আপনি দিনের পর দিন চেষ্টা করছেন, খাবার নিয়ন্ত্রণ করছেন, নিয়মিত ব্যায়াম করছেন, এমনকি লিফট এড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামছেন; তবুও ওজন কমছে না! ওজন মাপার মেশিনকে যেন রোদ-বৃষ্টির মতো খেয়ালী মনে হচ্ছে আপনার কাছে। কেননা আপনার কষ্টের প্রতিফলন তাতে দেখা যাচ্ছে না। এমন অবস্থায় আপনি হয়তো নিজেকেই প্রশ্ন করছেন যে সব ঠিক করেও কেন ফল পাচ্ছি না? যদি আপনার উচ্চতা তুলনামূলকভাবে কম হয়, তাহলে এই হতাশা আরও গভীর হতে পারে। জানলে অবাক হবেন যে এটা শুধু আপনার একার নয়, বরং কম উচ্চতার মানুষদের ক্ষেত্রে ওজন কমানো সত্যিই একটু বেশি কঠিন হতে পারে। তবে সেটা কমানো অসম্ভব কিছু নয়। শুধু প্রয়োজন একটু সচেতনতা, সঠিক পরিকল্পনা, আর নিজের শরীরকে ভালোভাবে বোঝা। চলুন এ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিই-
কম উচ্চতার ক্ষেত্রে গাণিতিক হিসাব আলাদা
গাণিতিক হিসাব খাটোদের পক্ষে নয়। একটা বাস্তব কথা হলো আপনি যদি কম উচ্চতার হন, আপনার শরীরের দৈনন্দিন কাজকর্ম চালাতে তুলনামূলকভাবে কম ক্যালরির প্রয়োজন পড়ে। কারণ আপনার শরীরের আকার ছোট হওয়ায় বেসাল মেটাবলিক রেট (BMR)অর্থাৎ বিশ্রামে থাকা অবস্থায় যে ক্যালরি পুড়ে যায় তা কম থাকে। যেমন ধরুন, আপনার লম্বা বন্ধুটি যদি প্রতিদিন ২২০০ ক্যালরি খেয়ে ওজন ধরে রাখতে পারেন, আপনি হয়তো সেটি পারবেন ১৬০০-১৭০০ ক্যালরিতে।
ফলে ওজন কমাতে যে ক্যালরির ঘাটতি বা ক্যালরি ডেফিসিট দরকার, সেটা তৈরি করাও তখন কঠিন হয়ে পড়ে। বাস্তবে এর মানে দাঁড়াচ্ছে যে ওজন ঠিক রেখেও তিনি হয়তো অতিরিক্ত খাবার খেতে পারেন, আপনি পারবেন না। এটা কিছুটা অন্যায় বলেই আপনার কাছে মনে হতে পারে।
খাটো হলে ৫ পাউন্ডই যেন ১৫ পাউন্ড
একটা ছোট বাস্তবতা হল খাটো মানুষের শরীরে ওজন বাড়াটা দৃষ্টিগোচর হয় খুবই দ্রুত। যদি আপনি হন ৫'২\", আর ওজন বেড়ে যায় মাত্র ৫ পাউন্ড, সেটা আপনার শরীরে বেশ ভালোমতোই বোঝা যাবে। অন্যদিকে, কেউ যদি ৫'১০" হন, তাদের শরীরে এই একই পরিমাণ ওজন তেমনভাবে বোঝা যায় না। এই জন্যই, খাটো মানুষেরা যখন বলেন, "আমি তো মাত্র ৮-১০ পাউন্ড কমাতে চাই," সেটা তখন বাস্তবে অনেক বড় যুদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়। তবে এখানেই একটা আশার খবর হচ্ছে যে, আপনি যদি কম উচ্চতার হয়ে থাকেন, তাহলে অল্প ওজন কমলেই আপনার শরীরে তার প্রভাব বোঝা যাবে। আর এই দৃশ্যমান সাফল্যই হতে পারে আপনার ওজন কমানোর সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা।
ব্যায়ামে বুদ্ধি খাটান
