মনে হয় নানা রোগে আক্রান্ত, অথচ পরীক্ষায় মেলে না কিছুই
শেয়ার করুন
ফলো করুন

একজন ব্যক্তি শারীরিক সমস্যা (যেমন ব্যথা, দুর্বলতা, পেটের সমস্যা, মাথাব্যথা ইত্যাদি) অনুভব করেন। এসব উপসর্গ নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা করেন। ডাক্তার দেখান একটার পর একটা, অথচ রোগের কোনো সুরাহা হয় না। নানা পরীক্ষা (যেমন রক্ত পরীক্ষা, এক্স-রে, সিটি স্ক্যান ইত্যাদি) করেও কোনো রোগ বা অসুস্থতার প্রমাণ পাওয়া যায় না। রোগী বলেন রোগ আছে, ডাক্তার বলেন রোগ নেই। এটা এমন একটি মানসিক সমস্যা, যার নাম সোমাটিক সিম্পটম ডিজঅর্ডার (এসএসডি)। এটা এমন উপসর্গ, যা ব্যক্তির জীবনযাত্রা, কাজকর্ম ও সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। মন খারাপ হয়, ওজন কমে, হজমের সমস্যা হয়, নিদ্রাহীনতায় ভোগেন।

অকারণে নানা টেস্ট করিয়ে থাকেন
অকারণে নানা টেস্ট করিয়ে থাকেন

অনেকে এটাকে ‘ভান’ বা ‘মিথ্যা’ ভেবে থাকেন। আসলে বিষয়টা এমন নয়, বরং ব্যক্তির জন্য খুবই বাস্তব আর কষ্টদায়ক। সঠিক চিকিৎসা, মানসিক সহায়তা এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তনের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব।

বর্তমান চিকিৎসাবিজ্ঞান এটাকে সোমাটিক সিম্পটম ডিজঅর্ডার (Somatic Symptom Disorder) বলছে। যদিও আগে এটাই হাইপোকন্ড্রিয়াসিস (Hypochondriasis) বা সোমাটোফর্ম ডিজঅর্ডার (Somatoform Disorder) নামে পরিচিত ছিল।

বিজ্ঞাপন

এসএসডির লক্ষণ

• ব্যক্তি শারীরিক অসুবিধাগুলো নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা করেন। যেমন সামান্য মাথাব্যথাকে মস্তিষ্কের টিউমার হিসেবে ভাবতে পারেন।
• বারবার ডাক্তারের কাছে যান, বিভিন্ন পরীক্ষা করান; কিন্তু ফলাফল স্বাভাবিক থাকলেও তাদের উদ্বেগ কমে না।
• প্রায়ই মনে করেন যে তাদের গুরুতর কোনো রোগ আছে, যা ধরা পড়ছে না।
• উপসর্গগুলো একেক সময় একেক রকম হতে পারে; যেমন পেটে ব্যথা, বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, জয়েন্টে ব্যথা, অবসাদ ইত্যাদি।
কারণ
• দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চাপ, উদ্বেগজনিত সমস্যা বা ট্রমা এই অবস্থার জন্য দায়ী হতে পারে।
• কিছু ব্যক্তি স্বভাবগতভাবে বেশি সংবেদনশীল বা স্বাস্থ্য নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তিত।
• শৈশবে অসুস্থতা বা পরিবারে কারও গুরুতর রোগের ইতিহাস এ ধরনের ভয় তৈরি করতে পারে।
• কিছু সমাজে স্বাস্থ্য নিয়ে অতিরিক্ত সচেতনতা বা রোগের ভয় এই সমস্যাকে উসকে দিতে পারে।
• মস্তিষ্কের কিছু রাসায়নিক ভারসাম্যহীনতা এ ধরনের উপসর্গ সৃষ্টি করতে পারে।

বিজ্ঞাপন

মুক্তির প্রাকৃতিক উপায়

এসএসডি থেকে মুক্তির জন্য প্রাকৃতিক নানা উপায় কার্যকর হতে পারে; বিশেষ করে জীবনযাত্রার ইতিবাচক পরিবর্তন ও মানসিক চাপ কমানোর দিকে মনোযোগ দেওয়া হলে এটা অনেকাংশে কমে। যদিও গুরুতর ক্ষেত্রে পেশাদার চিকিৎসা (যেমন সাইকোথেরাপি বা ওষুধ) প্রয়োজন হতে পারে। প্রাকৃতিক উপায়গুলো উপসর্গ কমাতে এবং সামগ্রিক মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে সহায়ক হতে পারে।
মানসিক চাপ এই সমস্যার একটি প্রধান কারণ হতে পারে। তাই চাপ কমানোর প্রাকৃতিক উপায়গুলো গুরুত্বপূর্ণ। যেমন ধ্যান বা মেডিটেশন: প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ মিনিট মাইন্ডফুলনেস মেডিটেশন করলে মন শান্ত হয় এবং শারীরিক উপসর্গ নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা কমে। গভীর শ্বাসপ্রশ্বাসের ধ্যান খুবই কার্যকর।

