জাপানি জীবনধারার নানা অভ্যাস আমাদের শেখায় সুস্থতার জন্য বড় জিম বা জটিল ব্যবস্থা নয়, বরং লুকিয়ে আছে প্রতিদিনের ছোট ছোট, সহজ অথচ গভীর অভ্যাসে। এক বাটি গরম মিসো স্যুপ, কয়েক মিনিট প্রকৃতির মাঝে গিয়ে শান্তি খোঁজা কিংবা ধীরে ধীরে মনোযোগ দিয়ে খাবার খাওয়ার মধ্যেই নিহিত থাকে জীবনের প্রকৃত আনন্দ ও সুস্থতার রহস্য। এই সাধারণ, সুশৃঙ্খল অভ্যাসগুলোই আমাদের শরীর এবং মনকে স্বাভাবিক ও সুস্থ রাখতে পারে। এমন কয়েকটি জীবনাচারণের কথা বলা হলো এখানে।
সারা দিন কাজের চাপ ও মানসিক ক্লান্তি অনুভব করলে জাপানিরা কিছুক্ষণ হাতজোড় করে সোজা হয়ে বসে থাকে। এ অবস্থায় হাতজোড় করে থাকলে ডান থেকে বাঁ দিকে স্নায়ুবিক প্রবাহ সৃষ্টি হয়, যা শরীর ও মনের সতেজতা বাড়াতে সাহায্য করে।
‘ইন’ ও ‘ইয়াং’ চীনা দর্শন থেকে উদ্ভূত একটি ধারণা, যা প্রাকৃতিক জগতে আপাতদৃষ্টে বিপরীত দুটি শক্তির পারস্পরিক সংযোগ ও নির্ভরশীলতাকে বোঝায়। এটি দ্বৈততা ও পরিপূরকের প্রতীক, যা ইঙ্গিত দেয় বিপরীত শক্তিগুলো আসলে পরস্পরের সঙ্গে সংঘাতে নয়, বরং একে অপরকে ভারসাম্য ও সম্প্রীতির মধ্যে রাখে। এই ধারণা অনুযায়ী, বিশ্বে সবকিছুই পরস্পরবিরোধী হলেও একে অপরের পরিপূরক এবং একসঙ্গে তারা একটি পূর্ণতা সৃষ্টি করে। জাপানে ডান দিকে ইন এবং বাঁ দিকে ইয়াং ধরা হয়। এমন আধ্যাত্মিকতার বোধ জীবনকে নিঃসন্দেহে ইতিবাচক করে।
প্রতিদিনের খাবার গ্রহণের আগে জাপানিরা একটি ছোট্ট বাক্য বলে থাকে ‘ইতাদাকিমাসু’। এর অর্থ হচ্ছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। এই শব্দটি শুধু খাবারকে ধন্যবাদ দেওয়া নয়, বরং যাঁরা সেই খাবার উৎপাদন করেছেন অর্থাৎ চাষি, জেলে, যিনি রন্ধনশিল্পী, তাঁদের প্রতিও সম্মান এবং কৃতজ্ঞতা জানানোর একটি সংস্কৃতি। প্রতিটি ভোজের শুরুতে এই অভ্যাস আত্মবিশ্বাস, বিনয় এবং ইতিবাচক মনোভাবের সূচনা করে, যা দিনব্যাপী সুস্থ মানসিকতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।
সচেতনভাবে, ধীরে এবং মনোযোগ দিয়ে খাওয়ার অভ্যাস জাপানি সংস্কৃতিতে বিশেষভাবে গুরুত্ব পায়। তারা বিশ্বাস করে, প্রতিটি খাবারকে ধীরে ও যত্ন নিয়ে গ্রহণ করলে শুধু স্বাদই উপভোগ করা যায় না, বরং হজমপ্রক্রিয়াও অনেক উন্নত হয়। এ জন্য অনেক জাপানি প্রতিটি খাবারের অংশ মুখে নিয়ে অন্তত ১০০ বার পর্যন্ত চিবিয়ে খেতে অভ্যস্ত। চিকিৎসা ও পুষ্টিবিশেষজ্ঞদের মতে, খাবার ভালোভাবে চিবিয়ে খেলে লালা নিঃসরণ বাড়ে, যা খাদ্য পরিপাকে সাহায্য করে। এতে পেটের ওপর চাপ কম পড়ে এবং হজমপ্রক্রিয়া কার্যকর হয়। এই সহজ অথচ শক্তিশালী অভ্যাস মানসিক চাপও কমায় এবং ধীরে ধীরে শরীর ও মনের মধ্যে একটি ভারসাম্য সৃষ্টি করে। বলা যায়, ভালোভাবে চিবিয়ে খাওয়াই সুস্বাস্থ্যের মূল চাবিকাঠি।
