বয়স হয়ে গেলেও যে ব্যায়াম করতেই হবে সে কথা এখন আমরা সবাই জানি। আর এক্ষেত্রে প্রথমেই মনে হয় হাঁটা বা বড়জোর দৌড়ানোর কথা। কিন্তু এ নিয়ে হার্ভার্ডের নতুন পরামর্শ শুনলে আপনি বিশ্বাসই করবেন না। তাদের গবেষণা বলছে,৬০ বছর বয়সের পরও শরীরের এনার্জি ও স্ট্যামিনা ধরে রাখা, ভালো ঘুম আর ধারালো মগজ বজায় রাখার একটি গোপন রহস্য আছে। কিন্তু সেটা হাঁটা বা দৌড় নয়। হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের স্টাডি অনুযায়ী,ষাটোর্ধ্বদের জন্য সবচেয়ে কার্যকর ব্যায়াম আসলে অন্য কিছু, যা বার্ধক্য ও ফিটনেসের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিতে পারে।
কেন কিছু প্রবীণ মানুষ উদ্যমী থাকেন আর কিছু ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যান? বিষয়টা শুধু জেনেটিক নয়। মূল কারণ হলো সঠিক ব্যায়াম বেছে নেওয়া—যা বয়সের সঙ্গে শরীরের পরিবর্তিত চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। শুধু হাতপা চালানো নয়, সচেতন ও বুদ্ধিদীপ্ত অনুশীলনই এক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো ফলাফল দিতে পারে। আর এই দিক দিয়ে মার্শাল আর্টের কোনো তুলনা নেই। কী? অবাক হলেন? আসলেই কিন্তু প্রবীণদের জন্য আদর্শ ব্যায়াম হিসেবে মার্শাল আর্টের কথা প্রথমে কারও মাথায়ই আসবে না। কিন্তু যুগযুগ ধরে চায়না ও জাপানে দীর্ঘজীবী মানুষেরা ষাটের পর বিভিন্ন ধরনের মার্শাল আর্ট অনুশীলন করে আছেন সুপারফিট। আর সে সূত্র ধরেই হার্ভার্ডের গবেষণাটি এগিয়েছে।
কেন মার্শাল আর্ট প্রবীণদের জন্য আদর্শ ব্যায়াম
মার্শাল আর্ট শুনলেই হয়তো সিনেমার মতো হাই-হুই শব্দে হাত চালানো আর উঁচু লাথি মারার দৃশ্য চোখে ভেসে ওঠে। কিন্তু বাস্তবে এমন অনেক ঐতিহ্যবাহী মার্শাল আর্ট আছে যা প্রবীণদের জন্য সফট মুভভিত্তিক, ধীরগতির আর সহজে মানিয়ে নেওয়ার মতো। বিশেষজ্ঞরা বেশি বয়সে ফিটনেস ধরে রাখতে তাইচি, আইকিডো আর উইং চুন-এর মতো ঐতিহ্যবাহী কিন্তু স্বল্পপরিচিত মার্শাল আর্ট অনুশীলন করতে দেন। কারণ এগুলো গতি বা শক্তির চেয়ে ভারসাম্য, শরীরের অবস্থান ও নড়াচড়া সম্পর্কে সচেতনতা আর ধীর, নিখুঁত সঞ্চালনের ওপর গুরুত্ব দেয়।
এগুলো করলে পুরো শরীরের ব্যায়াম হয়, একই সঙ্গে মস্তিষ্কও সক্রিয় থাকে। ধীর ও মনোযোগ দিয়ে করা এসব মুভমেন্ট শরীর ও মনের সমন্বয় বাড়ায়, পেশিকে শক্তিশালী করে এবং হাড়ের জয়েন্টে অতিরিক্ত চাপ না দিয়ে শরীরকে সুরক্ষিত রাখে। ফলে প্রবীণদের জন্য দৌড়ানো বা ভারী ব্যায়ামের চেয়ে অনেক নিরাপদ ও আকর্ষণীয় বিকল্প হতে পারে এসব মার্শাল আর্টের কসরত করা।আপনার বয়স যদি ষাটের বেশি হয়, তবে কয়েক মাস তাইচি বা এরকম কিছু চর্চা করার পর দেখবেন,আপনার হাঁটা আরও ব্যালেন্সড হয়েছে, ঘুম ভালো হচ্ছে, আর মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করা সহজ লাগছে। শারীরিক অনুশীলন আর মানসিক মনোযোগের এই কম্বিনেশন আপনাকে নতুন শান্তি ও আত্মবিশ্বাস দিয়েছে।