প্রকৃতির সঙ্গে সময় কাটানো, বাগান করা, গাছের ছায়ায় বসা বা পার্কে হাঁটা মানসিক চাপ কমায় এবং মেজাজ ভালো করে।

ব্যায়াম শরীরে এন্ডোরফিন নিঃসরণ করে, যা প্রাকৃতিকভাবে মেজাজ ভালো করে এবং উদ্বেগ কমায়। প্রতিদিন ৩০ মিনিট দ্রুত হাঁটা শরীর ও মনের জন্য উপকারী।

খাদ্যও হতে পারে সহায়ক

সুষম খাদ্য: ফল, শাকসবজি, গোটা শস্য (যেমন ওটস, ব্রাউন রাইস), বাদাম ও মাছ (ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডসমৃদ্ধ) মস্তিষ্কের কার্যকারিতা উন্নত করে। কলা, পালংশাক, বাদাম ও অ্যাভোকাডো মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। অতিরিক্ত কফি, চা বা চিনিযুক্ত পানীয় উদ্বেগ বাড়াতে পারে। এর পরিবর্তে হারবাল চা (যেমন ক্যামোমাইল বা পেপারমিন্ট) পান করুন। পর্যাপ্ত পানি পান করা শরীরের হাইড্রেশন বজায় রাখে, যা মাথাব্যথা বা ক্লান্তির মতো উপসর্গ কমায়।

যাপনে পরিবর্তন আনা

প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমাতে ও জাগতে চেষ্টা করুন। শান্ত, অন্ধকার ও ঠান্ডা ঘরে ঘুমান। ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার ঘুমের আগে বন্ধ করুন। গরম পানিতে গোসল, হালকা স্ট্রেচিং বা একটি বই পড়া ঘুমে সাহায্য করে।
শখের কাজ, পড়া, গান শোনা, বাগান করা বা পেইন্টিংয়ের মতো কাজ মনকে শান্ত রাখে। গল্প লেখা, কবিতা বা হাতের কাজ (যেমন সেলাই, মাটির কাজ) মনকে ব্যস্ত রাখে ও উদ্বেগ কমায়।

মেডিটেশনে ফল মেলে
মেডিটেশনে ফল মেলে

বডি স্ক্যান মেডিটেশন: এটি এমন একটি কৌশল, যেখানে আপনি শরীরের প্রতিটি অংশের সংবেদনের দিকে মনোযোগ দেন, কিন্তু তা নিয়ে বিচার করেন না। এটি শরীরের উত্তেজনা কমায়।
গ্রাউন্ডিং টেকনিক: উদ্বেগ বাড়লে ৫-৪-৩-২-১ কৌশল ব্যবহার করুন (৫টি জিনিস দেখুন, ৪টি জিনিস স্পর্শ করুন, ৩টি শব্দ শুনুন, ২টি গন্ধ নিন, ১টি স্বাদ নিন)।
আকুপ্রেশার অত্যন্ত কার্যকর এ ক্ষেত্রে। বিশেষ করে মাথার কিছু পয়েন্টে চাপ দিলে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানো: কথা বলা বা মজার কার্যকলাপে অংশ নেওয়া মানসিক চাপ কমায়। এ ধরনের সমস্যায় আক্রান্ত অন্যদের সঙ্গে কথা বলা স্বস্তি দিতে পারে। এটি বোঝায় যে আপনি একা নন। পোষা প্রাণীর সঙ্গে সময় কাটানো মানসিক চাপ কমাতে পারে।

প্রাকৃতিক সাপ্লিমেন্ট

• ক্যামোমাইল চা: এটি শান্ত করতে সাহায্য করে।
• ল্যাভেন্ডার: ল্যাভেন্ডার তেলের গন্ধ বা ল্যাভেন্ডার চা ঘুম ও মানসিক চাপ কমাতে সহায়ক।
• অশ্বগন্ধা এটি একটি আয়ুর্বেদিক ওষুধ, যা মানসিক চাপ কমাতে ব্যবহৃত হয়।
• ভিটামিন ডি, ম্যাগনেশিয়াম বা ওমেগা-৩ সাপ্লিমেন্ট মেজাজ ভালো করতে পারে।

প্রাকৃতিক উপায়গুলো সোমাটিক সিম্পটম ডিজঅর্ডারের উপসর্গ কমাতে এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে খুবই কার্যকর হতে পারে। মূল লক্ষ্য হলো মানসিক চাপ কমানো, শরীর ও মনের মধ্যে ভারসাম্য তৈরি এবং জীবনযাত্রায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনা। তবে যদি উপসর্গ দীর্ঘদিন ধরে থাকে বা তীব্র হয়, তাহলে এ ছাড়া এমন সমস্যা সাইকোথেরাপি (যেমন সিবিটডি) বা ওষুধের প্রয়োজন হতে পারে। একজন মনোবিজ্ঞানী বা সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে পরামর্শ করা জরুরি।
লেখক: খাদ্যপথ্য বিশেষজ্ঞ; প্রধান নির্বাহী, প্রাকৃতিক নিরাময় কেন্দ্র

ছবি: পেকজেলসডটকম

প্রকাশ: ১০ মে ২০২৫, ০১: ০০
বিজ্ঞাপন