দেশীয় ফিটনেস ও ওয়েলবিয়িং ট্রেন্ডে ২০২৫–এ আলোচিত যা কিছু
শেয়ার করুন
ফলো করুন

দ্য ফ্লো ফেস্ট

বিগত কয়েক বছর ধরে সুস্থতা ও হলিস্টিক ওয়েলবিয়িং নিয়ে ধারাবাহিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে ঢাকা ফ্লো। এই ভাবনাকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যে হয়েছে একাধিক আয়োজন। ২০২৫ সালে এসে এই উদ্যোগের নাম বদলে রাখা হয় দ্য ফ্লো ফেস্ট। নভেম্বরের গোড়ার দিকে অনুষ্ঠিত এই উৎসবে অংশ নেন আন্তর্জাতিক মানের দেশি-বিদেশি ফিটনেস প্রশিক্ষকেরা। ফিটনেসের গণ্ডি পেরিয়ে এখানে জায়গা করে নেয় নাচ, থেরাপি, আর্ট ও সংগীত।

ইয়োগা, জুম্বা, অ্যারোবিকস, ফেন্সিংয়ের পাশাপাশি নগরবাসী পরিচিত হয় ক্রায়োথেরাপি, সাউন্ড হিলিংয়ের মতো অভিনব অল্টারনেটিভ ট্রিটমেন্টের সঙ্গে। শরীরচর্চা যে কেবল ঘাম ঝরানো নয়, বরং মন ও অনুভূতির সঙ্গেও গভীরভাবে জড়িত, এই উপলব্ধিই ছিল উৎসবটির মূল সুর। ২০২৬ সালে দুবাইয়ে হতে যাচ্ছে দ্য ফ্লো ফেস্টের আন্তর্জাতিক আসর। ‘একসঙ্গে ভালো থাকা সম্ভব’—এই বার্তাই  সবচেয়ে জোরালোভাবে দেওয়া হয়েছে ঢাকার এই আয়োজনজুড়ে। ফ্লো ফেস্টের এই অভিজ্ঞতা হয়তো স্বল্প সময়ের, কিন্তু এর প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী মানুষ আবার নিজের আত্মিক আনন্দ নিয়ে ভাবতে শিখবে। মানসিক ও আবেগগত সুস্থতার দিকে মনোযোগ মানুষের বেড়েছে। ঢাকা ফ্লোর মতো ওয়েলনেস ইনিশিয়েটিভে বিশেষ প্রোগ্রাম চালু হয়েছে স্ট্রেস রিলিফ, আবেগগত হিলিং এবং ডিজিটাল ডিটক্সের জন্য। করোনার পর থেকে মানসিক স্বাস্থ্যকে কেন্দ্র করে এ ধরনের প্রোগ্রামগুলো টানছে মানুষকে।

নাচ যখন আত্মিক আনন্দের উপাচার

আর্থি আহমেদ ড্যান্স একাডেমি হয়ে উঠেছে এমন এক জায়গা, যেখানে প্রাপ্তবয়স্ক লোকজন নতুন করে নাচের প্রতি তাঁদের ভালোবাসা আবিষ্কার করছেন। প্রতিযোগিতার চাপ নয়, বরং আনন্দ, মানসিক স্বস্তি ও নিজেকে প্রকাশের সুযোগই এখানে মূল লক্ষ্য। কোভিড-পরবর্তী সময়ে শুরু হওয়া আর্থি আহমেদের ‘অ্যাডাল্ট বিগিনার’ কোর্সে আজ ১৮ থেকে ৭০ বছর বয়সী নারী–পুরুষ একসঙ্গে ক্লাস করছেন। ক্লাসগুলো শুধু নাচ শেখার জায়গা নয়, বরং এটি হয়ে উঠেছে একধরনের নিরাপদ ও আনন্দময় কমিউনিটি, যেখানে মানসিক চাপ, জীবনের নানা চ্যালেঞ্জ আর ব্যক্তিগত গল্প ভাগ করে নেওয়ার সুযোগ মেলে। নাচের মাধ্যমে অনেকে মানসিক প্রশান্তি, আত্মবিশ্বাস ও শারীরিক সুস্থতাও ফিরে পাচ্ছেন। আর্থি আহমেদ ড্যান্স একাডেমি তাই এখন শুধু একটি নাচের স্কুল নয়, এটি প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য আনন্দ, আরোগ্য ও একসঙ্গে ভালো থাকার এক অনন্য ঠিকানা। দ্য ফ্লো ফেস্ট থেকে শুরু করে নানা আয়োজনে দেখা যায় এই শিক্ষার্থীদের দলগত অংশগ্রহণ, যা প্রশংসিত হয়েছে সবার কাছে।

