আপনাকে যদি প্রশ্ন করি, আজ কী বার ও কত তারিখ? তাহলে খুব সহজে বলে দিতে পারবেন। কেননা, এ মুহূর্তে আপনি আজকের হালফ্যাশন দেখছেন। যদি আরেকটি প্রশ্ন করা হয়, আপনি বার ও তারিখের মতো কতটুকু সময় বর্তমানে থাকেন? তখন দেখবেন আপনি বেশির ভাগ সময় হয় অতীত, না হয় ভবিষ্যৎ নিয়ে আছেন। ফলে অনেক ভালো মুহূর্তগুলো হারিয়ে যায় অতীতের কোনো আফসোস বা ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তায়। অন্যদিকে আপনি যখন কোনো ছবি তোলেন, তখন কিন্তু বর্তমানে থাকেন এবং এই বর্তমানে থাকার অভ্যাস আপনাকে অস্থিরতা, মানসিক চাপ, বিষণ্নতা ইত্যাদি থেকে কিছু সময়ের জন্য হলেও মুক্ত রাখে। ঠিক তেমনিভাবে আর্ট থেরাপির একটি শাখা হিসেবে ফটোথেরাপিও একটি কৌশল। আপনি যখন ছবি তুলছেন, তখন আপনি নিজেকে একটি প্রবাহের মধ্য দিয়ে নিয়ে যান, যা মনকে শান্ত করা এবং মানসিক চাপ থেকে মুক্তি দেওয়ার মতো, ধ্যানের মতো অনেক স্বাস্থ্যসুবিধা নিয়ে আসে।
মনোবৈজ্ঞানিক চিকিৎসায় যখন রোগী ও বিশেষজ্ঞ উভয়ে মিলে ফটোভিত্তিক কোনো সেশন বা কাউন্সেলিং পরিচালনা করেন, তখন সেই সেশনকে থেরাপিউটিক ফটোগ্রাফি বলে। থেরাপিউটিক ফটোগ্রাফি মানে শুধু ছবি তোলা নয়, এটি অন্যান্য ফটো-ইন্টারেকটিভ ক্রিয়াকলাপকে অন্তর্ভুক্ত করে, যেমন ছবি দেখা, পোজিং, প্ল্যানিং, আলোচনা, কল্পনা করা ও ফটোভিত্তিক সৃজনশীল লেখা ইত্যাদি সংযুক্ত থাকে। ২০১৮ সালে ল্যাঙ্কাস্টার ইউনিভার্সিটির গবেষকেরা দেখেছেন, প্রতিদিন একটি ছবি তোলার ফলে মানসিক সুস্থতার উন্নয়ন ঘটে, যেখানে নিজের যত্ন, অন্যদের সঙ্গে সম্পর্ক ও স্মৃতিচারণার সম্ভাবনা বেড়েছে। ফটোগ্রাফি কিন্তু বর্তমানে থাকার একটি সুন্দর কৌশল, যা বর্তমানে মনোবিজ্ঞানীরা মাইন্ডফুলনেস কৌশল বলে থাকেন। ২০১৪ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, যাঁরা ভিজ্যুয়াল আর্ট তৈরিতে অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদের মনস্তাত্ত্বিকে স্থিতিস্থাপকতা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
ফটো তোলা, বিশ্লেষণ এবং অন্যদের সঙ্গে আলোচনা করার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিজের ও বিশ্বের প্রতি একজন ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি ধীরে ধীরে পরিবর্তন করা যেতে পারে। নিউরোপ্লাস্টিসিটি আমাদের বলে যে আমাদের মস্তিষ্ক সারা জীবন ধরে ক্রমাগত পরিবর্তন করায় এবং নতুন সংযোগ বৃদ্ধি করার ক্ষমতা রাখে।
টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেনিস সি পার্কের গবেষণা অনুসারে, ফটোগ্রাফি একটি অত্যন্ত জ্ঞানীয় কার্যকলাপ। তাঁর গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে যাঁরা ডিজিটাল ফটোগ্রাফিতে নিযুক্ত ছিলেন, তাঁরা তাঁদের এপিসোডিক মেমোরি ও যুক্তির দক্ষতা বাড়াতে ও উন্নত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, ছবি বা ফটোগ্রাফি করলেই কি তা ফটোথেরাপি? আসলে উত্তরটি হবে—‘না’। কারণ, উক্ত বিষয়ে প্রশিক্ষিত থেরাপিস্ট অথবা মানসিক স্বাস্থ্য পেশাদারই কেবল কৌশলগুলোকে প্রয়োগ করতে পারেন।
