৫৬ হাজার বর্গমাইলের দেশে যখন প্রায় ৩৫ লাখের বেশি মানুষ মাদকাসক্ত এবং মাদকাসক্তদের প্রায় ৮০ শতাংশই ১৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী কিশোর ও যুবক। শিশু পর্নোগ্রাফি কনটেন্ট তৈরি ও শেয়ার করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। করোনা–পরবর্তী সময়ে শিশু-কিশোরদের মধ্যে মোবাইল আসক্তি অনেক গুণ বেড়েছে।
অথচ আমরা জানি না এই ধরনের আসক্তির মূল হোতা কে? উত্তরটা হলো, ‘ডোপামিন’ নামের একধরনের রাসায়নিক উপাদান, যা আমাদের মস্তিষ্কের ভেতর তৈরি হয়। আমাদের আনন্দ, ভালো লাগা ও প্রেরণার মতো সুখের অনুভূতিগুলো তৈরির পেছনে ডোপামিন কাজ করে। আমাদের মস্তিষ্কের একটি নির্দিষ্ট অবস্থানে রয়েছে ‘রিওয়ার্ড সার্কিট বা পুরস্কার অনুভূতি’। নিদিষ্ট কোনো কাজ বা কিছু সেবনে এই ডোপামিন নিঃসরণ ঘটে এবং ব্যক্তি ওই নির্দিষ্ট কাজ বা সেবনকে উপভোগ করে পরবর্তী সময়ে তা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলেই আসক্তির সৃষ্টি হয়।
কীভাবে কাজ করে ডোপামিন? এমন প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, কেউ যদি মুঠোফোনে গেমস খেলে বা মাদক সেবন করে, তখন তাঁর মস্তিষ্কে ডোপামিনের নিঃসরণ ঘটিয়ে মুহূর্তেই ভালো লাগা তৈরি করে। কিন্তু ধীরে ধীরে সমপরিমাণ ডোপামিন নিঃসরণ কমে যায় ও ভালো লাগার অনুভূতি কমতে থাকে। তাই একই রকম ভালো লাগার জন্য ব্যক্তিকে আগের চেয়ে বেশি সময় খেলা অথবা মুঠোফোন ব্যবহার বা মাদক সেবন বাড়াতে হয় এবং আসক্তিতে পরিণত হয়।
মনোবিজ্ঞানীরা এই ডোপামিনের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের জন্য একধরনের পদ্ধতির কথা বলেছেন, যা ডোপামিন ডিটক্স বা ডোপামিন–উপবাস বলে। ডোপামিন–উপবাসের লক্ষ্য হলো আধুনিক জীবনযাত্রার ক্ষতিকর উদ্দীপক, যেমন মাত্রাতিরিক্ত প্রযুক্তি ব্যবহার, মাদক সেবন, অতিরিক্ত কেনাকাটা, জুয়াখেলা, পর্নোগ্রাফি দেখা ইত্যাদি থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ফেলাকে বোঝায়। এই উপবাসের মধ্য দিয়ে আমাদের মস্তিষ্ককে অল্প সময়ের জন্য রিচার্জ করার সুযোগ থাকে।
রোজা বা উপোস সম্পর্কে আমাদের সবার ধারণা আছে, রোজারত অবস্থায় যেকোনো রকমের পানাহার থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকতে হয়, ঠিক তেমনটা হয় ডোপামিন–উপবাসে। যেখানে নিজের কোনো আসক্তি বা আচরণ থেকে নিজেকে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সম্পূর্ণভাবে দূরে রাখাকে বোঝায়। আর এই ধরনের আসক্তি থেকে দূরে রাখার কারণে ডোপামিন নিঃসরণ কম হয়। ফলে ভালো লাগা কমে যায়, ডোপামিন নিয়ন্ত্রণে থাকে। কিন্তু এই ভালো না লাগা কম কষ্টদায়ক করার জন্য আর্টথেরাপিস্টরা শৈল্পিক কিছু কাজ করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন, যাকে শৈল্পিক ডোপামিন–উপবাস বলে। আসক্তিজনিত কাজ বন্ধ করে বিভিন্ন আর্ট মাধ্যমে ব্যবহার করা, যেমন ছবি আঁকা, মাটি দিয়ে কিছু তৈরি করা, কোলাজ করা, ছবি তোলা ইত্যাদি।
২০১৭ সালের জুনে ড্রেক্সেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, আঁকা, রং করা ও ডুডলিং সবই মস্তিষ্কের রক্তপ্রবাহ ও পুরস্কারে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। তাহলে বোঝা যাচ্ছে যে শৈল্পিক বা সৃজনশীল কাজ আসক্তিযুক্ত ডোপামিন নিঃসরণে একদিকে বাধা দেয় ও অন্যদিকে আসক্তিহীন শুদ্ধ জীবনাচরণকে অনুপ্রাণিত করে। বিভিন্ন ধরনের আর্টথেরাপির কৌশল আছে ডোপামিন ডিটক্সে প্রয়োগের জন্য। তবে আমি এখানে একটি আর্টথেরাপির কৌশল নিয়ে আলোচনা করব; এটা হলো ‘একটি ভালো দিনের দৃষ্টিভঙ্গি’ শিরোনামের কোলাজ।
যাদের জন্য: ১৪ বছরের বেশি বয়সীরা
উপকরণ
• কিছু লেখা বা ছবিসংবলিত পুরোনো খবরের কাগজ, পুরোনো ম্যাগাজিন অথবা বিভিন্ন উপাদান
• আঠা
• কাঁচি
• শক্ত কাগজ ও কার্ডবোর্ড বা ভিশনবোর্ড
• জার্নাল বা কাগজ ও কলম
কোলাজ তৈরির প্রক্রিয়া
ধাপ ১: আপনি একটি ভালো দিনের কথা ভাবুন
ধাপ ২: দিনটিকে উপস্থাপন করে এমন কিছু ছবি, লেখা পুরোনো খবরের কাগজ বা পুরোনো ম্যাগাজিন থেকে কার্টুন অথবা অন্যান্য লেখা বা ছবি, মুঠোফোনে তোলা কোনো ছবি, ফেসবুকের কোনো স্ট্যাটাসের ছবি ইত্যাদি নির্ধারণ করতে হবে।
ধাপ ৩: তারপর ছবিগুলো মোটা শক্ত কাগজ বা কার্ডবোর্ডে আঠা দিয়ে লাগিয়ে ফেলতে হবে।
ধাপ ৪: ছবিসংবলিত কার্ডবোর্ডটি সংরক্ষণ করতে হবে। ধাপ ৫: কোলাজটি দেখতে দেখতে কিছু প্রশ্নের উত্তর জার্নাল বা কাগজে লিখে ফেলতে হবে।
যেমন—
১. কোলাজটি দেখে কী মনে হচ্ছে?
২. কোলাজটিতে কী কী বিষয় ফুটে উঠেছে?
৩. আর কী কী থাকলে দিনটি আরও ভালো হতে পারত?
৪. এই কোলাজ থেকে কী কী শিখলাম, যা নিজের দৈনন্দিন জীবনে প্রতিদিন অনুশীলন করে অনেক ভালো দিন উপহার হিসেবে পাওয়া সম্ভব হবে বলে মনে করি?
এমন অনেক শৈল্পিক ডোপামিন–উপবাস কৌশল প্রয়োগে দূর হোক আসক্তি, প্রয়োগ হোক প্রাকৃতিক শক্তি ও বেঁচে থাকুক আমাদের আজকের আগামী এই প্রত্যাশা থাকল।
ছবি: পেকজেলসডটকম