ভাত খাওয়ার দিক থেকে বিশ্বের তৃতীয় দেশ বাংলাদেশ। সকাল, দুপুর কিংবা রাত তিন বেলাই ভাত খান বেশির ভাগ বাঙালি। আর সাহরিতে ভাতই খাই আমরা বেশিরভাগ। কথায় আছে না, মাছে-ভাতে বাঙালি! মাছ, মাংস, সবজি কিংবা ভর্তা ছাড়াও বিভিন্ন পদ প্রতি বেলায় বদলাতে থাকে ভাতকে কেন্দ্র করেই। যত যাই খাই না কেন, ভাতের তৃপ্তি যেন কোথাও নেই। যাঁরা কঠোর ডায়েট করেন, তাঁরাও অনেকে এক বেলা ভাত রাখেন পাতে। অনেকেই সাহরিতে ফ্রিজের ভাত গরম করে খান। ঠান্ডা ভাত গরম করে খেলে কি সত্যি ক্ষতি হতে পারে? উত্তরটি হ্যাঁবোধক। বাসি ভাত গরম করে খেলে আপনার ফুডপয়জনিং হতে পারে। কিন্তু মূল সমস্যা আবার গরম করাতে নয়, বরং গরম করার আগে ঠিকভাবে সংরক্ষণ না করাতে এ সমস্যা হয়।
ভাত গরম করার সময় কীভাবে বিষাক্ত হয়
চালের মধ্যে ব্যাসিলাস সিরিয়াস নামক একপ্রকার ব্যাকটেরিয়ার স্পোর থাকে। আর এই স্পোরগুলো দীর্ঘ সময় প্রতিকূল পরিবেশেও টিকে থাকতে পারে। এমনকি ভাত রান্নার পরও এরা বেঁচে থাকে। ভাত রান্নার পর দীর্ঘ সময় সেটি সাধারণ তাপমাত্রায় অর্থাৎ কক্ষ তাপমাত্রায় রাখা থাকলে ব্যাসিলাস সিরিয়াস স্পোরগুলো থেকে ব্যাকটেরিয়া তৈরি হয়। আর সেই ভাত আবার গরম করা হলে ওই ব্যাকটেরিয়া বিষাক্ত হয়ে যায়। এর ফলে এ ভাত খেলে ডায়রিয়া, বমির মতো নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। যত সময় যায়, ব্যাকটেরিয়ার উৎপাদন তত বাড়তে থাকে। তার মানে দীর্ঘ সময় ভাত কক্ষ তাপমাত্রায় থাকলে সেই ভাত পুনরায় গরম করে খাওয়া অনিরাপদ হবে।
যেসব প্রতিক্রিয়া হতে পারে
ব্যাসিলাস সিরিয়াস ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতিতে বিষাক্ত হয়ে যাওয়া ভাত খেলে বমি ও ডায়রিয়া হতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই পরবর্তী এক থেকে পাঁচ ঘণ্টা আপনার শরীর খারাপ লাগবে। অনেক ক্ষেত্রে এসব লক্ষণ ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় থাকতে পারে।
তাহলে ভাত কীভাবে সংরক্ষণ করবেন
ভাত অবশিষ্ট রয়ে গেলে সেগুলো দ্রুত ঠান্ডা করে নেওয়া। সম্ভব হলে রান্না করার এক ঘণ্টার মধ্যেই ঠান্ডা করে নেওয়া। তারপর সেটি ফ্রিজে সংরক্ষণ করতে হবে। অবশ্য এক দিনের বেশি তা ফ্রিজে রাখা যাবে না। ফ্রিজে সংরক্ষণ করা ভাত গরম করার সময় খেয়াল রাখতে হবে, যেন সবগুলো ভাতই পুরোপুরি তাপ পায়। একবারের বেশি ভাত গরম করা যাবে না কখনোই।
ফ্রিজের ভাত গরম করে খাওয়ার উপকারিতা
ডায়াবেটিসকে বলা হয় লাইফস্টাইল ডিজিজ। লাইফস্টাইল পরিবর্তন করে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা যায় বলে বিশেষজ্ঞরা মতামত দিয়ে থাকেন। বিশেষ করে টাইপ২ ডায়াবেটিসে খাদ্য ও লাইফস্টাইল পরিবর্তন করে ওষুধমুক্ত জীবন যাপন করা সম্ভব। এই লাইফস্টাইল পরিবর্তন করতে যে জ্ঞান জরুরি, তা হচ্ছে, গ্লাইসেমিক ইনডেক্স সম্পর্কে জানা। বিভিন্ন পরীক্ষায় দেখা গেছে, যেসব কার্বোহাইড্রেটের মধ্যে গ্লাইসেমিক ইনডেক্স বেশি থাকে, সেসব কার্বোহাইড্রেট তাড়াতাড়ি মিশে গিয়ে রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।