ফটোথেরাপির কৌশলগুলোতে ব্যক্তিগত ছবি, অন্যান্য ব্যক্তির দ্বারা তোলা ছবি এবং থেরাপি অনুশীলনে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ফটো অ্যালবাম অথবা বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যবহার করা ব্যক্তির ছবি, এমনকি ইন্টারনেট থেকে বিভিন্ন সংগৃহীত ছবি ব্যবহার করা হয়। ছবিগুলো একজন ব্যক্তির অনুভূতি, চিন্তাভাবনা, আবেগকে প্রকাশ করতে এবং এমনকি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো মনে রাখতে সাহায্য করে।
উপলব্ধি, আবেগ, সৃজনশীলতা, ব্যক্তিগত পরিচয়, আন্তব্যক্তিক যোগাযোগ ও মানুষের সম্পর্ক বিষয়ে মনস্তাত্ত্বিক নীতিগুলো ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে। আমরা কীভাবে ভিজ্যুয়াল চিত্র তৈরি করি, কীভাবে আমরা সেগুলো ভাগ করি এবং লোকেরা যা দেখে, তার প্রতি কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়। থেরাপিউটিক ফটোগ্রাফি হলো ফটোগ্রাফি ব্যবহার করে একজন ব্যক্তির মনকে সুস্থ করতে ও ইতিবাচক শক্তি আনতে কাজ করে।
মাইন্ডফুল ফটোগ্রাফি অনুশীলন: আজ আমরা ফটোগ্রাফির মাধ্যমে মাইন্ডফুলনেস কৌশলটি ধাপে ধাপে জানার ও প্রয়োগ করার চেষ্টা করব।
মাইন্ডফুলনেস কী: মাইন্ডফুলনেস একটি মনোবৈজ্ঞানিক মনোযোগের দক্ষতা বাড়ানো ও একটি বিষয়কে ভালোভাবে উপলব্ধি করার কৌশল, যেখানে একটি উদ্দেশ্য নিয়ে কোনো বিচার না করে একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তে বর্তমানে থাকা হয়।
মাইন্ডফুল ফটোগ্রাফি কী: আমরা যখন কোনো ছবি তুলি, তখন আমরা ওই মুহূর্তে থাকি। কিন্তু যারা শিক্ষার্থী, তারা যখন পড়তে বসে, তখন তাদের মাথায় বিভিন্ন চিন্তা আসে, যেমন কাল পড়াটি পড়ব, পড়াটি এত কঠিন, ফেসবুকে স্ক্রল করি ইত্যাদি। এই বিষয়গুলো একজন শিক্ষার্থীর মনোযোগকে বিক্ষিপ্ত করে। ফলে পড়াশোনা সম্পন্ন করতে কালক্ষেপণ হয়।
এমন সমস্যা দূর করতে মনোবিজ্ঞানীরা মাইন্ডফুল ফটোগ্রাফি অনুশীলন করতে বলেছেন। মাইন্ডফুল ফটোগ্রাফি মনোযোগ বাড়ানোর বা বর্তমান মুহূর্তে থাকার একটি কৌশল। ওই দক্ষতা পরবর্তীকালে যেকোনো কাজে লাগানো যায়, যেমন পড়ায় মনোযোগ আনতে, অতীত বা ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা কমাতে, অস্থিরতা কমাতে সাহায্য করে।
উপকরণ: যেকোনো ক্যামেরা বা ক্যামেরাযুক্ত মুঠোফোন, নোটবুক, আরামদায়ক পোশাক ও একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য।
কাদের জন্য: ফটোগ্রাফি পছন্দ করেন, এমন ব্যক্তি ও প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য।
ক. ছবি তোলার আগে যা করব
একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ঠিক করে ওই উদ্দেশ্যের ওপর ভিত্তি করে একটি ছবি তোলার বিষয় নির্ধারণ করা।
খ. ছবি তোলার মুহূর্তে
