রিফাইন্ড সয়াবিন না শর্ষের তেল—কোনটা খাবেন
শেয়ার করুন
ফলো করুন

আমাদের সমাজে আজকাল স্বাস্থ্যসচেতনতার নামে নানা আলোচনা চলছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিদিনই চোখে পড়ে—কোন খাবার খাব, কোনটা খাব না। সেই আলোচনায় তেলের বিষয়টি বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে। প্রতিদিনের রান্নায় তেল অপরিহার্য উপাদান। কিন্তু প্রশ্ন হলো—কোন তেল ভালো? রিফাইন্ড সয়াবিন তেল, নাকি দেশীয় শর্ষের তেল?
সরাসরি কোনো একটি তেলকে ‘ভালো’ বা ‘খারাপ’ বলা যায় না। এটি নির্ভর করে আপনার স্বাস্থ্যের অবস্থা, রান্নার ধরন এবং ব্যবহারিক উদ্দেশ্যের ওপর। তবে সাধারণত কোল্ডপ্রেসড বা কাঁচি ঘানির শর্ষের তেলকে তুলনামূলকভাবে বেশি স্বাস্থ্যকর ধরা হয়, যেখানে রিফাইন্ড সয়াবিন তেল প্রসেসড হওয়ায় কিছু পুষ্টিগুণ হারায়।
চলুন, দুই ধরনের তেলের পুষ্টিগুণ, স্বাস্থ্য উপকারিতা, ঝুঁকি ও রান্নায় ব্যবহার নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা করা যাক।

বিজ্ঞাপন

 পুষ্টিগুণের তুলনা

রিফাইন্ড সয়াবিন তেল: এতে ওমেগা-৬ ফ্যাটি অ্যাসিডের পরিমাণ বেশি (৫০–৬০%)। এ ছাড়া কিছুটা পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট ও সামান্য ওমেগা-৩ থাকে। তবে রিফাইনিং প্রক্রিয়ায় প্রাকৃতিক ভিটামিন ও অ্যান্টি–অক্সিডেন্টের অংশ কমে যায়।
 শর্ষের তেল: এতে মোনোআনস্যাচুরেটেড ফ্যাট (MUFA) প্রায় ৬০ শতাংশ। ওমেগা-৩ এবং ওমেগা-৬–এর ভারসাম্য ভালো (রেশিও প্রায় ৬:৫)। স্যাচুরেটেড ফ্যাট তুলনামূলকভাবে কম।

স্বাস্থ্য উপকারিতা ও ঝুঁকি

শর্ষের তেল: হৃদ্‌রোগ প্রতিরোধে সহায়ক (কম স্যাচুরেটেড ফ্যাট, উচ্চ MUFA)।
  কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
  ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে।
  প্রাকৃতিক অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট ও অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল গুণ রয়েছে।
  ঝুঁকি: কিছু শর্ষের তেলে এরুসিক অ্যাসিড থাকতে পারে, যা অতিরিক্ত হলে হার্টে ফ্যাট জমতে পারে। তবে বর্তমানে লো-এরাসিক ভ্যারাইটি (যেমন ঘানি তেল) নিরাপদ বলে ধরা হয়।
 রিফাইন্ড সয়াবিন তেল:   ভিটামিন ই সমৃদ্ধ। পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটের কারণে কিছু ক্ষেত্রে হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক।
 ঝুঁকি: রিফাইনিং প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত কেমিক্যাল থেকে ট্রান্সফ্যাট তৈরি হতে পারে। অতিরিক্ত ওমেগা-৬ প্রদাহ (inflammation) বাড়ায়। এ ছাড়া সয়াবিন অ্যালার্জি থাকলে সমস্যা হতে পারে।

বিজ্ঞাপন

রান্নার উপযোগিতা রিফাইন্ড

সয়াবিন তেল
  উচ্চ স্মোক পয়েন্ট (২৩০–২৫০°C)।
  নিউট্রাল ফ্লেভার, তাই ভাজা, বেকিং বা উচ্চ তাপে রান্নার জন্য উপযোগী।
  সহজলভ্য ও তুলনামূলকভাবে সস্তা।
  অসুবিধা: প্রসেসড হওয়ায় দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াতে পারে।
  শর্ষের তেল
  মাঝারি স্মোক পয়েন্ট (প্রায় ২০০–২৫০°C)।
 ঝাঁঝালো ফ্লেভার, যা ভারতীয় ও বাংলা রান্নায় বিশেষ স্বাদ আনে।
  অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল বৈশিষ্ট্য থাকায় খাবার তুলনামূলকভাবে দীর্ঘস্থায়ী হয়।
অসুবিধা: তীব্র গন্ধ অনেকের পছন্দ না–ও হতে পারে।

কোনটা খাবেন?

সব দিক বিচার করলে, শর্ষের তেলকে সাধারণত বেশি স্বাস্থ্যকর ধরা হয়। এতে প্রাকৃতিক ফ্যাট ভারসাম্য ভালো এবং প্রসেসিং কম। তবে আপনার রান্নার ধরন, স্বাদ, পছন্দ এবং স্বাস্থ্যগত অবস্থা অনুযায়ী তেল বেছে নেওয়া উচিত।
  যদি চান স্বাস্থ্যকর ফ্যাট ও প্রাকৃতিক গুণাবলি—শর্ষের তেল বেছে নিন, বিশেষত লো এরাসিক বা কাঁচি ঘানি।
যদি চান উচ্চ তাপে রান্না বা নিরপেক্ষ স্বাদ—রিফাইন্ড সয়াবিন তেল ব্যবহার করতে পারেন, তবে পরিমিতভাবে।

তেল নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচুর তথ্য ঘোরাফেরা করে—যার অনেকটাই অসম্পূর্ণ বা পক্ষপাতদুষ্ট। মনে রাখতে হবে, খাদ্যশিল্পেও কোম্পানির স্বার্থ জড়িত থাকে, তাই গবেষণার তথ্য সব সময় নিরপেক্ষ হয় না।
তাই যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে নিজের শরীর, পরিবারের প্রয়োজন ও রান্নার ধরন বিবেচনা করা জরুরি। তেলকে দোষারোপ না করে সুষম খাদ্যাভ্যাস, পরিমিত ব্যবহার ও বৈচিত্র্য বজায় রাখাই আসল বিষয়।

লেখক: খাদ্য ও পথ্য বিশেষজ্ঞ: প্রধান নিবার্হী, প্রাকৃতিক নিরাময়কেন্দ্র

ছবি: উইকিপিডিয়া

প্রকাশ: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০১: ০০
বিজ্ঞাপন