প্রবাসের পথে পথে ২: জেনে নিন কালো রসুনের ভালো গুণ

ফ্রান্সের দক্ষিণে গারোঁন নদীর তীরে ছবির চেয়ে সুন্দর একটি শহর আছে, নাম তুলুজ। ইউরোপের বিমান, মহাকাশবিজ্ঞান ও প্রযুক্তির রাজধানী। পর্যটকদের খুব পছন্দ এই শহরে পা রাখলেই নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে সবাই, ভ্রমণের নেশা। শহরের প্রাণকেন্দ্রে আট শতকের প্রাচীন দৃষ্টিনন্দন বিশাল এক প্রাসাদসম ভবনের চত্বর ‘প্লাস ক্যাপিতল’। এই ভবনের ঠিক পেছনেই দৃষ্টিশোভিত পর্যটন অফিস। রোববার বাদে সপ্তাহের অন্য দিনগুলোতে পর্যটন অফিস চত্বরে দূরদূরান্ত থেকে কৃষক ও কুটিরশিল্পীরা আসেন তাঁদের গ্রামীণ পণ্য নিয়ে। দেশি-বিদেশি কৌতূহলী পর্যটকেরা তাজা ফলমূল, হাঁস-মুরগি, কোয়েল, পায়রার মাংস, ডিম, মধু, রুটি, মসলাসহ অনেক কিছু সরাসরি তাঁদের কাছ থেকে কিনতে পারেন। ইচ্ছা করলে বিক্রেতাদের সঙ্গে খানিকটা আলাপ করতেও পারেন। তাঁরা আপনাকে বলে দেবেন তাঁদের পণ্যের রন্ধনপ্রণালি, পুষ্টিগুণ, এমনকি উৎপাদন কৌশলও।

ভাগ্য ভালো হলে শনিবার এখানেই দেখা মিলবে মারি-লুস ও মিশেঁল দম্পতির। এই যুগলের পণ্যভান্ডারে আছে রসুন। আমরা যেভাবে রসুন চিনি, তেমন সাধারণ রসুন নয়। মারি-লুস ও মিশেঁলের কাছে মিলবে ‘কালো রসুন’। সাধারণত রসুনের কোয়ার রং হালকা মাখন-সাদা। কালো রসুনের কোয়ার রং কুচকুচে কালো। আমি কৌতূহলী হই। মারি-লুস ও মিশেঁল—দুজনেই খুব আন্তরিক। আমি আলাপ জুড়ে দিই।

গ্রামের এক উৎসবে দুজনের প্রথম দেখা হয়। প্রথম দেখায় ভালোবাসার তড়িৎ দুজনকেই ত্বরিত ছুঁয়ে যায়। এরপর আরেকবার দুজনে প্রেমে পড়েন কালো রসুনের। সেই ১৯৯৯ সাল থেকে তাঁরা দুজনেই যত্ন করে সাদা রসুনকে কালো করছেন এবং দুজনেই একসঙ্গে দূরদূরান্তের বাজারগুলোতে ছুটে যান নিজেদের পণ্যসম্ভার নিয়ে। তুলুজে আসেন শনিবার। আমি প্রগলভ হই, অনেকগুলো প্রশ্ন ছুড়ে দিই। ব্যস্ততার মধ্যেও খুব সুন্দর করে আমার অনুসন্ধিত্সা মেটাই।

কালো রসুন প্রাকৃতিক নয়। খেত থেকে তাজা রসুন সংগ্রহের পর মাসখানেক ছায়ায় শুকিয়ে নিতে হয়। এরপর সে রসুনকে খোসাসহ ৬০ থেকে ৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ আর্দ্রতায় তিন সপ্তাহ রেখে দিলেই প্রস্তুত হবে কালো রসুন। এখানে নির্দিষ্ট তাপ ও আর্দ্রতার কারণে রসুনের কোয়ায় থাকা এনজাইম বা অনুঘটকের প্রভাবে অভ্যন্তরীণ উপাদান, বিশেষ করে শর্করার পরিবর্তন ঘটে। ফলে চমৎকার ঘ্রাণ এবং হালকা টক-মিষ্টি স্বাদ সৃষ্টি হয়। কাঁচা রসুনের স্বাদ ও ঝাঁজের সঙ্গে কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না।

এমনিতেই রসুন বিশ্বব্যাপী সমাদৃত এবং আমাদের দৈনন্দিন খাবারে ব্যবহৃত একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। যকৃত, হৃৎপিণ্ডের সুরক্ষা, পাকস্থলীর আলসার ও ক্যানসার প্রতিরোধ, কোলেস্টেরলের মাত্রা ও উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ, রক্তসঞ্চালনের ক্ষমতা বৃদ্ধি, হজমের সমস্যা দূরীকরণ, মুখত্বকে রুক্ষতা দূর করে উজ্জ্বলতা, লাবণ্য বৃদ্ধি, প্রদাহ প্রশমন ও ঠান্ডা, সর্দি-জ্বর উপশমে রসুনের বিস্ময়কর গুণের কথা আমাদের অজানা নয়। বিশেষ করে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধিতে রসুন খুবই উপকারী। খাবারের স্বাদ বৃদ্ধি এবং পুষ্টি ও ঔষধি গুণের জন্য একে ‘সুপারফুড’ বলা হয়। সব থেকে বড় কথা, কালো রসুনে পুষ্টিগুণের তেমন কোনো পরিবর্তন হয় না, বরং বৃদ্ধি পায় এবং মানব দেহের কোষ এর থেকে উপকারী রাসায়নিক সহজেই শোষণ করে দেহের সুরক্ষা নিশ্চিত করে।

সুন্দর ঘ্রাণ ও স্বাদের জন্য ফরাসি কালো রসুন শেফদের খুব পছন্দ। তাই তাঁরা রন্ধনশিল্পের কৌলিন্য বৃদ্ধিতে এমন চমৎকার উপাদান অনেক দক্ষতায় ব্যবহার করে থাকেন। এর বিশেষত্ব হচ্ছে, নোনতা ও মিষ্টি এবং সব ধরনের খাবারে ব্যবহার করা যায়। ডেজার্ট সাজাতে অনেক শেফ কালো রসুন বেছে নেন। মাখনের মতো রুটিতে লাগিয়ে খাওয়া যেতে পারে। তবে পুষ্টিবিদ ও চিকিৎসকেরা প্রতিদিন সকালে খালি পেটে একটি কিংবা সর্বাধিক দুটি কোয়া খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

অ্যালার্জি থাকলে অথবা অস্ত্রোপচারের আগে ও পরে কালো রসুন খাওয়া উচিত হবে না।

আমার চলে যাওয়ার সময় হয়। আমি ছবি তুলতে চাইলে তাঁরা আমাকে সানন্দে অনুমতি দেন। আমি খুশি হই। কালো রসুনের ভালো গুণ জেনে আনন্দ আমার পিছু নেয়।