জাপানিদের দীর্ঘ জীবনের গোপন রহস্য, নানবা ওয়াক

বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘায়ু জাতি হিসেবে পরিচিত জাপানিরা তাঁদের সুস্থ ও সুশৃঙ্খল জীবনের জন্য যে ছোট ছোট অভ্যাসগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন, তার মধ্যে হাঁটা অন্যতম। আর সেই হাঁটাকে তাঁরা পরিণত করেছেন একটি শিল্পে, একটি দর্শনে।

জাপানের ঐতিহ্যবাহী পোশাক কিমোনো পরে সহজে চলাফেরার প্রয়োজনে জন্ম নেয় ‘নানবা ওয়াক’ নামের এক বিশেষ হাঁটার শৈলী। এতে হাঁটার সময় ছোট ছোট কদম ফলতে হয়। হাত স্বাভাবিকভাবে দুলে বা পেটের ওপর রাখা থাকে এবং শরীরের মধ্যভাগ খানিকটা বাঁকানো হয়। এই ছন্দময় পদচারণা শুধু নান্দনিকই নয়, বরং এটি বৈজ্ঞানিকভাবেও শরীরের জন্য উপকারী।

গবেষণায় দেখা গেছে, নানবা ওয়াক পদ্ধতিতে হাঁটার ফলে দেহের ভারসাম্য বৃদ্ধি পায়, মাংসপেশি শক্তিশালী হয় এবং জয়েন্টের নমনীয়তা বজায় থাকে। এই অনুশীলন বিশেষভাবে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে আধুনিক ফিজিওথেরাপি ও বয়সভিত্তিক ব্যায়ামে।

জাপানে হাঁটা মানেই প্রকৃতির মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলা। দেশের প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে থাকা শত শত হাইকিং ট্রেইল—যেমন গিয়োনইয়ামা, টেনেন রুট বা মাউন্ট তাকাও—শুধু শারীরিক ব্যায়ামের জন্য নয়, বরং ইতিহাস, প্রকৃতি ও আত্মিক চর্চার জন্যই জনপ্রিয়।

এই সব পথে হাঁটলে আপনি পেয়ে যাবেন পুরোনো বৌদ্ধ মন্দির, বয়ে চলা ঝরনা ধারা কিংবা প্রাচীন কোনো গ্রামের মাটির সোঁদা গন্ধ। এমন হাঁটা একান্তই নিজের সঙ্গে নিজেকে দেখা—একটা চলমান ধ্যান, যেখানে প্রকৃতি হয়ে ওঠে নীরব শিক্ষক।

‘ওয়াক জাপান’ নামের বিশেষ ভ্রমণ উদ্যোগগুলো হাঁটাকে পরিণত করেছে এক ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞতায়। এই সফরগুলোতে অংশগ্রহণকারীরা কেবল পাহাড় বা উপত্যকা পেরিয়ে যান না, বরং শোনেন স্থানভিত্তিক লোককথা, জানতে পারেন গ্রামীণ ইতিহাস, স্বাদ নেন স্থানীয় খাবারের এবং এক ধরনের মননশীল পথচলার অংশ হয়ে ওঠেন।

এভাবে হাঁটা একধরনের শুদ্ধতায় পরিণত হয়। যার মাধ্যমে শরীর, মন ও আত্মা একসঙ্গে গতিশীল হয়।

জাপানে বর্তমানে আরও একটি স্বাস্থ্যকর হাঁটার পদ্ধতি জনপ্রিয়তা পেয়েছে—ইন্টারভ্যাল ওয়াকিং ট্রেনিং (IWT)। এতে কয়েক মিনিট দ্রুত হাঁটার পর কিছু সময় ধীরে হাঁটাতে  হয়—যেমন ৩ মিনিট দ্রুত হাঁটা, ৩ মিনিট ধীরে। গবেষণা বলছে, এই অনুশীলন অ্যারোবিকস সক্ষমতা বাড়ায়, ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে এবং বয়স্কদের জন্য নিরাপদ ও কার্যকর একটি ব্যায়াম পদ্ধতি হিসেবে পরিচিত।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ‘নানবা ওয়াক’ এর মধ্যেও এই অনুরূপ উপকারিতা পাওয়া যায়—যা একধরনের প্রাকৃতিক ইন্টারভ্যাল ব্যায়াম হিসেবেও কাজ করে।

জাপানিরা হাঁটাকে একটি ‘দর্শন’ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপ যেন এক একটি মনোযোগী ধ্যান, এক একটি শ্বাস যেন জীবনের প্রতি কৃতজ্ঞতা। তাঁদের দীর্ঘায়ু, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা এবং মনঃসংযোগের পেছনে এই সচেতন চলাফেরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

জাপানি হাঁটার এই ঐতিহ্য আমাদের শেখায়—শরীর ও আত্মার সুস্থতা আসতে পারে খুব সাধারণ অভ্যাস থেকেও, যদি তা করা হয় নিয়মিত, মনোযোগ দিয়ে এবং ভালোবাসা নিয়ে।

ছবি: পেকজেলসডটকম