সম্পর্কের সমীকরণ
শেয়ার করুন
ফলো করুন

‘সম্পর্ক’ শব্দটির অর্থ হলো সম্বন্ধ বা সংযোগ। এটি কখনো একক নয়, বরং দ্বিপক্ষীয়। এই সম্পর্ক হতে পারে মানুষে মানুষে, মানুষের সঙ্গে কোনো প্রাণীর বা বস্তুর; অর্থাৎ এককথায় সম্পর্ক হলো সংযোগের মাধ্যম। আজকে আমরা মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক নিয়ে ভাবব। সম্পর্ক হলো দুই বা তার অধিক মানুষের মধ্যে পারস্পরিক অনুভূতি প্রকাশের একটি অদৃশ্য মাধ্যম, যা অনেক পারিপার্শ্বিক বিষয়ের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। দুজন মানুষের পরস্পরের আচরণের ধরনের ওপর ভিত্তি করে যে প্রত্যাশা জন্ম নেয়, সেটাই সম্পর্ক।

সম্পর্ক তৈরিতে থাকে  বিশেষ ধরনের দায়িত্ববোধ
সম্পর্ক তৈরিতে থাকে বিশেষ ধরনের দায়িত্ববোধ
ছবি: সাইফুল ইসলাম

আর এই সম্পর্ক তৈরিতে থাকে একটি বিশেষ ধরনের দায়িত্ববোধ; যেমন অন্যের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হবে? কোন প্রেক্ষাপটে কী আচরণ করতে হবে? কী আচরণ করা যাবে, আর কী করা যাবে না ইত্যাদি। এই দায়িত্ববোধের দক্ষতা ব্যক্তিকে নিজে থেকে অর্জন করতে হয়; কিন্তু সচরাচর দেখা যায় যে আমরা যেকোনো ধরনের দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে বড্ড উদাসীন বা অন্যের কাঁধে বন্দুক রেখে চলতে চাই। তাতে বিভিন্ন রকমের জটিল সমস্যা ক্রমে বেড়েই চলে। যে কারণে বিবাহ বা সম্পর্কের বিচ্ছেদ, মাদক সেবন, মারামারি, ঝগড়া, অভিমান ও আত্মহত্যার প্রবণতাও দেখা যায়।

বিজ্ঞাপন

একটি গবেষণায় সুখী মানুষ কারা বা সুখের সূচক কী, এমন প্রশ্নের উত্তরে যা পাওয়া গিয়েছিল তা হলো, সম্পর্ককে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারাই হলো সুখ। যাঁরা কাজটি সঠিকভাবে করতে পারেন তাঁরাই প্রকৃত সুখী।

তাহলে নিশ্চয় এবার মনে প্রশ্ন জাগছে যে এই সম্পর্কের দায়িত্ববোধের দক্ষতা কী? এই প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, সম্পর্কের দায়িত্ববোধ হলো ব্যক্তি নিজে অন্যের সঙ্গে কী প্রতিক্রিয়া বা আচরণ করে। যে প্রতিক্রিয়া বা আচরণ অন্যের সঙ্গে করা হচ্ছে, তা কি ঠিক? কারণ, ব্যক্তির স্বপ্রতিক্রিয়াই নির্ধারণ করে অপর ব্যক্তি কী ধরনের আচরণ করবে। আমরা অনেক সময় ভুল প্রতিক্রিয়া দেখানোর কিছু সময় পর যখন চিন্তা করি যে আচরণ করা হয়েছিল, তা ঠিক করিনি। আর তাই অন্যের কাছে অনুশোচনার মাধ্যমে ক্ষমা চাই। কিন্তু কখনো কি ভেবেছেন, আপনি যার কাছে ক্ষমা চাইলেন, তিনি তার ভেতর থেকে ক্ষমা করতে পেরেছেন কি না? এই প্রক্রিয়াকে ভুল থ্রি–আর (রিঅ্যাক্ট, রি–থিঙ্ক ও রি–গ্রেট) বলা হয়।

বিজ্ঞাপন

চিত্র-ভুল থ্রি–আর প্রক্রিয়া

ভুল থ্রি-আর প্রক্রিয়া
ভুল থ্রি-আর প্রক্রিয়া
ছবি: লেখক

আসলে কি এতে একটি সম্পর্ক আবার আগের মতো এগিয়ে যায়, নাকি সমস্যা থেকেই যায়? তা আমরা নিচের একটি আর্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করব।
উপকরণ যা লাগবে:
১. সাদা কাগজ
২. রংপেনসিল বা প্যাস্টেল
৩. টিস্যু পেপার
৪. নোটবুক

