে তাঁর আর কেউ ছিল না।
আরেকজন ছিলেন, যিনি রাতে বিছানার ওপর দাপাতে থাকতেন। অনেকে রুম থেকে বের হয়ে এদিক–ওদিক ছুটে পালাতে চাইতেন। একজন বৃদ্ধ চিৎকার করে তাঁর মা–বাবাকে ডাকতেন। আরেকজন ছিলেন, রাত নয়টা বাজার আগে তাঁকে বাইরে থেকে তালা দিয়ে রাখা হতো। কারণ, তিনি অনেক ভায়োলেন্ট হয়ে হিটলারকে খুঁজতেন। আমি অবাক হয়ে তাঁদের অবস্থা দেখতাম। আমাদের বলা হতো, তাঁরা সবাই ডিমেনশিয়ায় ভুগছেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে পোস্ট–ট্রমাটিক ডিজঅর্ডার নিয়ে পড়তে গিয়ে বুঝেছি, তাঁরা আসলে পিটিএসডিতে ভুগছিলেন।
আমার আজকের লেখার বিষয়, পোস্ট–ট্রমাটিক ডিজঅর্ডার বা পিটিএসডি। এ জন্যই শুরুর ঘটনা আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করে নিলাম। এ বিষয় নিয়ে লেখার জন্য অবশ্য অনেকেই অনুরোধ করেছেন। কোনো মানুষ যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, হত্যা, হঠাৎ মৃত্যু; শারীরিক, মানসিক বা যৌন নির্যাতন, খুব বড় ধরনের ক্ষতি, ভয়ংকর কোনো পরিস্থিতি বা অত্যাচারের মধ্য দিয়ে গেলে তার মস্তিষ্কে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে। তখন তার চিন্তায়, ব্যবহারে বেশ কিছু নেতিবাচক পরিবর্তন আসে। তারা খুব ভয়ংকর স্বপ্ন দেখে জেগে যায়, ঘুমাতে পারে না, ক্রমাগত চিন্তা করে ট্রমা নিয়ে, অনিয়ন্ত্রিত চিন্তা আসতে থাকে, অ্যাংজাইটি অনেক বেড়ে যায়, অনিয়ন্ত্রিত কাঁপুনি হয়, ঘন ঘন মুড সুইং করে।
এ ছাড়া ডিপ্রেশন, রগচটা ভাব, চিৎকার—এ রকম অনিচ্ছাকৃত আচরণ শুরু হয়। অতিরিক্ত পরিমাণে স্ট্রেস হরমোন করটিসল ও অ্যাড্রিনালিন হরমোন নিঃসৃত হওয়ার কারণে পিটিএসডির মতো মানসিক রোগ হওয়া শুরু করে, যাতে মস্তিষ্কের এমিগডালা, হিপ্পোকেলামাস, প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স ও এন্টেরিওর সিঙ্গুলেট কর্টেক্সে পরিবর্তন আসে।
জেনারেশন–জির ২০ শতাংশই মানসিক রোগে আক্রান্ত এবং তাদের মধ্যে পিটিএসডি আছে। বাংলাদেশেও অনেকে, বিশেষত জেন–জিরা মানসিক রোগ বা পিটিএসডিতে আক্রান্ত। সদ্য ঘটে যাওয়া ঘটনাবলি নিয়ে দীর্ঘ সময় আতঙ্ক এবং অনিশ্চয়তায় থাকার কারণে এই সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। আমি নিজেই জুলাই–আগস্ট মাসে অনেক সেশন করিয়েছি আতঙ্ক থেকে বের করে নিয়ে আসার জন্য। বাংলাদেশিদের সঙ্গে অনেক বিদেশিও সেসব সেশনে যোগ দিয়েছিলেন। কারণ, সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে তাঁরা অনেক কিছু দেখতে ও জানতে পারছিলেন এবং তাঁরা মানসিকভাবে অসুস্থতা অনুভব করছিলেন।
পিটিএসডি হওয়ার অনেক কারণ আছে। আমি সাধারণত যেসব ভিকটিমকে নিয়ে কাজ করেছি তাদের মধ্যে একটি বড় অংশ যৌন নির্যাতনের শিকার। আমি কাজ করেছি শিশু (ছেলেমেয়ে) যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ, অফিসের বস দ্বারা মোলেস্টেশনের শিকার, ডমেস্টিক ভায়োলেন্সের শিকার, সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া, পরিবার ভেঙে যাওয়া, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর মা–বাবা, ছোটবেলায় মা–বাবা দ্বারা শারীরিক নির্যাতনের শিকার এবং যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের নিয়ে। আজকে আলোকপাত করার চেষ্টা করব যুদ্ধ ও কনফ্লিক্ট নিয়ে।