জাপানিদের মধ্যে একটি জনপ্রিয় স্বাস্থ্যচর্চা হলো ‘শিনরিন-ইয়োকু’; যার অর্থ বনস্নান বা বনের মাঝে স্নান করা। এটি মূলত প্রকৃতির গভীরে গিয়ে মনোযোগ দিয়ে গাছপালা, পাখির ডাক, পাতার শব্দ, বাতাসের গন্ধ অনুভব করার মধ্য দিয়ে একপ্রকার ধ্যানময় অভিজ্ঞতা। এই প্রাকৃতিক অভ্যাস তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে গভীর প্রশান্তি আনে। গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত ‘শিনরিন-ইয়োকু’ মানসিক চাপ কমায়, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং মনকে প্রশান্ত করে তোলে। প্রকৃতির সঙ্গে এই ঘনিষ্ঠ সংযোগ জাপানিদের জীবনের ভারসাম্য ও মানসিক সুস্থতার অন্যতম গোপন রহস্য।
জাপানিদের দৈনন্দিন সুস্থতা অনুশীলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো লম্বা রুমাল বা টাওয়াল দিয়ে পিঠ ঘষা। তারা একটি তোয়ালে বা রুমাল লম্বালম্বি মুড়িয়ে দুই হাত পেছনে নিয়ে পিঠের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত মিনিটখানেক ঘষে। এই অভ্যাস তারা দীর্ঘদিন ধরে পালন করে আসছে, যা বিশেষত সকালে স্নানের সময় বা শরীর মুছতে গিয়ে করা হয়।
এই দৃশ্য আমাদের দেশে একসময় ছেলেবেলায় দেখা যেত। গা ধোয়ার পর মফস্সল বা গ্রামে অনেকেই গামছা দিয়ে পিঠ ঘষতেন। জাপানি গবেষণা অনুযায়ী, ভেজা শরীরে এভাবে তোয়ালে দিয়ে পিঠ ঘষলে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায়, চামড়ার কোষে অক্সিজেন পৌঁছায় এবং স্নায়ুতন্ত্র উদ্দীপ্ত হয়। এটি শুধু রক্ত চলাচল নয়, বরং সজীবতা, সতেজতা ও রোগ প্রতিরোধক্ষমতাও বাড়াতে সাহায্য করে। এই সহজ অথচ কার্যকর অভ্যাস স্বাস্থ্যসচেতনতার এক চমৎকার উদাহরণ।
জাপানি সংস্কৃতিতে ঘর পরিষ্কার করাকে শুধু গৃহস্থালি কাজ হিসেবে দেখা হয় না, বরং এটি একটি ধ্যান বা মেডিটেটিভ অভ্যাস হিসেবে ধরা হয়। ঘর ঝাড়ু দেওয়া, ধুলা মোছা, জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখা, এসব কাজ তারা অত্যন্ত মনোযোগ ও যত্নসহকারে করে থাকে। এই প্রক্রিয়ায় শুধু বাহ্যিক পরিচ্ছন্নতাই অর্জিত হয় না, বরং মন এবং চিন্তার জটিলতা থেকেও একধরনের মুক্তি মেলে। ঘর গোছাতে গিয়ে মানুষ নিজের ভেতরের অস্থিরতা, চিন্তা এবং আবর্জনাকেও যেন একভাবে সরিয়ে ফেলে। জাপানিরা বিশ্বাস করে, পরিচ্ছন্ন পরিবেশ মানেই পরিচ্ছন্ন মন এবং এই অভ্যাস মানসিক প্রশান্তি ও আত্মনিয়ন্ত্রণের একটি উপায়।
জাপানি খাদ্যসংস্কৃতিতে গাঁজানো খাবারের বিশেষ গুরুত্ব আছে। মিসো স্যুপ, নাট্টো, জাপানি আচার, ৎসুকেমোনো (Tsukemono) এই ধরনের খাবার শুধু স্বাদে বৈচিত্র্য আনে না, বরং স্বাস্থ্যের জন্যও অত্যন্ত উপকারী। গাঁজন প্রক্রিয়ায় প্রস্তুত এ সব খাবারে থাকে উপকারী ব্যাকটেরিয়া বা প্রোবায়োটিকস, যা হজমে সহায়তা করে এবং অন্ত্রের স্বাস্থ্য ভালো রাখে। আধুনিক পুষ্টিবিজ্ঞান বলে, সুস্থ অন্ত্র মানেই রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি। জাপানিরা দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় এই ধরনের খাবার অন্তর্ভুক্ত করে শরীর ও মনের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখে, যা তাদের দীর্ঘায়ু ও স্বাভাবিক জীবনের রহস্যের একটি মূল উপাদান।