ধাপ ১: প্রথমে একটি সাদা কাগজ বা আর্ট পেপার নিই (চিত্র-১)।

চিত্র-১
চিত্র-১
ছবি: লেখক

ধাপ ২: আর্ট পেপারে ভুল প্রতিক্রিয়া পুনর্বিবেচনা না করে অন্যকে কতটুকু কষ্ট দিয়েছি তার ছবি আঁকি। মনে রাখতে হবে যাদের বেশি কষ্ট দিয়েছি, সেই ছবিগুলো তুলনামূলক বড় এবং গাঢ় রং ব্যবহার করব। আর যেগুলো কম কষ্টের, সেগুলো হালকা রং এবং আকারে ছোট হবে। তবে একটি কাগজে যে কটি ছবি উপস্থাপন করা যায়, সে কটি ছবি আঁকার চেষ্টা করব।

চিত্র-২
চিত্র-২
ছবি: লেখক

ছবিগুলো যেহেতু কষ্টের মাত্রাকে উপস্থাপন করবে, তাই বিস্তারিত ছবি না আঁকলেও চলবে। প্রতিটা ছবির একটি শিরোনাম দেব (চিত্র-২)।

ধাপ ৩: ছবি আঁকা শেষ হওয়ার পর টিস্যু পেপার দিয়ে ছবিগুলোকে মুছে ফেলার চেষ্টা করব (চিত্র ৩)।

চিত্র-৩
চিত্র-৩
ছবি: লেখক

ধাপ ৪: ছবি মোছা হয়ে গেলে ছবিটি পর্যবেক্ষণ করব ও বোঝার চেষ্টা করব এবং কাগজ থেকে সম্পূর্ণ ছবি বা রং মুছে গেছে কি না, সেটা খেয়াল করব।

আসলে ছবি বা রং সম্পূর্ণরূপে মুছে যাবে না। কাগজে কিছু না কিছু রং বা আঁকার দাগ থেকেই যাবে (চিত্র-৪)

চিত্র-৪
চিত্র-৪
ছবি: লেখক

ঠিক তেমনই, ভুল প্রতিক্রিয়ার কারণে যখন আমরা আবার প্রতিক্রিয়াটিকে নিয়ে চিন্তা করি এবং ভাবি যে এমন আচরণ করা ঠিক হয়নি, তখন অনুশোচনা বোধ করি এবং পরে ক্ষমা চাই। কিন্তু অপর ব্যক্তি মৌখিকভাবে ক্ষমা করলেও অনেক দিন পর্যন্ত মুছে না যাওয়া দাগ বা আঁকা ছবির মতো অনেক কষ্ট বয়ে নিয়ে বেড়ায়। কারণ, অন্যকে ক্ষমা করে দেওয়া বেশ কঠিন একটি কাজ।

সঠিক থ্রি–আর প্রক্রিয়া
সঠিক থ্রি–আর প্রক্রিয়া
ছবি: লেখক

তাহলে কী করা যায়? যখন আমরা এমন কোনো পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাব, তখন কোন প্রতিক্রিয়া বা আচরণ করব, তা নির্ভর করবে থ্রি-আর পদ্ধতিটি ভিন্নভাবে উপস্থাপন করার মাধ্যমে, যাকে মনোবিজ্ঞানীরা সঠিক থ্রি–আর বলেছেন।

ধাপ-৫: পুনরায় মুছে ফেলা আর্ট পেপারটি ভালো করে পর্যবেক্ষণ করি ও নোটবুকে নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর বের করি (চিত্র-৫)

আপনার মুছে ফেলা ছবির ঘটনায় কীভাবে ভুল প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারতেন?

তখন কী চিন্তা করা যেত, বা কী পদক্ষেপ নিলে অন্যকে আর কষ্ট দিতে হতো না?
কী ধরনের আচরণ বা প্রতিক্রিয়া করা যেতে পারত?

এখন থেকে সম্পর্কের প্রতিক্রিয়া বা আচরণ প্রকাশ করার আগে নিজের দায়িত্বে কীভাবে সঠিক থ্রি–আর প্রক্রিয়াটি ব্যবহার করবেন?

চিত্র-৫
চিত্র-৫
ছবি: পেকজেলসডটকম

মনে রাখতে হবে, সম্পর্ক একটি গাছের শিকড়ের মতো হওয়া উচিত, ফুলের মতো নয়। কারণ, ফুল শুধু সুবাস দিয়েই ঝরে যায়, কিন্তু শিকড় আমৃত্যু থেকে যায়। সম্পর্কের এই শিকড়কে মজবুত করতে প্রয়োজন পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সততা, মায়া, মমতা ও ভালোবাসা।

তাই সম্পর্কের সমীকরণে নিজের আচরণের দায়িত্ব নিতে হবে এবং অন্যকে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। তাহলেই সম্পর্ক হবে সুদৃঢ়, সুস্থ ও সুন্দর।

প্রকাশ: ১৪ মে ২০২২, ০৫: ২৬
বিজ্ঞাপন