এ পর্বে লেখার ইচ্ছা ছিল শিফটিংয়ে কাজ করেন যাঁরা, তাঁদের নিয়ে; কিন্তু অনেক বেশি অনুরোধ পেয়েছি শিশুদের নিয়ে লেখার জন্য। রাতে ঠিকভাবে না ঘুমালে ওদের কী ক্ষতি হচ্ছে, সেটাই আজকের বিষয়।
আমার কাছে যে রোগীরা আসেন, তাঁদের একটি কমন প্রশ্ন থাকে, সেটা হলো কীভাবে মনোযোগ বাড়ানো যাবে বা বুদ্ধির বিকাশ করা যাবে? আমার সহজ উত্তর হলো, নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমিয়ে এবং নির্দিষ্ট সময়ে ঘুম থেকে উঠে। সবচেয়ে বেশি ঘুম দরকার হয় শিশু-কিশোরদের। যে শিশু দীর্ঘক্ষণ ঘুমায়, তার বুদ্ধির বিকাশ সবচেয়ে বেশি হয়।
এখানে আমেরিকা আর ব্রিটেন নিয়ে একটা কৌতুক চালু আছে। তা হলো, আমেরিকানরা সারা দিন–রাত এক করে দেয় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে আর ইংরেজরা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সারা বিশ্ব হাতের মুঠোয় রাখে। সারা যুক্তরাজ্যে নিয়ম হলো সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে বাচ্চাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে হবে। সেই বাচ্চা সকাল সাতটা পর্যন্ত ঘুমাবে। যদিও আমেরিকা বা বাংলাদেশের মানুষ তা মানে না বা মানতে চায় না।
আমার কাছে অটিজম, এডিএইচডি, লার্নিং ডিজঅ্যাবিলিটি, অ্যাংজাইটি, সেলফ হার্ম, আত্মহত্যার প্রবণতা, ইম্পস্টার সিনড্রোম ও মুড সুইংয়ে আক্রান্ত অনেক শিশু-কিশোর আসে। তাদের একটা সাধারণ বিষয় আমার চোখে পড়ে, সেটা হলো অনিদ্রা। তারা পরিমাণের তুলনায় অনেক কম ঘুমায়। রাতে জেগে থাকে, দিনে ঘুমায়। আমি আমার নিজের ছেলের উদাহরণ দিতে পারি। আমার ছেলে অটিজম, লার্নিং ডিজঅ্যাবিলিটিসহ অনেক রোগে আক্রান্ত ছিল। সে টানা ১ ঘণ্টা ১৮ মিনিট ঘুমাতে পারত, তারপর উঠে যেত। যার ফলে তার মস্তিষ্কের গঠন ঠিকভাবে হচ্ছিল না। আমি নিজেই তার চিকিৎসা করেছি।
আমি যেসব প্রটোকল বানিয়েছি, তার মধ্যে অন্যতম ছিল রাতে ১২ ঘণ্টা ঘুমানো। ১ ঘণ্টা ১৮ মিনিট থেকে একটানা ১২ ঘণ্টা ঘুমানোয় নিয়ে যেতে অনেক সময় লেগেছে এবং আমি কোনো ধরনের ওষুধ ছাড়া সম্পূর্ণ প্রাকৃতিকভাবে তার ঘুমের সময় বাড়াতে সাহায্য করেছি। সে যখন সন্ধ্যা সাতটা থেকে শুরু করে সকাল সাতটা পর্যন্ত ঘুমাতে শুরু করল। এর পর থেকে তার কথা বলার ক্ষমতা বাড়া শুরু করল এবং তার লার্নিং ডিজঅ্যাবিলিটি কমতে শুরু করল। তার বুদ্ধি, চিন্তা করার ক্ষমতা, বোঝার ক্ষমতা ও সৃষ্টিশীলতা এতটাই বেড়েছে যে সে ৯ বছর বয়স থেকে বই লেখা শুরু করেছে এবং ১১ বছর বয়সে অ্যামাজন থেকে প্রতিবছর তার বই বের হচ্ছে।
যদিও স্কুল-কলেজ, শিক্ষক, মা–বাবা সবাই চেষ্টা করে শিশুরা যেন কম ঘুমায়। শিশুরা ঘুমাতে চাইলে মা–বাবা খুব বিরক্ত হয়। যে শিশু স্কুলে যত ভালো, সেই শিশু তত বেশি পড়ার চাপে মধ্যরাতের আগে ঘুমাতে যেতে পারে না। তাই শিশুদের অনেক ধরনের বুদ্ধিগত ও মানসিক সমস্যা দেখা যাচ্ছে। ঘুম নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে ও হচ্ছে। ঘুম মস্তিষ্কের অনেক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে। একটি বড় প্রমাণ হলো আলঝেইমার রোগীদের নিয়ে করা একটি গবেষণা। আলঝেইমার হলো এমন একটি রোগ, যা হলে মানুষ ধীরে ধীরে সবকিছু ভুলে যেতে থাকে। আগে এই রোগ বয়স্কদের মধ্যে দেখা যেত, এখন অনেক শিশু-কিশোরদেরও হচ্ছে। আলঝেইমার রোগীদের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সে এমিলয়ডস প্লাকস তৈরি হয়, যা কি না মূলত ক্যালসিয়াম ডিপোজিটস। এগুলো ধীরে ধীরে মস্তিষ্কের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সে জমা হয়।