আর যেসব কার্বোহাইড্রেটের মধ্যে গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম বা মাঝারি থাকে, সেগুলো রক্তে তাড়াতাড়ি মিশে গিয়ে শর্করার মাত্রা বাড়াতে পারে না। তাই যাঁদের শরীরে ব্লাড সুগার সাধারণের চেয়ে বেশি, তাঁদের যেসব কার্বোহাইড্রেটের মধ্যে গ্লাইসেমিক ইনডেক্স বেশি থাকে, তা কম খাওয়া ভালো।
গ্লাইসেমিক ইনডেক্স বেশি বলে ভাত খাওয়া নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকে ব্লাড সুগারের রোগীদের। তাঁরা কতটা ভাত খাবেন বা আদৌ খাবেন কি না, এই নিয়ে সংশয়ে থাকেন।
একাধিক গবেষণায় দাবি, শর্করা জাতীয় খাবার রেফ্রিজারেটরে রাখা হলে গ্লাইসেমিক ইনডেক্সের পরিমাণ কমে যায়, যা ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য উপকারী।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ (এনআইএইচ) ২০২২ সালে তাদের জার্নালে প্রকাশ করে যে ঠান্ডা ভাতের শর্করা মানবশরীরে বেশি শোষিত হয় না। তারা বলেছে, ঠান্ডা ভাতে গরম ভাতের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি প্রতিরোধী স্টার্চ রয়েছে। সদ্য প্রস্তুত চালের গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ৭৮। ভাতকে ১৬ থেকে ২০ ঘণ্টার জন্য ফ্রিজে ঠান্ডা করে পরে খাওয়ার আগে হালকা গরম করা হলে এর গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কমে হয় ৫৪।
গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম হওয়ার অর্থ, এটি মানবশরীরে কম কার্বোহাইড্রেট শোষণ করে। সুতরাং একই ভাত সামান্য তাপমাত্রা ও সময় পরিবর্তনের জন্য শরীরে অনেক কম কার্বোহাইড্রেট শোষণ করে; এটা ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য খুবই উপকারী। ফলে তারা পরামর্শ দিয়েছে, এক দিনের জন্য ভাত ফ্রিজে রেখে দিতে। তাহলে এই ভাত ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য কম ক্ষতিকর হবে।
পোজনান ইউনিভার্সিটি অব মেডিকেল সায়েন্সেসের গবেষকদের একটি দল টাইপ১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ৩২ জন রোগীর ওপর গবেষণা করে। দুটি ভিন্ন পরীক্ষায় খাবার খাওয়ার পর তাঁদের রক্তে শর্করার মাত্রা তুলনা করে। একটি খাবার ছিল দীর্ঘ শস্যের সাদা ভাত; এটায় কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ প্রায় ৪৬ গ্রাম। অন্যটি ভাতের একই অংশ ছিল, কিন্তু ২৪ ঘণ্টার জন্য একটি ফ্রিজে ঠান্ডা করে আবার গরম করে পরিবেশন করা। গবেষকেরা দেখেছেন যে অংশগ্রহণকারীরা ঠান্ডা করে গরম করা ভাত খাওয়ার পর তাঁদের রক্তে শর্করার মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে কম বৃদ্ধি পায়।
আবার বলা হচ্ছে, এভাবে ঠান্ডা ভাত গরম করে খেলে রেজিস্ট্যান্ট স্টার্চ হিসেবে শর্করা আমাদের শরীরে প্রবেশ করে বলে হুট করে ওজন বাড়িয়ে দিতে পারে না তা। বা অন্যভাবে বলতে গেলে, শরীরে গ্লুকোজ স্পাইক না ঘটানোর ফলে পরিমিত পরিমাণে ফ্রিজের ভাত খেলে ওজন বাড়ে না সেভাবে। আর রোজার সময় ওজন কমাতে একেবারে নো কার্ব ডায়েট না করে এভাবে ঠান্ডা ভাত গরম করে অল্প পরিমাণে খেলে ভালো ।
সূত্র: হেলথলাইন
ছবি: পেকজেলস ডট কম