চালতা (ডিলেনিয়া ইন্ডিকা) বাংলা সাহিত্যে প্রায়ই প্রকৃতির প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাংলার বিশেষ ফল, যা লোকজ কথায় অনেক গুণের সমাহার। চালতার বৈজ্ঞানিক নাম ডিলেনিয়া ইন্ডিকা। ইংরেজিতে একে বলা হয় এলিফ্যান্ট অ্যাপল। বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় টকজাতীয় ফল, যা গ্রামাঞ্চলে বেশি দেখা যায়। এটি একটি বিশেষ ফল; এর ভক্ষণযোগ্য অংশ হলো ফুলের মাংসল বৃতি। চালতার পুষ্টিগুণ, ঔষধি গুণ এবং রান্নায় ব্যবহার এটিকে বাংলাদেশ ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায় বিশেষভাবে গ্রহণযোগ্য করেছে। চালতার গুণাগুণ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো, যা আয়ুর্বেদিক দৃষ্টিকোণ এবং আধুনিক পুষ্টিগুণের সমন্বয়ে।
চালতায় এমন কিছু গুণ আছে, যা শুনলে আপনি চমকে উঠবেন। এত গুণে ভরা ফল কীভাবে আমরা অবহেলা করি। এটি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ফল, যা দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষ করে বাংলাদেশ ও ভারতে পাওয়া যায়। এটি টক স্বাদ এবং বিভিন্ন স্বাস্থ্য উপকারিতার জন্য পরিচিত। পুরুষদের অকাল বীর্যপাত এবং শুক্রাণুর স্বল্পতার চিকিৎসায় চালতা ফলের উপকারিতা সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক গবেষণা রয়েছে।
আশা করি, এই লেখা যাঁরা পড়বেন, তাঁরা চালতা অবশ্যই খাবেন এবং সংগ্রহে রাখবেন। গ্রামে একটি হলেও চালতাগাছ লাগাবেন।
চালতা ফল পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ, যা শরীরের বিভিন্ন প্রয়োজন মেটায়। ১০০ গ্রাম চালতার পুষ্টি উপাদান নিম্নরূপ:
· ক্যালোরি: ২৫ কিলোক্যালরি (কম ক্যালোরি, ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়ক)
· প্রোটিন: ১.১ গ্রাম (টিস্যু মেরামত ও বৃদ্ধিতে সহায়ক)
· কার্বোহাইড্রেট: ৬.৮ গ্রাম (শক্তির উৎস)
· ফাইবার: ৩ গ্রাম (হজমে সহায়ক)
· চিনি: ৩.৬ গ্রাম
· চর্বি: ০.১ গ্রাম (চর্বিমুক্ত, হৃদ্রোগের ঝুঁকি কমায়)
· ভিটামিন সি: ৪০ মিলিগ্রাম (অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট, রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায়)
· ভিটামিন এ: ১০০০ আইইউ (চোখ ও ত্বকের স্বাস্থ্যে উপকারী)
· ক্যালসিয়াম: ১০০ মিলিগ্রাম (হাড় ও দাঁত মজবুত করে)
· আয়রন: ১ মিলিগ্রাম (রক্তশূন্যতা প্রতিরোধ)
· পটাসিয়াম: ১৭০ মিলিগ্রাম (রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ)
অন্যান্য: ট্যানিন, ফ্ল্যাভেনয়েড, অক্সালিক, ট্যানিক, ম্যালিক ও সাইট্রিক এসিড, বিটা ক্যারোটিন, থায়ামিন, রিবোফ্লাবিন।
চালতা শুধু একটি সুস্বাদু ফল নয়, এটি আয়ুর্বেদ ও লোকচিকিত্সায় বহু রোগের প্রতিকার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর পাতা, ফল, ছাল ও রস বিভিন্ন রোগের চিকিত্সায় কার্যকর। নিচে প্রধান ঔষধি গুণাবলি উল্লেখ করা হলো:
জ্বর ও সর্দিকাশি নিরাময়: পাকা চালতার রস (৩০ মিলি), চিনি (৩ চামচ) ও পানি (৭০ মিলি) মিশিয়ে দিনে একবার খেলে ঠান্ডাজনিত জ্বর কমে। চালতাগাছের শুকনা ছালের গুঁড়া (১ গ্রাম) চিনি বা মিছরির সঙ্গে মিশিয়ে সামান্য গরম পানিতে দিনে একবার খেলে কফ, কাশি ও সর্দি নিরাময় হয় । এর অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট ও ভিটামিন সি শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ কমায়।