মনে রাখতে হবে, প্রতিটি ধাপ অনুশীলনের সময় মনোযোগ অন্য কিছুতে চলে যেতে পারে, তাই পুনরায় নির্দিষ্ট কাজে মনোযোগ ফিরিয়ে আনতে হবে। বারবার নির্দিষ্ট কাজে মনোযোগ ফিরিয়ে আনলে ব্রেন মাসল তৈরি হয়, যা মনোযোগের সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে। এ ছাড়া কাজটি করতে গেলে অনেক সময় মনে হবে, এটা ভালো না বা এটি পরিবর্তন করলে ভালো হবে ইত্যাদি বিচার–বিশ্লেষণ না করে যা কিছু যেমন আছে, তেমন চিন্তা করে কাজটি সম্পন্ন করতে হবে।
ধাপ ১: কয়েকবার নাক দিয়ে শ্বাস নেব এবং মুখ দিয়ে ধীরে ধীরে ছাড়ব।
ধাপ ২: অতঃপর মুঠোফোন বা ক্যামেরাটি হাতে নিয়ে ভালোমতো প্রতিটি অংশ বা সার্ফেস স্পর্শ করব এবং বিষয়টি অনুভব করব।
ধাপ ৩: তারপর ক্যামেরার সেটিং মনোযোগ দিয়ে সেট করব এবং উদ্দেশ্যভিত্তিক নির্দিষ্ট বিষয়ের দিকে ও আশপাশে তাকিয়ে বিভিন্ন রংসহ যে বৈচিত্র্য চোখে পড়বে, তা দেখব এবং স্পর্শ করার সম্ভব হলে স্পর্শ করব। মনে রাখতে হবে, এই ধাপে প্রতিটি অংশ যত সূক্ষ্ণভাবে দেখা যায়, অনুভব করা যায় এবং বিষয়টি যেমন আছে, ঠিক তেমনভাবে গ্রহণ করতে বর্তমান বা ওই মুহূর্তে থাকার অনুশীলন করা।
ধাপ ৪: সুন্দর করে নির্দিষ্ট বিষয়ে ক্লিক করা ও সাথে ক্লিক করার শব্দ এবং ক্যামেরার স্ন্যাপ নেওয়ার মুহূর্ত অনুভব করা।
ধাপ ৫: নির্দিষ্ট ছবিটি ক্যামেরার ডিসপ্লেতে সূক্ষ্ণভাবে দেখা ও ওই মুহূর্তে থাকা।
গ. ছবি তোলার পর
মাইন্ডফুল ফটোগ্রাফির অভিজ্ঞতাটি নোটবুকে নিম্নের প্রশ্নগুলোর আলোকে উত্তর দিন।
১। বর্তমান উপস্থিতি: প্রতিটি মুহূর্তে বিচার বিবেচনা না করে সম্পূর্ণরূপে কতটুকু সময় বর্তমানে উপস্থিত ছিলেন তা লিখুন।
২। সচেতনতা: কতটুকু সময় সচেতনভাবে নিজের চারপাশে মনোযোগ দিতে পেরেছিলেন, তা লিখুন। যেমন প্রতিটি রং, আকার ও টেক্সচার, শব্দ ইত্যাদি।
৩। গ্রহণযোগ্যতা: তোলা ছবিগুলো বিচার না করে বা দৃশ্যটি হেরফের না করে কী ছবি তুলতে পেরেছিলেন, না পারলে কেন পারেননি, তা লিখুন।
৪। সংযোগ: নিজের তোলা ছবি ও পরিবেশের সঙ্গে কী কোনো সংযোগ তৈরি করতে পেরেছিলেন? পারলে তা লিখুন।
৫। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত: আপনি যে উদ্দেশ্য নিয়ে বর্তমানে সচেতন থাকতে চেয়েছিলেন, তার কতটুকু অর্জন হয়েছে তা লিখুন।
৬। প্রতিফলন: মাইন্ডফুল ফটোগ্রাফির অভিজ্ঞতা নিজের বাস্তব জীবনে কোন কোন বিষয়ে প্রয়োগ করা যায় বলে মনে করেন, তা লিখুন এবং অনুশীলন অব্যাহত রাখুন।
মাইন্ডফুল ফটোগ্রাফি অনুশীলন করা একধরনের ধ্যানের মতো, যা অনুশীলন করা ব্যক্তিদের চারপাশের বিশ্বের সঙ্গে সচেতনতা, উপলব্ধি ও সংযোগের একটি বৃহত্তর অনুভূতি গড়ে তুলতে সাহায্য করে। থেরাপিউটিক ফটোগ্রাফির ফোকাস শুধু ছবির ওপর থাকে না, বরং দেখা, অনুভব করা ও অভিজ্ঞতার প্রক্রিয়ার ওপর থাকে। তাই আপনার আজকের ফটোগ্রাফি হোক একটি থেরাপিউটিক ফটোগ্রাফি, এই প্রত্যাশায়।
লেখক: মনোবিজ্ঞানী ও আর্ট থেরাপিস্ট
ছবি: পেকজেলসডটকম