আমি কীভাবে যুদ্ধ নিয়ে কাজ করার ট্রেনিং পেয়েছি, তা জানি না। তবে যে কয়েক বছর কেয়ার হোমগুলোতে কাজ করেছি, সেখানে বেশির ভাগ বৃদ্ধ–বৃদ্ধা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে কথা বলতেন। তাঁদের অভিজ্ঞতা শোনাতেন। বছরের পর বছর তাঁদের অনুধাবন করেছি। তাঁদের কারও কখনো থেরাপি দেওয়া হয়নি। আমার শ্বশুর ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শিকার। যুদ্ধে বাবাকে হারান। অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছিলেন। যুদ্ধ শেষের অনেক পরে মা এসে নিয়ে গিয়েছিলেন; কিন্তু মা নিজেই ছিলেন ট্রমাটাইজড। অনেক সফল মানুষ ছিলেন তিনি। অথচ সময় পেলেই তাঁর ছোটবেলার কষ্টের কথা বলতেন। অনাথ আশ্রমে ভালোবাসাহীন আতঙ্কগ্রস্ত জীবনের কথা বলতেন। যুদ্ধ ও এর ট্রমা তাঁর মন থেকে কোনো দিন মুছে যায়নি।
আমি খুব কাছ থেকে কাজ করেছিলাম বাংলাদেশের বীরাঙ্গনাদের অধিকার আদায়ে। তখনো তাঁদের ভয়ংকর ট্রমাটিক জীবনের গল্প শুনে আমি নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। ইংল্যান্ডে প্রচুর শরণার্থী শিশু ও পরিবার আসে বিভিন্ন দেশ থেকে। আমি থাকি টিলবারি এলাকার কাছে। ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে অনেকে পালিয়ে আসে। পরবর্তী সময়ে কয়েক বছর পর একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের জন্য কাজ করেছি থেরাপিস্ট হিসেবে। এ ছাড়া ওই সময় আমি পিটিএসডিতে আক্রান্ত কিছু থেরাপিস্ট, সাইকোলজিস্ট, এনজিওকর্মীর সঙ্গে কাজ করেছি, যাঁরা একসময় ফিলিস্তিন, কঙ্গো ও সুদানে কাজ করেছেন।
এসব কাজের কারণেই কিনা জানি না, ইউক্রেন যুদ্ধের সময় পোল্যান্ডের বর্ডারে যে সাহায্যকারী দল, কি-ওয়ার্কার, থেরাপিস্ট, সাইকোলজিস্টরা কাজ করছিলেন, তাঁদের একটি দল আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে সাহায্য করার জন্য। কারণ, তারা শিশুদের মর্মান্তিক জীবন দেখে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। একদিকে এত মৃত্যু, এত আর্তনাদ, এত ধ্বংস, এত ক্ষুধা দেখে তারা আতঙ্কিত; অন্যদিকে কিছু না করতে পারার যন্ত্রণা তাদের কুরে কুরে খাচ্ছিল। পোল্যান্ডের বর্ডারে ইউক্রেনের শরণার্থীরা ছিল; আবার সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও আফগানিস্তানের শরণার্থীরাও ছিল। আমার ক্লায়েন্টদের সে দলটি পিটিএসডিতে ভোগার আরেকটি বড় কারণ ছিল বৈষম্যের ভয়াবহ রূপ দেখা। সেবা করতে চাইলেও তাদের হাত-পা বাঁধা ছিল। সেশনের সময় তাদের কাঁদতে, চিৎকার করতে, কিছু না করতে পারার জন্য আর্তনাদ করতে দেখেছি।