বিজ্ঞাপন

দ্য স্টেডিয়াম রান

বিগত কয়েক বছরে ট্রায়াথলন, ডুয়াথলন ও ম্যারাথনের মতো এন্ডোরেন্স স্পোর্টস সব বয়সী মানুষের মধ্যে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সেই ধারাবাহিকতায় প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে আয়োজন করা হলো স্টেডিয়াম রান, যা অনুষ্ঠিত হয় ২৬ ও ২৭ ডিসেম্বর। বাংলাদেশ অ্যাথলেটিকস ফেডারেশন ও কোস্টাল আলট্রার যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এই প্রতিযোগিতায় দৌড়বিদরা অংশ নেন ৬, ১২, ২৪ ও ৩৬ ঘণ্টার বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে। ৪০০ মিটার ল্যাপে চলা এই দৌড় ছিল ইন্ডিওরেন্স চ্যালেঞ্জের এক অনন্য মাইলফলক। ৩৬ ঘণ্টায় ২৩৩ কিলোমিটার দৌড়ে এই ফরম্যাটে দেশে নতুন রেকর্ডও করেন দৌড়বিদ এবাদ। সাধারণত অফ-ট্রেইল, ট্রেইল, সড়ক-মহাসড়ক কিংবা পাহাড়ি পথে অনুষ্ঠিত হলেও, এই প্রথমবার ঢাকার জাতীয় স্টেডিয়ামে স্টেডিয়াম রানের আয়োজন হয়। গ্যালারিতে ফুটবল বা ক্রিকেট ম্যাচের মতো দর্শকদের উচ্ছ্বাস, হাততালি ও উৎসাহ দৌড়বিদদের জন্য তৈরি করে ভিন্ন এক আবহ। এই নতুন ধরনের রেস ফরম্যাট তরুণদের মধ্যে এন্ডিওরেন্স স্পোর্টসের প্রতি নতুন আগ্রহ ও সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেবে এমনটাই প্রত্যাশা আয়োজকদের।

‘২০২৫: সাহস, স্বপ্ন ও রোমাঞ্চের বছর’

২০২৫ সাল হয়ে উঠেছে বাংলাদেশি রোমাঞ্চপ্রেমীদের সাহস ও সক্ষমতার এক প্রতীকী বছর। সমুদ্রের বালু থেকে পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়া, ভয়ংকর আটহাজারি পর্বত থেকে উত্তাল নদীর স্রোত, সবখানেই নিজেদের উপস্থিতি জানান দিয়েছেন বাংলাদেশের তরুণেরা। ইকরামুল শাকিলের ৮৪ দিনের অবিশ্বাস্য যাত্রা শুরু হয় ইনানী সমুদ্রসৈকত থেকে, শেষ হয় মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায়। ডা. বাবর আলী বাংলাদেশি ইতিহাসে প্রথমবার অন্নপূর্ণা-১ জয় করেন। নারীদের স্তন ক্যানসার সচেতনতা গড়ে তুলতে ৭,১২৬ মিটার উঁচু হিমলুং হিমাল জয় করেন নুরুননাহার নিম্নি। ১৮ অক্টোবর, নীলফামারীর দোহল থেকে যাত্রা শুরু করে ৪৮ দিনে প্রায় ৯০০ কিলোমিটার নদীপথ পাড়ি দেন ইন্তিয়াজ মাহমুদ। পাহাড়ে দৌড়, নদীতে অভিযাত্রা আর চূড়ায় পতাকা ওড়ানোর মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে গেছে বাংলাদেশি রোমাঞ্চপ্রেমীরা আর শুধু অংশগ্রহণকারী নয়, তারা ইতিহাস গড়ছে। ২০২৫ তাই কেবল একটি বছর নয়; এটি হয়ে থাকবে সাহস, স্বপ্ন আর সীমা ভাঙার এক মানচিত্র।

বিজ্ঞাপন

২০২৫ সালে ভ্রমণ আর ওয়েলনেসের সংমিশ্রণ এক নতুন মাত্রা পেয়েছে। পর্যটকেরা খুঁজছেন হোলিস্টিক ও পার্সোনালাইজড রিট্রিট, যেখানে ফিটনেস অ্যাকটিভিটি, অর্গানিক বা স্থানীয় উৎসের খাবার, স্পা ট্রিটমেন্ট এবং মাইন্ডফুলনেস ওয়ার্কশপ একসঙ্গে উপভোগ করা যায়। এর মাধ্যমে শরীর ও মন দুটোই পুনরুজ্জীবিত হয়। প্রকৃতি ও অ্যাডভেঞ্চার ভ্রমণ ২০২৫ সালে বিশেষভাবে পেয়েছে জনপ্রিয়তা। শ্রীমঙ্গলের চা–বাগান থেকে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট, দেশের ন্যাশনাল পার্কে হাইকিং, রিভার ক্রুজ ও উপজাতি জীবন অন্বেষণ, সবই তরুণদের কাছে এক নতুন অভিজ্ঞতা। এই ধরনের ভ্রমণে শুধু দেহ নয়, মানসিক শান্তিও বৃদ্ধি পায়।

টেকসই ও কমিউনিটি-ভিত্তিক ট্যুরিজম ২০২৫ সালের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। সরকার ও পর্যটন সংস্থাগুলো সক্রিয়ভাবে প্রচার করছে প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ ও স্থানীয় সম্প্রদায়কে শক্তিশালী করার জন্য। ‘গো গ্রিন, গো বিয়ন্ড’ ক্যাম্পেইন এবং নতুন কমিউনিটি-ভিত্তিক ট্যুরিজম গাইডলাইন এই প্রয়াসের অংশ। ব্র্যাকের ‘অতিথি’, শ্রীমঙ্গলের ‘মনিপুরী সম্প্রদায়’ কিংবা উত্তরবঙ্গের গারো সম্প্রদায়ের হোম স্টে এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

সর্বোপরি, ২০২৫ সালে বাংলাদেশে ওয়েলনেস, ফিটনেস, অ্যাডভেঞ্চার, ভ্রমণ কেবল একটি বিনোদনের মাধ্যম নয়; এটি হয়ে উঠেছে স্বাস্থ্য, মানসিক শান্তি, প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের উন্নয়নের এক দারুণ বিষয় হয়ে থাকবে, আশা করা যায় এর ধারাবাহিকতা আগামী বছরে অব্যাহত থাকবে।

প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২: ১৭
বিজ্ঞাপন