ভোজনরসিক বাঙালি খাওয়াদাওয়াটা একটু বেশিই ভালোবাসে। আর সেটা যদি হয় ভাজাভুজি ধরনের কিছু তবে তো কথাই নেই। তেলেভাজা খাবার যেমন মুখের স্বাদ বাড়ায়, তেমনই সৃষ্টি করে স্বাস্থ্যঝুঁকিও। এ ঝুঁকি এড়াতে বিকল্প হতে পারে উচ্চ তাপমাত্রায় রান্না ও নিয়ন্ত্রিত ফ্যাটি এসিডযুক্ত তেল।
রমজান মাসে ইফতারে জনপ্রিয় বিভিন্ন তেলেভাজা খাবার। ইফতারের একটি বড় অংশ জুড়েই থাকে আলুর চপ, বেগুনি, পেঁয়াজুসহ বিভিন্ন তেলে ভাজা খাবার। তবে অতিরিক্ত তৈলাক্ত খাবার স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হতে পারে। তাই জানতে হবে কোনটি ক্ষতিকর। সঠিক তেল নির্বাচন হতে পারে আপনার স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের জন্য একটি বড় পদক্ষেপ। তাই ইফতারে সাধারণ তেলের পরিবর্তে ব্যবহার করতে পারেন কিছু বিশেষ স্বাস্থ্যসম্মত তেল।
সাধারণ রান্নার তেলে স্যাচুরেটেড, মনোস্যাচুরেটেড (এমইউএফএ), পলিআনস্যাচুরেটেড (পিইউএফএ) ও ট্রান্স ফ্যাটিসহ বিভিন্ন ধরনের ফ্যাটি এসিড থাকে। উচ্চ মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাটযুক্ত তেল ইফতার সামগ্রী ভাজার জন্য অনুপযুক্ত।
ভাজার তেলের জন্য অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান আর ধোঁয়া ওঠার পয়েন্টও গুরুত্বপূর্ণ। স্মোক বা ধোঁয়া ওঠার পয়েন্ট হলো যে তাপমাত্রায় তেল থেকে ধোঁয়া নির্গত হওয়া শুরু করে। স্মোকিং পয়েন্টের তাপমাত্রা তেল থেকে ক্ষতিকারক পদার্থ নির্গত করে। উচ্চ অ্যান্টিঅক্সিডেন্টসমৃদ্ধ তেল শরীরকে এসব ক্ষতিকারক উপাদান থেকে রক্ষা করে।
এখানে স্বাস্থ্যকর ৪ ধরনের তেল নিয়ে আলোচনা করা হলো, যেগুলো আমাদের দেশের বাজারে পাওয়া যায়।
অলিভ অয়েল
স্বাস্থ্যকর তেল বলতেই প্রায় সবারই প্রথমে মাথায় আসে অলিভ অয়েলের কথা। এটি মূলত ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের রান্নায় ব্যবহৃত প্রধান তেল। এ তেলে পলিঅনস্যাচুরেটেডের (পিইউএফএ) চেয়ে বেশি মনোস্যাচুরেটেড (এমইউএফএ) রয়েছে। এটি ক্ষতিকারক যৌগ তৈরির সম্ভাবনা কমায়।
বিশুদ্ধ অলিভ অয়েলে ৬৯.২ শতাংশ মনোস্যাচুরেটেড, ৯.০৭ শতাংশ পলিআনস্যাচুরেটেড ও ১৫.৪ শতাংশ স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে। বিশুদ্ধ অলিভ অয়েলের স্মোকিং পয়েন্ট ৪১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই তেল সবচেয়ে বেশি অ্যান্টিঅক্সিডেন্টসমৃদ্ধ যা ভাজার সময় তেলে ক্ষতিকারক যৌগ তৈরি প্রতিরোধ করে।
রাইস ব্র্যান অয়েল
উচ্চতাপে ডুবো তেলে ভাজা খাবারের জন্য সাধারণ ভেজিটেবল অয়েলের বদলে রাইস ব্র্যান অয়েল হতে পারে একটি স্বাস্থ্যসম্মত বিকল্প। এ তেলে রয়েছে উচ্চমাত্রার অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। সেই সঙ্গে এ তেলের স্মোকিং পয়েন্ট প্রায় ৪৪৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