জাপানি জীবনধারার অন্যতম মূলমন্ত্র হলো সরলতা এবং সংযম। খাবার, পোশাক, ঘরবসতি কিংবা দৈনন্দিন রুটিন, সবকিছুতেই তারা অপ্রয়োজনীয় জটিলতা এড়িয়ে চলে।
তাদের খাদ্যতালিকায় সাধারণত মৌসুমি, হালকা, পরিমিত পরিমাণে খাবার থাকে। পোশাকে থাকে পরিশীলিত সৌন্দর্যবোধ ও স্বস্তি। ঘর সাজাতে ব্যবহৃত হয় প্রয়োজনীয় ও কার্যকর জিনিসপত্র। এই সরলতা শুধু বাহ্যিক নয়, বরং মনের ভেতরেও একধরনের স্থিতি ও প্রশান্তি আনে। ঘর সাজাতে পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপাদান ব্যবহার করে ঘর সাজাতে দেখা যায় জাপানিদের।
সংযম চর্চার মাধ্যমে তারা আত্মনিয়ন্ত্রণ, ধৈর্য এবং মিতব্যয়ী জীবনের অভ্যাস গড়ে তোলে। গবেষণায় দেখা গেছে, এই জীবনচর্চা দেহ-মনের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং দীর্ঘস্থায়ী সুস্বাস্থ্যের ভিত্তি তৈরি করে। জাপানিদের কাছে সত্যিকারের স্বাস্থ্য মানে শুধু রোগমুক্ত থাকা নয়, শারীরিক সক্ষমতা ও মানসিক স্বাচ্ছন্দ্যে ভরা জীবন। আর এই পথের মূল চাবিকাঠি—সরলতা ও সংযম। জাপানিদের বাড়ি কাঠের হয়, তাদের আসবাবপত্রে ছিমছাম মিনিমালিস্টিক ব্যাপার লক্ষণীয়। বিভিন্ন ধরনের ভেষজ চা পান এবং বিশেষ করে মা মুড়ে বসে (বজ্রাসনের ভঙ্গিতে) মেরুদণ্ড সোজা রেখে খাদ্য বা পানীয় গ্রহণ তাঁদের পরিপাকতন্ত্রকে রাখে শক্তিশালী।
জাপানি জীবনধারায় একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি হলো; সব সময় পেট ভরে খাওয়া সুস্থতা নয়। মাঝেমধ্যে ডেজার্ট বাদ দেওয়া কিংবা এক বেলা হালকা অথবা না খাওয়া তাদের স্বাস্থ্য রুটিনের অংশ হতে পারে। এটি কেবল শরীরকে বিশ্রাম দেওয়ার জন্য নয়, বরং আত্মনিয়ন্ত্রণ ও সংযম অনুশীলনের একটি উপায়। আধুনিক পুষ্টিবিজ্ঞানেও বলা হয়, কখনো কখনো অল্প সময়ের উপবাস বা হালকা আহার শরীরের বিপাকপ্রক্রিয়া উন্নত করে, হজমে সহায়তা করে এবং কোষের মেরামত কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করে।
এভাবে সচেতনভাবে খাওয়া-না খাওয়ার মধ্যে ভারসাম্য আনা শুধু শারীরিক নয়, মানসিকভাবেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এটি আমাদের শেখায় স্বাস্থ্যবান জীবনের জন্য কখন খাবেন আর কখন বিরতি নেবেন, সেই সিদ্ধান্তটিও গুরুত্বপূর্ণ। খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রায় মিতব্যয়িতা মানসিক শান্তি এনে দেয়।
ছবি: উইকিপিডিয়া, ইনসটাগ্রাম ও পেকজেলসডটকম