২০২০ সালে লকডাউনের সময় একটি কানাডিয়ান ছেলে আমার ক্লায়েন্ট হয়। সে একলা ঘরে নিজেকে মানাতে পারছিল না। সেশন করে বুঝতে পারলাম, সে আসলে পিটিএসডিতে আক্রান্ত। ইরাক যুদ্ধের সময় তারা পালাতে সক্ষম হয়েছিল। সে অনেক বেশি কাজ করে এবং নিজেকে অনেক ব্যস্ত রাখে। লকডাউনে সে একা থাকায় সারাক্ষণ যুদ্ধের গোলাগুলির শব্দ, মানুষের চিৎকার, আর্তনাদের শব্দ তাকে তাড়া করতে শুরু করে। তাদের ঘরে আগুন দেওয়া হয়েছিল। চোখের সামনে নিজের সব অস্তিত্ব নিঃশেষ হয়ে যেতে দেখেছে। কিন্তু তখন সে শিশু ছিল। সে বুঝতে পারছিল না কীভাবে সবকিছু তার মনে ছিল। এত সুদর্শন, এত ভালো চাকরি করেও কোনো সম্পর্কে জড়াতে পারছিল না। কারণ, সে কাউকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। পিটিএসডি এমন এক মানসিক অবস্থা, যাতে ওই রোগী বছরের পর বছর ভাবে যে সে এখনো বিপদে আছে বা এখনই তাকে মেরে ফেলা হবে।
বাংলাদেশের যুদ্ধ–পরবর্তী একটি বড় প্রজন্ম আসলে পিটিএসডির শিকার। আমি অনেক মুক্তিযোদ্ধার ছেলেমেয়ের ট্রমার ওপর কাজ করেছি। তাদের কাছ থেকে তাদের বাবাদের যুদ্ধ–পরবর্তী আচরণ ও হতাশার বিভিন্ন বর্ণনা থেকে এটা বুঝতে পেরেছি।
আমি ভলান্টিয়ারিং করেছিলাম আফগানিস্তানফেরত ব্রিটিশ আর্মিদের পিটিএসডির জন্য। ইংল্যান্ডে তখন পুলিশের জন্য পিটিএসডির স্কিবিডি থেরাপির ফান্ড থাকলেও আর্মিদের জন্য কিনেসিওলজি বা ট্রমা রিলিজের ফান্ড ছিল না। তবু তাদের সাহায্য করার চেষ্টা করেছিলাম। থেরাপিস্টরা বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করেন।
সেসব আর্মির ব্যবহারের সঙ্গে সন্তানদের বর্ণনায় বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহারের অনেক মিল খুঁজে পেয়েছি। আমি বছরের পর বছর কাজ করেছি বাংলাদেশে বিডিআর হত্যাকাণ্ডের ভিকটিম কিছু পরিবারের সঙ্গে। তাঁদের পরিবারের সদস্যরা এখনো ট্রমায় ভুগছেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পিটিএসডি আক্রান্ত সদস্যদের স্ত্রীদের সঙ্গেও কাজ করেছি। দীর্ঘ সময় ধরে তাঁদের পরিবার তাঁদের ঘৃণা করলেও যখন থেকে বুঝতে পারে যে মানুষটি আসলে পিটিএসডির শিকার; কিন্তু তিনি মানতে রাজি নন, তখন তাঁর পরিবার আর কিছু না পারলেও তাঁকে ক্ষমা করে দিতে পারে।
আমি কাজ করেছি পুলিশ বাহিনীর অনেক সদস্য এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের জন্য। কয়েক মাস আগে ঘটে যাওয়া ঘটনায় পিটিএসডির পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে। আজ আমি গবেষণাবিজ্ঞান নিয়ে বেশি কিছু লিখিনি। আজ আমি আপনাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছি পিটিএসডি আসলে কী। এ জন্য এতে আক্রান্তদের নিয়ে লিখেছি। তাদের সারা জীবনের মানসিক অস্থিরতা নিয়ে লিখেছি।
পিটিএসডি শুরু হয় যখন মানুষ তার শরীর, মন, অন্ন, বস্ত্র, ঘর, নিরাপত্তা, প্রিয়জন, তাদের স্বাস্থ্য, তাদের জীবন নিয়ে অন্য কাউকে ছিনিমিনি খেলতে দেখে এবং যখন তারা বুঝতে পারে তারা সম্পূর্ণ অসহায়। অথচ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হওয়ার কথা ছিল ভালোবাসা, দয়া, মায়া, সম্মান। সবাই সবাইকে একটু দয়া আর মায়া দিতে পারলে হয়তো পিটিএসডি বলে কোনো কিছু পৃথিবীতে থাকত না।
লেখক: একাধারে নেচারোপ্যাথিক ডাক্তার, পুষ্টিবিদ, কিনেজিওলজিস্ট, ট্রমা রিলিজ থেরাপিস্ট, অটিজম স্পেশালিস্ট, মাইন্ড সেট ট্রেইনার। তিনি কাজ করছেন লন্ডনের ১০, হারলে স্ট্রিট ক্লিনিক এবং অনলাইনেও আছে তাঁর উপস্থিতি।
ই–মেইল: [email protected]
ছবি: পেকজেলসডটকম