রাইস ব্র্যান অয়েল সহজে অন্য তেলের সাথে মিশিয়েও ব্যবহার করা যেতে পারে। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে উচ্চ তাপে সবচেয়ে স্থিতিশীল তেলের মিশ্রণগুলির মধ্যে আছে জলপাই তেলের সঙ্গে মেশানো রাইস ব্র্যান অয়েল।
চিনাবাদামের তেল
বাদাম তেলে প্রায় ৫৭.১ শতাংশ মনোস্যাচুরেটেড, ১৯.৯ শতাংশ পলিআনস্যাচুরেটেড ও ১৬.২ শতাংশ স্যাচুরেটেড ফ্যাট আছে। এ তেলের স্মোকিং পয়েন্টও (যে তাপমাত্রায় তেল থেকে ধোঁয়া নির্গত হওয়া শুরু করে) অতি উচ্চ। প্রায় ২৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠে থাকে এর স্মোকিং পয়েন্ট।
খাবার গরম করার সময় চিনাবাদাম, ক্যানোলা, সয়াবিন ও কর্ন অয়েলের স্থায়িত্বের তুলনা করে একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ক্ষতিকারক যৌগগুলি কর্ন অয়েলে সর্বাধিক এবং বাদাম তেলের মধ্যে সর্বনিম্ন ছিল। চিনাবাদামে এ্যালার্জিযুক্ত ব্যাক্তিদের জন্যও উচ্চ তাপমাত্রায় পরিশোধিত বাদাম তেল নিরাপদ বলে জানা গেছে।
শর্ষের তেল
শর্ষের তেলও অন্যতম নিরাপদ একটি তেল। এতে প্রায় ৬৩.৩ শতাংশ মনোস্যাচুরেটেড, ২৮.১ শতাংশ পলিআনস্যাচুরেটেড ও ৭.৩৬ শতাংশ স্যাচুরেটেড ফ্যাট আছে। তবে এই তেল দিয়ে ডিপ ফ্রাই করলে তা খাবারের স্বাদে কিছু পরিবর্তন আনতে পারে।
ভাজাপোড়া জাতীয় খাবারের জন্য তেল যেভাবে নির্বাচন করবেন
উচ্চ পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটযুক্ত তেল তাপ পেলে বেশি ক্ষতিকারক পদার্থ নির্গত করে। যদিও স্যাচুরেটেড ফ্যাট (যেমন নারকেল তেল) তাপে স্থিতিশীল, তবে এমন উচ্চ স্যাচুরেটেড ফ্যাট দিয়ে ডুবো তেলে খাবার ভাজার পরামর্শ দেওয়া হয় না। কারণ ভাজা খাবার এই তেল শুঁষে নেবে।কম স্মোকিং পয়েন্টসমৃদ্ধ তেল পরিহার করা উচিত। কারণ সেক্ষেত্রে তেল বেশি গরম হলে তা ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ নির্গত করে, যা স্বাস্থ্যসম্মত নয়।
কোন ধরনের তেল ইফতার ভাজার জন্য এড়িয়ে চলবেন
তাপের সংস্পর্শে এলে তেলের ফ্যাটি এসিডের পরিবর্তন দেখা দেয়। তাপ দিলে তেলের পলিআনস্যাচুরেটেড উপাদান কমে গিয়ে ফ্যাটি এসিডের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। তবে উচ্চ পলিআনস্যাচুরেটেড তেল ভাজার জন্য বেশি ভালো নয়।
উচ্চ পলিআনস্যাচুরেটেড তেলের তালিকায় রয়েছে কর্ন অয়েল, সানফ্লাওয়ার অয়েল, তিলের তেল, সয়াবিন তেল ইত্যাদি। এছাড়া উচ্চ স্যাচুরেটেড ফ্যাটযুক্ত তেলের মধ্যে আছে মাখন ও নারকেল তেল।
ডুবো তেলে ভাজা খাবারে কমবেশি ক্ষতিকারক যৌগ তৈরি হয়। প্রায়শই তেল ও খাবার উভয়ের পুষ্টির গুণমানকে হ্রাস করে এই রন্ধনপ্রক্রিয়া। তাই সব দিক বিবেচনা করে ইফতার ভাজার জন্য বেশি মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিডযুক্ত আর পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড কম আছে এমন তেল ব্যবহার করতে পারেন। আর সেদিক থেকে অলিভ অয়েল, রাইস ব্র্যান অয়েল আর বাদাম তেলই সবচেয়ে স্বাস্থ্যসম্মত।
সূত্র: হেলথ ডট কম ম্যাগাজিন
ছবি: ইন্সটাগ্রাম ও পেকজেলস ডট কম