তাইচি: একে অনেকেই নিজের সঙ্গে ধীরগতির নাচ বলে থাকেন। এই মার্শাল আর্টের কোমল, ফ্লোয়ি মুভমেন্ট আর গভীর শ্বাস-প্রশ্বাস রক্তসঞ্চালন ভালো করে ও মনের চাপ কমায়। জয়েন্ট ব্যথা বা পড়ে যাওয়ার ভয় আছে এমন প্রবীণদের জন্য তাইচি নিরাপদ ও প্রশান্তিদায়ক।
আইকিডো: এতে প্রতিপক্ষের শক্তির সঙ্গে লড়াই না করে তার শক্তিকে ব্যবহার করা শেখানো হয়। ফলে শরীর নমনীয় থাকে, চাপ কমে, আর চলাফেরা হয় সাবলীল।
উইং চুন: এতে ছোট, কার্যকরী গতিবিধির ওপর জোর দেওয়া হয়, ঝুঁকিপূর্ণ লাফ বা ফ্লিপ নেই। প্রবীণদের জন্য এটি ভারসাম্য ও দ্রুত প্রতিক্রিয়ার ক্ষমতা বাড়াতে দারুণ সহায়ক।
সফট জুজুৎসু: প্রবীণদের জন্য এখানে ভ্যারিয়েশন আনা হয়েছে। এতে আত্মরক্ষার কৌশল শেখানো হয়, শরীর সচেতনতা বাড়ানো হয়। তবে কঠিন শারীরিক সংস্পর্শ ছাড়াই। এতে পড়ে যাওয়ার ভয় কমে, আত্মবিশ্বাস বাড়ে।
কীভাবে মার্শাল আর্ট প্রবীণদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখে
মার্শাল আর্টের বিশেষত্ব হলো এর হলিস্টিক বা পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টিভঙ্গি। এটি শুধু শরীর বা মন নয়, বরঞ্চ দুটোকেই একসঙ্গে সক্রিয় রাখে। জটিল মুভমেন্ট বা কসরতের ধাপ মনে রাখা ও এগুলো নিয়মিত করা পেশি নিয়ন্ত্রণ বাড়ায়, মনোযোগ ও স্মৃতিশক্তির উন্নতি ঘটায়।
হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের ড. পিটার এম. ওয়েনের নেতৃত্বে এই গবেষণায় দেখা গেছে, তাইচি শরীরের ভেতরের নিয়ন্ত্রণ-ব্যবস্থা সুস্থ রাখে, ফলে বয়সজনিত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা সহজ হয়।
আরেকটি বড় উপকারিতা হলো সামাজিক সংযোগ। অনেক প্রবীণ একাকীত্বে ভোগেন; গ্রুপে মার্শাল আর্ট অনুশীলন করলে প্রেরণা, সঙ্গী আর কমিউনিটিতে অংশ হওয়ার অনুভূতি পাওয়া যায়, যা মানসিক সুস্থতার জন্যও অত্যন্ত জরুরি।
অবশ্যই এই অনুশীলন শুরু করার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া ভালো। আর অভিজ্ঞ প্রশিক্ষকের কাছ থেকে শেখা নিরাপদ ও আনন্দদায়ক হবে।
৬০ বছরের পর ফিটনেস নতুনভাবে ভাবা কেন জরুরি
বয়স বাড়া মানেই যে শরীরের নড়াচড়া ও আনন্দ কমে যাবে, তা নয়। মার্শাল আর্ট প্রবীণদের সচল, ভারসাম্যপূর্ণ ও সামাজিকভাবে সংযুক্ত রাখার এক বিশেষ উপায়। সচেতনভাবে করা এই ব্যায়াম, কোমল মুভমেন্ট আর সামাজিক জীবনে গতি এনে এই মার্শাল আর্ট ষাটের পর জীবন বদলে দিতে পারে।
সূত্র: হার্ভার্ড হেলথ
ছবি: ইন্সটাগ্রাম