বাত ব্যথা উপশম: কচি চালতা ফল বেটে (৩০ গ্রাম) ঠান্ডা পানির সঙ্গে মিশিয়ে খেলে বাত ব্যথা কমে। এর প্রদাহনাশক গুণ (ট্যানিন ও ফ্ল্যাভেনয়েড) জয়েন্টের ব্যথা ও প্রদাহ কমায়।
হজমশক্তি ও পাকস্থলীর সমস্যা: চালতার টক স্বাদ হজমশক্তি বাড়ায় এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। পাকস্থলীর আলসারের জন্যও এটি উপকারী। এর ফাইবার হজমতন্ত্র পরিষ্কার রাখে।
রক্ত পরিশোধন ও কিডনির স্বাস্থ্য: চালতার রস রক্ত পরিষ্কার করে এবং ডিটক্সিফিকেশনে সহায়তা করে। এটি কিডনির সমস্যায় উপকারী। এর আয়রন রক্তশূন্যতা প্রতিরোধ করে।
কোলেস্টেরল ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ: চালতা ক্ষতিকর কোলেস্টেরল ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। এর কষ গুণ ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য উপকারী। কুসুম গরম পানিতে চালতার রস ও সামান্য চিনি মিশিয়ে খেলে রক্ত শর্করা নিয়ন্ত্রণে থাকে।
হৃদ্রোগ ও লিভারের টনিক: চালতাকে লিভার ও হৃদয়ের টনিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এর ক্যালসিয়াম ও শর্করা হৃদ্রোগের ঝুঁকি কমায়।
ক্যানসার প্রতিরোধ: চালতা জরায়ু ও স্তন ক্যানসার প্রতিরোধে সহায়ক। এর অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট গুণ ক্যানসার কোষের বৃদ্ধি রোধ করতে পারে।
শুক্রাণু ও পুরুষস্বাস্থ্য: পুরুষদের অকাল বীর্যস্খলন ও শুক্রাণুর স্বল্পতায় চালতা উপকারী। এটি শক্তিবর্ধক হিসেবে কাজ করে (১০০ গ্রামে ১৪০ কিলোক্যালরি)।
অন্যান্য: মুখের ঘা, স্কার্ভি, কৃমি, কানের সমস্যা, গর্ভপাত–পরবর্তী জটিলতায় চালতা উপকারী। এর রেচক গুণ কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।
চালতা বাংলাদেশে বিভিন্ন খাবারে ব্যবহৃত হয়। বিশেষত টক স্বাদের জন্য বিশেষভাবে জনপ্রিয়:
· আচার ও চাটনি: চালতার আচার বাঙালির খাবারের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি লবণ, চিনি, তেল, রসুন, আদা, হলুদ, জিরা, ধনে ও মরিচগুঁড়া দিয়ে তৈরি করা হয়।
· টক ডাল: ডাল রান্নায় চালতার টক স্বাদ ব্যবহৃত হয়।
· জেলি ও শরবত: পাকা চালতার রস দিয়ে শরবত আর জেলি তৈরি করা যায়।
· ভর্তা: পাকা চালতা শুকনা মরিচ ও লবণ দিয়ে মেখে ভর্তা হিসেবে খাওয়া হয়।
চালতা টক ফল হওয়ায় অতিরিক্ত খেলে পেটে গ্যাস, অ্যাসিডিটি বা অস্বস্তি হতে পারে।
কারও কারও ক্ষেত্রে চালতা অ্যালার্জি সৃষ্টি করতে পারে, যেমন চুলকানি, ফুসকুড়ি বা শ্বাসকষ্ট। এমন হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
চালতা ফলের পুষ্টিগুণ সামগ্রিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী হলেও, অকাল বীর্যপাত এবং শুক্রাণুর স্বল্পতার চিকিৎসায় এর সরাসরি কার্যকারিতা সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ আছে। এর অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট, ভিটামিন সি ও ম্যাগনেসিয়াম মানসিক চাপ কমাতে, রক্ত সঞ্চালন উন্নত করতে এবং শুক্রাণুর গুণমান রক্ষায় সহায়ক হতে পারে। তবে স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা, নিয়মিত ব্যায়াম এবং পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করা শুক্রাণু স্বল্পতার সমস্যা সমাধানে বেশি কার্যকর।
লেখক: খাদ্য ও পথ্য বিশেষজ্ঞ; প্রধান নির্বাহী, প্রাকৃতিক নিরাময় কেন্দ্র
ছবি: উইকিপিডিয়া