একদিন আমার সাবেক এক সহকর্মী ইমরান সাহেবের সঙ্গে তাঁর শিক্ষাজীবন নিয়ে কথা বলছিলাম। তখন তিনি আমাকে একটি বাক্য বলেছিলেন, তা হলো ‘লাস্ট নাইট ফাইটার’ যার অর্থ দাঁড়ায় পরীক্ষার আগের শেষ রাতে পড়াশোনা। তখন আমি তাঁকে বলছিলাম শেষ রাতে কেন? তখন তিনি প্রতি–উত্তরে বলেছিলেন যে, ‘আজ নয়, কাল পড়ব’ এমন ভাবনা থেকে সব সময় পড়াশোনা জরুরি হওয়া সত্ত্বেও সঠিক সময়ে পড়া পড়তাম না বলে ‘লাস্ট নাইট ফাইটারের’ আবির্ভাব হয়। এর ফলে পরীক্ষার আগে নাকে–মুখে খাবার খাওয়ার মতো করে পড়াশোনা করা হতো। তিনি আরও বলেছিলেন, পরীক্ষার আগে ‘লাস্ট নাইট ফাইটার’ শুধু তাঁর একার হয়েছে তা কিন্তু নয়, তিনি যে হলে থাকতেন, বেশির ভাগ শিক্ষার্থী নাকি এই ‘লাস্ট নাইট ফাইটার’ অভ্যাসে আক্রান্ত ছিল। মনোবিজ্ঞানে ইমরান সাহেবের এই সমস্যাযুক্ত অভ্যাসটিকে কালক্ষেপণ, গড়িমসি অথবা Procrastination বলে।
আপনি একজন শিক্ষার্থী, পেশাজীবী অথবা গৃহিণী যা–ই হোন না কেন, জীবনে কতবার এই গড়িমসি অথবা কালক্ষেপণে আক্রান্ত হয়েছেন তার সঠিক ব্যাখ্যা হয়তো আজ দিতে পারবেন না। তবে এই কালক্ষেপণ বা গড়িমসির জন্য জীবনের অনেক কিছু যে অধরা থেকে গেছে, তা হয়তো এখন অনুভব করেন প্রতিনিয়ত। তাহলে এবার জানা যাক গড়িমসি বা Procrastination কী?
গড়িমসি অথবা আজ নয় কাল করব এমন মনোভাব বা অভ্যাসকে ইংরেজিতে Procrastination বলে। আর বৈজ্ঞানিক সংজ্ঞায় Procrastination এমন একটি মানসিক অবস্থা, যা কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজকে অপ্রয়োজনীয়ভাবে বিলম্বিত করার অভ্যাসকে বোঝায়। যেখানে কম জরুরি, বেশি আনন্দদায়ক ও সহজ কাজ করার প্রক্রিয়াকে ফোকাস করার ফলে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সম্পন্ন করতে দেরি হয়। গবেষণায় দেখা যায়, এই Procrastination শিক্ষার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। তবে অন্য পেশাজীবীদের ক্ষেত্রে এই হার নেহাত কম নয়।
স্নায়বিক গবেষণায় দেখা যায় যে মানুষ যখন কোনো কিছুতে গড়িমসি করে বা গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে রাখে, তখন মস্তিষ্কের লিম্বিক সিস্টেম ও প্রি–ফ্রন্টাল কর্টেক্সের দ্বন্দ্ব চলে এবং এই দ্বন্দ্বে অনেক সময় লিম্বিক সিস্টেম জয়ী হয়; ফলে মস্তিষ্ক দ্রুত গুরুত্বপূর্ণ কাজ ফেলে রেখে ভালো লাগার কাজে মনোনিবেশ করে এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজটি আর করা হয়ে ওঠে না। এতে করে গড়িমসি বা Procrastination অভ্যাস তৈরি হয়।
আসলে অনেক ধরনের কাজ আছে, যেখানে Procrastination ভালো ফল দেয়। বিশেষ করে সৃজনশীল কাজে। কারণ, সৃজনশীল কাজ পরিকল্পনা অনুযায়ী হয় না; কোনো সৃজনশীল চিন্তা করা ও তা বাস্তবায়নে সময় লাগে। ফলে অনেক ধরনের কাজ দিনের পর দিন ফেলে রাখতে হয়। তাই অনেক বিজ্ঞানী Procrastination বা গড়িমসিকে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইতিবাচক বলেছেন। তবে Procrastination–এর ক্ষেত্রে বেশির ভাগ মানুষ নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে বড় বাধা হিসেবে মনে করেন। আপনি কি তাই মনে করেন? কমেন্টে জানাতে পারেন।
ইউটিউব আর সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে Procrastination–এর অনেক ধরনের টিপস খুঁজে পাওয়া যায়, যেগুলো মানবজীবনে গড়িমসি রোধে সাহায্য করে। আজ আমি এমন একটি কৌশলের কথা বলব, যা হয়তো আপনি জীবনে প্রথম জানবেন। এই কৌশলের নাম হলো Procrastination বা গড়িমসি রোধে নেইল আর্ট।
