কোরবানি ঈদ, গরুর মাংস খাবেন, নানা পদের। দিনে একাধিকবার খাবেন। মনে রাখবেন আপনার পেট কিন্তু একসঙ্গে এত মাংস হজম করার শক্তি রাখে না। যার কারণে গরুর মাংস খেয়ে পেট ফাঁপা, গ্যাস বা অস্বস্তিতে ভুগতে পারেন। আমাদের শারীরবৃত্তীয় কিছু নীতি আছে; সেই সঙ্গে হজমের একটি মেকানিজম ও নিয়ম আছে। আমরা কেন জানি ঈদের সময় গরুর মাংস খাওয়ার ক্ষেত্রে এগুলো ভুলে যাই। পেট সহ্য না করতে পেরে একসময় বিগড়ে যায়। ঠিক উৎসবের সময় পেট বিগড়ে গেলে সত্যি বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। আর এই পরিস্থিতির মখোমুখি হতে না চাইলে কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে। তাহলেই উৎসব হবে আনন্দময় ।
• প্রোটিন হজমে সময় লাগে: গরুর মাংস মূলত অত্যন্ত ঘন প্রোটিন এবং স্যাচুরেটেড ফ্যাটে পরিপূর্ণ। হজমের জন্য গ্যাস্ট্রিক অ্যাসিড ও এনজাইম (যেমন পেপসিন) প্রয়োজন হয়। যদি এই এনজাইম পর্যাপ্ত পরিমাণে না থাকে (বিশেষ করে বয়স্ক বা অজীর্ণ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে), তবে মাংস হজম না হয়ে আন্ত্রিক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা গাঁজন হয়ে গ্যাস তৈরি করে।
• চর্বি ও তেল বেশি হলে হজম ধীর হয়: চর্বিযুক্ত মাংস হজমে অনেক বেশি সময় নেয়। এতে পেট ভারী লাগে, অম্বল হয় এবং গ্যাস তৈরি হয়।
• ফাইবারের অভাব: মাংসে আঁশ বা ফাইবার থাকে না। ফলে এটি পাচনতন্ত্র দিয়ে ধীরে সরে এবং বর্জ্য বের হতে বিলম্ব হয়। এতে করে কোষ্ঠকাঠিন্য ও গ্যাস হয়।
• মাংস সংরক্ষণের কারণে গ্যাস হতে পারে: কোরবানির সময় মাংস দীর্ঘক্ষণ বাইরে রাখা হলে, কিছু ব্যাকটেরিয়া (ক্লোসট্রিডিয়াম, ই কোলি ইত্যাদি) বাড়তে পারে। এমন মাংস খেলে হালকা ফুড পয়জনিং বা গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ইনফ্ল্যামেশন হতে পারে, যার লক্ষণ হলো—গ্যাস, পেট ফাঁপা, ব্যথা, বমি বা ডায়রিয়া।
• পেট ফুলে থাকা। মনে হচ্ছে আপনার পেটে গ্যাস আটকে থাকা, হজম না হওয়া বোঝায়।
• ঢেকুর ওঠা মানে হচ্ছে অ্যাসিড রিফ্লেক্স বা অতিরিক্ত অ্যাসিড হওয়া। অতিরিক্ত অ্যাসিড নির্গমনের রাস্তা না পেয়ে ওপর দিকে ঠেলে দেয়।
• পেট কামড়ানো মানে হচ্ছে আপনি খাদ্য হজম করতে পারেনি; যার কারণে গড়গড় শব্দ হয়; মূলত খাদ্য পচে গ্যাস তৈরি করলে এমন হয়।
• অম্বল বা বুকজ্বালা হলো চর্বিযুক্ত খাবার মাত্রার অতিরিক্ত খাওয়ায় অ্যাসিড বৃদ্ধি; এ জন্য বুকজ্বালা।
এমন শারীরিক অবস্থা হলে ঘরোয়া প্রতিকারে উপকার পাওয়া যাবে।
• আদা: প্রাকৃতিক হজমকারী। এনজাইম উদ্দীপক আদায় থাকে জিনজেরল ও শোগাওল—এগুলো হজম রস বাড়িয়ে খাদ্য ভাঙতে সাহায্য করে এবং পেটের পেশি শিথিল করে গ্যাসমুক্ত করে।
ব্যবহার: ১ কাপ গরম পানিতে কয়েক টুকরা আদা ছেঁচে ৫ মিনিট রেখে ছেঁকে পান করুন। খাওয়ার আধাঘণ্টা পর এই আদাপানি পান করুন।
• জিরা: হজম ও গ্যাস নিরসনে সহায়ক। জিরা হজমে সহায়ক এনজাইম নিঃসরণ বাড়ায়; যেমন অ্যামাইলেজ, যা স্টার্চ ভাঙে। এ ছাড়া এটি অন্ত্রের পেশি শিথিল করে গ্যাসমুক্ত করতে সাহায্য করে।
ব্যবহার: এক কাপ পানিতে এক চামচ জিরা দিয়ে চায়ের মতো জ্বাল দিন, তারপর ঠান্ডা হলে চায়ের মতোই ধীরে ধীরে পান করুন।
• পুদিনা অ্যান্টিস্পাসমোডিক এজেন্ট, পুদিনায় রয়েছে মেনথল, যা পেটের পেশি শান্ত করে এবং গ্যাসের চাপ কমায়। মাংস খাওয়ার সময় পুদিনার চাটনি, সালাদ বানিয়ে খেতে পারেন তাতে পেট ফাঁপা করবে না।
• হলুদ: প্রদাহনাশক ও পিত্তরস উদ্দীপক, কারকুমিন নামক উপাদানটি লিভার থেকে পিত্তরস নিঃসরণ বাড়ায়, যা চর্বি হজমে সহায়তা করে। এটি অন্ত্রের প্রদাহ কমিয়ে হজমপ্রক্রিয়া স্বাভাবিক করে।
ব্যবহার: পেট বেশি সমস্যা করলে খাওয়ার আধাঘণ্টা পর এক কাপ গরম পানিতে আধা চামচ হলুদগুঁড়া মিশিয়ে ৫ মিনিট রেখে দিন, তারপর খেয়ে নিন।
• তোকমা: অন্ত্র পরিষ্কার করে। আঁশযুক্ত বীজ হওয়ায় এটি অন্ত্র পরিষ্কার রাখে ও বর্জ্য সহজে বের করে দেয়। এতে হজমজনিত গ্যাস কম হয়।
ব্যবহার: রাতে খাওয়া শেষে এক কাপ পানিতে এক চা–চামচ পরিমাণ তোকমা এক মিনিট ভিজিয়ে রেখে খেয়ে ফেলুন। সকালে অন্ত্র পরিষ্কার করে দেবে।
সবকিছুর মূল হচ্ছে পরিমিত আহার। তাই উৎসব হোক আর মাংস খাওয়ার ধুম, খেতে হবে পরিমিত। তাহলেই আপনার শরীর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকবে। কেবল রসনাতৃপ্তি করলেই হবে না, শরীরের কথাও ভাবতে হবে। কোনো কারণে একটু বেশি খেয়ে অস্বস্তিতে ভোগার চেয়ে এই উপায়গুলো মেনে চলতে পারেন।
লেখক: খাদ্য ও পথ্য বিশেষজ্ঞ; প্রধান নির্বাহী, প্রাকৃতিক নিরাময় কেন্দ্র
ছবি: পেকজেলসডটকম