২০০৪ সালে যখন স্মার্টফোন সহজলভ্য ছিল না, তখন মানুষ গড়ে আড়াই মিনিট মনোযোগ ধরে রাখতে পারত। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার সাইকোলজিস্ট ড. গ্লোরিয়া মার্কের মতে, মানুষ এখন মনোযোগ দিতে পারে মাত্র ৪৭ সেকেন্ড। তবে মাইক্রোসফটের গবেষণা বলছে, মানুষের একটা কাজে মনোযোগ ধরে রাখার ক্ষমতা মাত্র ৮.৫ সেকেন্ড।
মনোযোগ ধরে রাখার সময় নিয়ে দ্বন্দ্ব থাকতেই পারে। তবে মনোযোগ দিয়ে কোনো কাজ করার হার যে আমাদের দিন দিন কমে যাচ্ছে, এ ব্যাপারে দ্বিমত হয়তো কেউই করবেন না। কোনো কিছু করতে গেলে কে আর আজকাল একটা কাজে মনোযোগ দিতে পারেন? আমাদের পিসিতে সর্বক্ষণ একসঙ্গে কয়েকটা ট্যাব খোলা থাকে।
কাজের মধ্যে ফেসবুকে, টিকটক, ইন্সটাগ্রামে ঢুঁ না মারলে আমাদের চলেই না। ম্যাসেজের একটা টিং শব্দ আমাদের কাজের গভীর মনোযোগও শেষ করে দেয় এক সেকেন্ডেই। এমনকি আমরা পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে গেলেও ফোনেই যেন ব্যস্ত থাকি। মোবাইলের কাছে থাকতে গিয়ে আমরা যেন বাকি সবকিছুকে দূরে ঠেলে দিচ্ছি নিজের অজান্তেই।
তবে আপনি চাইলেই নিজের মধ্যে নিয়ে আসতে পারেন পরিবর্তন, বাড়াতে পারেন নিজের মনোযোগ। চলুন জেনে নিই কিছু বিজ্ঞানসম্মত উপায়, যা আমাদের মনোযোগ দেয়ার ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।
যদিও মাল্টিটাস্কিং বা একসঙ্গে একাধিক কাজ করাকে অনেকে একটি ভালো দক্ষতা মনে করেন, তবে এটি আপনার সামগ্রিক কাজের দক্ষতা কমিয়ে দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে, যাঁরা একই সময়ে একটি কাজই করেন, তাঁদের তুলনায় যাঁরা মাল্টিটাস্কিং করেন, তাঁরা সহজেই কাজে মনোযোগ হারিয়ে ফেলেন। একসঙ্গে দুইটি কাজ করে আপনি কিছুসময়ের জন্যে ভাবতে পারেন, আপনি দক্ষতার সঙ্গে কাজগুলো করেছেন। কিন্তু এটা আসলে হয় না। মনোযোগ বাড়াতে একসঙ্গে একটা কাজেই মনোযোগ দিন।
গবেষণায় দেখা গেছে, মেডিটেশন বা ধ্যান মনোযোগ ধরে রাখতে এবং বাড়াতে সাহায্য করে। মেডিটেশনের চর্চা আমাদের মনোযোগকে নানা দিক থেকে সরিয়ে একদিকে কেন্দ্রীভূত করতে সাহায্য করে। এতে মনোযোগ ধরে রাখার ক্ষমতা বাড়ে এবং নানান দিকে আমাদের চিন্তা সরে যাওয়ার মাত্রা কমে। দীর্ঘদিন মেডিটেশন অনুশীলন করলে স্মৃতিশক্তিও উন্নত হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, কাজে মনোযোগ ধরে একটা কার্যকর মাধ্যম গান শোনা। কথা ছাড়া গানের সুর কাজে বাধা সৃষ্টি করে না। বরং এই সুর আমাদের শিখতে ও বুঝতে সাহায্য করে, আবার আশেপাশের শব্দ থেকেও দূরে রাখে।
প্রকৃতির শব্দ বা যেকোন যন্ত্রসংগীতের সুর আমাদের মাথা ঠান্ডা করতে ও বিক্ষিপ্ত মনকে শান্ত করতে সাহায্য করে। কারণ, শান্ত সুরের ফ্রিকোয়েন্সির সঙ্গে আমাদের মস্তিষ্কের ফ্রিকোয়েন্সি এক হয়ে যায়। এতে মনোযোগ ও স্মৃতিশক্তি দুইই উন্নত হয়।
আমাদের অগ্রাধিকার দেয়ার তালিকায় সবচেয়ে নিচে থাকে ঘুম। অথচ একটা ভালো ঘুমের পরে যে সতেজতা কাজ করে, তাতে কাজে মন দেওয়া সহজ হয়। ঘুম মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বাড়ায়। আমাদের মস্তিষ্কের নিউরনগুলোকে একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে সাহায্য করে। এতে আমাদের নতুন কিছু শেখা যেমন সহজ হয়, তেমনি ভুলে যাবার প্রবণতা কমে। তাই প্রতিদিন অন্তত ছয়-সাত ঘণ্টা ঘুম নিশ্চিত করার চেষ্টা করুন।
আমাদের শরীরে রয়েছে একটি নিজস্ব ঘড়ি। কেউ ভোরে উঠে কাজে নেমে পরতে পছন্দ করেন। কেউ পছন্দ রাত জেগে কাজ করতে। আপনি ঠিক কোন দলের মানুষ, সেটা খুঁজে বের করুন, তারপর সেই অনুসারে আপনার দিকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সাজিয়ে নিন। চাইলে কাজের সময় আপনি চালু করতে পারেন টাইমার। দেখুন, সর্বোচ্চ কতক্ষণ একটানা মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে পারছেন আপনি। কাজের সময় মোবাইলের নোটিফিকেশন বন্ধ করে রাখুন। এতে মনোযোগ অন্য দিকে সরে যাবে না।
কাজে মনোযোগ ফিরিয়ে আনার একটি অন্যতম কার্যকর পদ্ধতি ‘পাওয়ার ন্যাপ।’ দীর্ঘ সময় মনোযোগ দিয়ে কাজ করলে, বা একসঙ্গে একাধিক কাজ করলে আমরা সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়ি। এর একটা কার্যকর সমাধান হতে পারে ১০-১৫ মিনিটের একটা পাওয়ার ন্যাপ বা ছোট ঘুম। পাওয়ার ন্যাপ নেবার সময় জেগে থাকলেও এটি স্নায়ু শীতল করে এবং ঘুমের মতো কাজ করে। এতে আপনার মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতা পুনরুজ্জীবিত হয়।
পাওয়ার ন্যাপ নেবার সময় শান্ত সুর বা মন শান্ত করে এমন কোনো দৃশ্য নিয়ে ভাবতে পারেন। এতে আরও ভালো ফল পাওয়া যায়।
সূত্র: সায়েন্স ফোকাস