বর্তমান দুনিয়ায় ফ্যাশনসচেতন অনেক নারী ও পুরুষ নেইল আর্ট সম্পর্কে জানেন। নেইল আর্ট হলো নখের ওপর আঁকিবুঁকি করা। আর নখের এই আঁকিবুঁকির ধারণা থেকে আসে গড়িমসিতে নেইল আর্ট কৌশল। গড়িমসিতে নেইল আর্ট আইডিয়াটি পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন আমেরিকান শিক্ষার্থী ওয়ান জং হুং। যিনি তাঁর স্নাতকোত্তর থিসিসে নেইল আর্ট দিয়ে কীভাবে গড়িমসি রোধ করা যায়, সে সম্পর্কে খুব ভালো একটি ধারণা দিয়েছেন এবং তাঁর ধারণাটি পরে কিশোর বয়সী শিক্ষার্থীদের Procrastination বা গড়িমসি রোধে ভালো কাজ করেছে বলে জানা যায়।
অভ্যাস গঠনের বহুল আলোচিত ‘অ্যাটমিক হ্যাবিট’ বইয়ের লেখক জেমস ক্লিয়ার অভ্যাস গঠনের একটি মডেল আলোচনা করেছেন, যা এই নেইল আর্টকে ফলপ্রসূর তকমা লাগাতে যথেষ্ট। লেখক তাঁর বইয়ে অভ্যাস গঠনের জন্য চারটি বিষয়কে অভ্যাস গঠনের মূল হিসেবে আলোকপাত করেছেন। যথা: ১. কোনো নির্দিষ্ট কাজ করার সংকেত পাওয়া, ২. কাজটি করার টান অনুভব করা, ৩.কাজটি করা বা কোনো প্রতিক্রিয়া করা এবং ৪. পুরস্কার গ্রহণ।
একটি নেইল আর্টে কিছু ছবি থাকে, যা সংকেত বা উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে এবং নেইল আর্টের সাংকেতিক ছবিটি নখে থাকে, ফলে তা বারবার চোখে পড়ার ফলে সংকেতের প্রতি সাড়া দেওয়ার প্রবণতা বা টান অনুভূত হয় এবং টানের প্রতি সাড়া দিতে গিয়ে কাজটি সম্পন্ন করতে হয়। সবশেষে অনেক কাঙ্ক্ষিত কোনো কাজ শেষ করতে পারলে যে ভালো লাগা তৈরি হয়, এটাকেই জেমস ক্লিয়ার পুরস্কার বলেছেন। তাহলে নিশ্চয় এবার বুঝতে পারছেন নেইল আর্ট কীভাবে একটি অভ্যাস গঠন অথবা গড়িমসি অভ্যাস পরিবর্তনে সাহায্য করে।
বিশেষ করে আট বছরের ঊর্ধ্ব মেয়েদের জন্য অথবা যারা নেইল পলিশ ব্যবহার করেন।
নেইল আর্ট করতে কী কী প্রয়োজন
আইকন প্রিন্ট, ট্রান্সপারেন্ট বা ওয়াটার কালার নেইল পলিশ, পার্মানেন্ট মার্কার বা সিডি মার্কার, কাগজ, কলম ও ফলস বা আলাদা নেইল (যদি প্রয়োজন হয়)।
ধাপ ১: যে বিষয়টি নিয়ে কালক্ষেপণ বা গড়িমসি হয়, তা নির্ধারণ করা।
ধাপ ২: উক্ত কাজটি সম্পন্ন করতে কী কী করতে হবে তার কৌশলগুলো লিখে ফেলা বা কাজটি সম্পন্ন করার বিষয়গুলোকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করা।
ধাপ ৩: কাজটি সম্পন্ন করতে কত সময় লাগতে পারে, তা নির্ধারণ করা।
ধাপ ৪: অতঃপর নিজের হাত কাগজের ওপর রেখে আঙুলের ছবি আঁকা।
ধাপ ৫: লিপিবদ্ধ কৌশল বা কাজ সম্পন্ন করার ধাপগুলোকে ছবিতে আঁকা বা কাগজে লিখে ফেলা।
ধাপ ৬: আঙুলে লেখা কৌশলগুলোকে উপস্থাপন করে এমন কিছু আইকন স্টিকার নির্বাচন করা।
ধাপ ৭: নির্বাচিত আইকনগুলো নির্দিষ্ট আঙুলে লাগিয়ে তার ওপর ট্রান্সপারেন্ট নেইল পলিশ করা।
ধাপ ৮: যেকোনো আঙুলের নেইল স্টিকারের প্রণীত কৌশল প্রয়োগ শেষ হলে সিডি মার্কার দিয়ে স্টিকারের ওপর টিক চিহ্ন দেওয়া; এতে বোঝা যাবে নির্দিষ্ট কাজটির একটি লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে এবং অন্য নখের প্রণীত স্টিকারের কাজ করতে হবে। এমনভাবে নির্দিষ্ট কাজটি সম্পন্ন করতে হবে।
ধাপ ৯: কাজটি সম্পন্ন হওয়ার পর কৌশলটির মূল্যায়ন করে নিজেকে পুরস্কার দিতে হবে। কারণ, একটি নতুন অভ্যাস নিজের জন্য তৈরি করা হলো।
সবকিছু জানার পর কী মনে হচ্ছে আপনার? নেইল আর্ট দিয়ে কী আসলেই Procrastination বা গড়িমসি অভ্যাস পরিবর্তন সম্ভব।
মনে রাখবেন, সম্ভাবনা তখন বেশ জোরালো হয়, যখন অভিজ্ঞতার সঙ্গে এর সম্পর্ক থাকে। তাই নেইল আর্টের অভিজ্ঞতাটি আপনার গড়িমসি রোধে কতটা কার্যকর হয়েছে, তা আমাদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারেন।
ছবি: পেকজেলসডটকম ও লেখক