প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স হলো এমন এক জায়গা, যেখানে সব ধরনের তথ্য জমা থাকে। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সেন্স এখান থেকে চলে, যাতে মানুষ সঠিক ইনফরমেশন নিয়ে সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং সেভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে পারে। মস্তিষ্ক স্মরণশক্তিও এখানে ধারণ করে। আলঝেইমার রোগীদের নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে যে তারা জীবনের একটা বড় সময় ধরে দেরিতে ঘুমাতে যেত। ফলে মস্তিষ্কের ক্লিনিং প্রসেসটা বহু বছর হতে পারেনি। এতে বহু বছর ধরে ওদের মস্তিষ্কের ক্ষতি হয়েছে। ঘুমের মধ্যে যে পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম চলে, তা এই এমিলয়ডস প্লাকস উৎপাদন হতে বাধা দেয় বা হলেও তা বের করে দেয়।
এর আগে লিখেছিলাম যে গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে প্রাকৃতিক ঘড়ি ও মানুষের দেহঘড়ি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ঘুমের সময় অবশ্যই রাতে হতে হয় এবং রাতের ৯টা থেকে ভোর পর্যন্ত হতে হয়। ঘুমের সময় মস্তিষ্কের এই ক্লিনিং সিস্টেম চলে ঘুমের প্রথম ধাপে। মস্তিষ্কের ক্লিনিং চলাকালে নন-র্যাপিড আই মুভমেন্ট বা চোখ স্থির হয়ে থাকে ৮০ শতাংশ। এই সময় হলো ঘুমের প্রথম ৯০ মিনিট, যা প্রাকৃতিকভাবে শুরু হয় রাতের ৯টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত।
এরপরের দেড় ঘণ্টা অর্থাৎ ১২টা পর্যন্ত ঘুমের দ্বিতীয় ভাগ। এ সময় চোখের নড়া বন্ধ হয়ে যায়। নন-র্যাপিড আই মুভমেন্টের সময় তিনটি ধাপে ঘুম হয়।
প্রথম ধাপে হালকা ঘুম হয়। এই ধাপে ২ থেকে ৫ শতাংশ চোখ নড়াচড়া করে। দ্বিতীয় ধাপে গভীর ও হালকা স্তরের ঘুম হয়। তৃতীয় ধাপে স্লো-ওয়েভ গভীর ঘুম হয়। ঘুমের প্রতিটি ধাপে আলফা, বিটা, থিটা, গামা, ডেলটা ওয়েভ চলতে থাকে। রাতের ১২টা থেকে দেড়টা পর্যন্ত র্যাপিড ও নন-র্যাপিড দুটিই সমান হয়। মধ্যরাতের পর থেকে ঘুমের সারকাডিয়ান হারমনিতে ঘুমের সাইকেল বদলে যায়।
দেড়টা থেকে তিনটা পর্যন্ত র্যাপিড আই মুভমেন্ট বেশি ৬০ শতাংশ হয়। রাত তিনটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত র্যাপিড আই মুভমেন্ট বেশি হয় প্রায় ৮০ শতাংশ। গত পর্বে লিখেছিলাম ঘুমের স্তরের সঙ্গে হরমোনগুলোর সম্পৃক্ততা নিয়ে। আমার আগের দুটি লেখা মেলালে বোঝা যাবে যে ঘুম খুব জটিল একটি প্রক্রিয়া। রাতের তিনটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত চলে স্বপ্ন দেখা। এই সময় কগনিটিভ ব্রেন তৈরি হয় এবং অনুভূতির বিভিন্ন বিষয় তৈরি হয়, যা মানুষকে সংবেদনশীল মানুষে পরিণত করে। পুরো ঘুমের ২৫ শতাংশ হয় এই সাইকেল।
তাই এখন জেন-জি প্রজন্ম ও আলফা প্রজন্মের সব শিশু রাতে ঘুমাতে পারে না বা কম ঘুম হয় বা পড়ার চাপে ঘুমাতে পারে না বা রাত জেগে মুঠোফোন দেখে বা রাত জেগে কাজ করে, দিনে ঘুমায়। এতে তাদের বুদ্ধি বিকাশ ঠিকমতো হচ্ছে না এবং শারীরিক-মানসিক সমস্যা বাড়ছে। আরেকটি বড় প্রভাব পড়ছে যাঁরা দিন-রাত মিলিয়ে শিফটিং ডিউটি করেন। আমার কাছে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু ছাড়া, মনে রাখতে না পারা, ভুলে যাওয়া রোগ নিয়ে যে পেশার রোগী বেশি এসেছেন, তাঁরা হলেন সাধারণ ছাত্র, পিএইচডি ছাত্র, ডাক্তার, পুলিশ, রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী, টেলিভিশন সাংবাদিক ও টেলিভিশন কর্মচারী কিংবা কম্পিউটার নিয়ে কাজ করেন। এই পেশাজীবীদের নিয়ে লিখব আগামী পর্বে। ঘুমহীনতা নিয়ে সিরিজটি পড়তে থাকুন। প্রাকৃতিকভাবে কীভাবে ঘুমের পরিমাণ বাড়িয়ে নিজের বুদ্ধিমত্তা বাড়ানোর উপায় বাতলানো যাবে আগামী দিনে।
লেখক: একাধারে নেচারোপ্যাথিক ডাক্তার, পুষ্টিবিদ, কিনেজিওলজিস্ট, ট্রমা রিলিজ থেরাপিস্ট, অটিজম স্পেশালিস্ট, মাইন্ড সেট ট্রেইনার। তিনি কাজ করছেন লন্ডনের ১০, হারলে স্ট্রিট ক্লিনিক এবং অনলাইনেও আছে তাঁর উপস্থিতি।
ই–মেইল: [email protected]
ছবি: পেকজেলসডটকম