ঢাকার বাতাস চরম দুর্যোগপূর্ণ। আমরা অনেকেই চরম অসুস্থ হয়ে পড়ছি অ্যাজমা, অ্যালার্জি আর শ্বসনতন্ত্রের প্রদাহ ও সংক্রমণে। আগে থেকেই যাদের এই সমস্যাগুলো আছে, তাদের অবস্থা আরো ভয়াবহ। আসলে কতটা দূষিত ঢাকার বাতাস এখন? জানতে হলে কিছু সহজ বিষয় বুঝে নিতে হবে।
কোনো এলাকার বাতাস কতটা দূষিত ও ক্ষতিকর তা বোঝানোর জন্য একটি ইনডেক্স ব্যবহার করা হয় বিশ্বব্যাপী। একে বলা হয় একিউআই যার অর্থ এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স।বায়ুদূষণের পরিস্থিতি নিয়মিত তুলে ধরে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ার। বাতাসের মান নিয়ে তৈরি করা এই লাইভ বা তাৎক্ষণিক সূচক একটি নির্দিষ্ট শহরের বাতাস কতটা নির্মল বা দূষিত, সে সম্পর্কে মানুষকে তথ্য দেয় ও সতর্ক করে। আবার অ্যাকুওয়েদারসহ বেশ কিছু ওয়েবসাইট বিশ্বের বিভিন্ন জায়গার লোকেশনভিত্তিক রিয়েল টাইম একিউআই দেখায়। তার মানে আপনি ঠিক কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ে কোনো একটি স্থানের বাতাসের মানের একটি নির্দেশক সং্খ্যা পাবেন এখান থেকে। যেমন এই প্রতিবেদনটি তৈরি করার সময়, ১১ ডিসেম্বর বেলা ১২ টায় অ্যাকুওয়েদার এর ডাটা অনুযায়ী ঢাকার একিউআই দেখাচ্ছে ২০৪।
স্কেল অনুযায়ী এটিকে আনহেলদি বা খুবই অস্বাস্থ্যকর বলা হচ্ছে। এই ইনডেক্সে ৩০০ স্কোরের বেশি দূষণযুক্ত বাতাসকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে লেবেল করা হচ্ছে। বিশেশজ্ঞরা বলেন, পর পর তিন দিন এমন হলে দুর্যোগপূর্ন আবহাওয়ার সতর্কতা জারী করতে হয় ওই এলাকায়।
অ্যাকুওয়েদারে বলা হচ্ছে, এখন ঢাকার বাতাসে বের হলে যাদের আগে থেকে শ্বসনতন্ত্রের ক্রনিক সমস্যা আছে, তাদের বিপদ হতে পারে৷ আর সাধারণ মানুষের শ্বাসকষ্ট ও গলায় অস্বস্তি হতে পারে। আরো বলা হচ্ছে, ঢাকার বাতাসের দূষণের মূল উৎস ফাইন পার্টিকুলেট ম্যাটার বা সুক্ষ্ম কণা,যেগুলো বাতাসে ভেসে বেড়ায় ও আমাদের শ্বসনতন্ত্রে বিনা বাধায় প্রবেশ করে বিপদ ঘটায়। এগুলোর ব্যাস আড়াই মাইক্রোমিটারের চেয়ে কম। এখনকার হিসাবে প্রতি বর্গমিটার বাতাসে এখানে ৯৫ মাইক্রোগ্রাম এমন সূক্ষ্ম কণা ভেসে বেড়াচ্ছে৷ অন্যান্য পার্টিকুলেট ম্যাটার বা কণাও প্রতি বর্গমিটারে ১৪০ মাইক্রোগ্রাম, যা অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর বাতাসের ইন্ডিকেটর।
এগুলোর ব্যাস ১০ মাইক্রোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। এসব কণা আসলে কলকারখানা, ইটের ভাটির অপরিশোধিত ফিউম, যেখানে সেখানে পোড়ানো প্লাস্টিক বর্জ্যের ধোঁয়া, ত্রুটিপূর্ণ ইঞ্জিনের অসম্পূর্ণ দহনের ভেজালযুক্ত জ্বালানির রেসিডিউ আর অপরিকল্পিত নগরায়নের হাজারে বিজারে চলতে থাকা নির্মাণকাজের ফলেই সৃষ্টি হয়৷ আর শুষ্ক আবহাওয়া ও গাছপালার নিদারুণ অভাবের কারণে এই কঠিন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে ঢাকায়।
বেশ কিছুদিন ধরে একেবারে দূষণের শীর্ষস্থান ঢাকা নগরীর দখলেই। এবারে আসুন জেনে নেই এই দূষণকে সিগারেটের সং্খ্যা দিয়ে প্রকাশ করার প্রসঙ্গে৷ আসলে অনেক সময় অবস্থার ভয়াবহতা না বোঝালে কাজ হয় না সহজে। গণসচেতনতার ক্ষেত্রে এ কথা শতভাগ সত্য। জেসমিন দেব নামের একজন গবেষক বার্কলি বিশ্ববিদ্যালয়ের টিমের সঙ্গে কাজ করে একটি সহজ অনলাইন ক্যালকুলেটর তৈরি করেছেন। বার্কলি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা টিমে ছিলেন রিচার্ড মিলার ও এলিজাবেথ মিলার নামের দুই আবহাওয়াবিদ। এখানে কোনো একটি সময়ের একিউআই আর কতক্ষণ বাতাসের সংস্পর্শে থাকা হচ্ছে সেই সং্খ্যার সমন্বয়ে কয়টি সিগারেট খাওয়ার সমান ক্ষতি হচ্ছে সে হিসাব করা হয়।
জেসমিন এখানে বলেছেন, সব সিগারেট এক না আর সব জায়গার দূষণের ধরনও আলাদা৷ তবে এই হিসাব থেকে আমরা কিছুটা ধারণা পাব আসলে কতটা ক্ষতিকর কোনো এলাকার বাতাস। জেসমিন দেবের চার্ট অনুযায়ী, মোটা দাগে, একিউআই ৬৪ হলে সারাদিনে (২৪ ঘন্টায়) একটি সিগারেট খাওয়ার সমান ক্ষতি হয়। ঢাকার বাতাসে এখন প্রায়ই ২০০-৩০০ থাকছে এই মান। তাই সারাদিনে ৬-১২টি সিগারেটের সমান ক্ষতি হচ্ছে আমাদের। আর এর মধ্যেই প্রায় একিউআই ৪০০ উঠে গিয়েছিল একটি নির্দিষ্ট সময়ে। সে অনুযায়ী দিনে প্রায় ২২টি সিগারেট খাওয়ার সমান ক্ষতি হওয়ার কথা আমাদের। আর এই সং্খ্যাটিই ভাইরাল হয়ে ঘুরছে সামাজিক মাধ্যমে। অনলাইন ক্যালকুলেটরের হিসাবে, ৪০০ একিউআইয়ের জন্য ২৪ ঘন্টা এক্সপোজার হলে এই ২২টি সিগারেটের সমান ক্ষতি হয়। কমবেশি হলেও এই হিসাবটি আসলেই ভীষণ আশঙ্কাজনক।
সূত্র: জেসমিনদেব ডট গিটহাব ডট আইও, দ্য হিল, অ্যাকুওয়েদার
ছবি প্রথম আলো