ব্যায়াম করে শুধু বেশি ঘামানো মানেই আপনার ওজন কমে আসবে ব্যাপার আসলে এমন নয়। এখানে দরকার আছে বুদ্ধি খাটানোর। অনেকেই ভাবেন, যত বেশি কার্ডিও করবেন, তত বেশি ওজন কমবে। কিন্তু যদি আপনার উচ্চতা কম হয়, তাহলে একই পরিমাণ ব্যায়ামে আপনি তুলনামূলক কম ক্যালরি পোড়াবেন। কারণ আপনার শরীরের ওজন কম, তাই শক্তির প্রয়োজনও কম পড়ে।
তাহলে এক্ষেত্রে যা করবেন
আপনি শক্তি বাড়ানোর ব্যায়াম করুন। অর্থাৎ, ওজন তোলা, নিজের ওজন নিয়ে ব্যায়াম করা (বডি ওয়েট এক্সারসাইজ), অথবা রেজিস্ট্যান্স ব্যান্ড ব্যবহার করা। এগুলো আপনার শরীরে পেশি তৈরি করবে, আর পেশি থাকার কারণে বিশ্রামের সময়ও শরীর বেশি ক্যালরি পোড়াবে। এছাড়াও NEAT-এ (Non-Exercise Activity Thermogenesis) মন দিন। এর মানে হলো, দিনে ছোট ছোট কাজগুলো যেমন বাস ধরতে দৌড়ানো, ঘর ঝাড়ু দেওয়া, ফোনে কথা বলতে হাঁটাহাঁটি করা এসব ছোট ছোট মুভমেন্টও আপনার শরীরের ক্যালোরি খরচ বাড়ায়। সুতরাং, শুধু জিমে অনেকক্ষণ সময় দেওয়া নয়, স্মার্টলি কাজ করে ব্যায়াম করুন এবং দৈনন্দিন ছোট ছোট কাজগুলোকে গুরুত্ব দিন।
ক্ষুধা তো উচ্চতার কথা শোনে না
আপনি যদি তুলনামূলক খাটো হন, তাহলে আপনার দৈনিক ক্যালরির প্রয়োজন স্বাভাবিকভাবেই একটু কম থাকে। কিন্তু তাতে ক্ষুধা তো কমে না! ক্ষুধা তো শরীরের উচ্চতা নয়,অনুভূতির সঙ্গে চলে। এইটাই খাটো মানুষদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সেটি হল কম ক্যালরিতে পেট ভরিয়ে খাওয়া।তাই খাদ্যতালিকায় এমন সব খাবার রাখা দরকার, যা কম ক্যালোরিতে দীর্ঘ সময় ধরে পেট ভরিয়ে রাখে এবং তৃপ্তি দেয়। যেমন:
● আঁশযুক্ত খাবার: সবজি, গাজর, আপেল, কমলা। এগুলো হজম হতে সময় নেয়, ফলে অনেকক্ষণ ক্ষুধা লাগে না। একই সঙ্গে পেটও পরিষ্কার থাকে।
● লিন প্রোটিন: ডিমের সাদা অংশ, সেদ্ধ বা গ্রিল করা মাছ ও মুরগি, টোফু। এই খাবারগুলো পেশি গঠনে সাহায্য করে এবং দীর্ঘ সময় ধরে আমাদের পেট ভরা রাখে।
● স্বাস্থ্যকর চর্বি: বাদাম, চিনা বাদাম, অ্যাভোকাডো, অলিভ অয়েল বা চিয়া সিডস। এইসব খাবার পরিমাণ মতন খেলে মস্তিষ্ক সজাগ থাকে, মন ভালো থাকে, আর অল্পতেই পেট ভরে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ক্রল করতে গিয়ে অনেক সময় আমরা দেখি ,আমার বান্ধবী তো মাত্র ১৫ দিনেই ৫ কেজি ওজন কমিয়ে ফেলেছে! অথচ আপনি হয়তো তিন সপ্তাহে ১ কেজিও কমাতে পারেননি। তখন আপনার মন খারাপ হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আপনাকে বুঝে নিতে হবে যে, প্রতিটি শরীরের গঠন ভিন্ন, বিপাকক্রিয়া ভিন্ন, ওজন কমানোর গতিও ভিন্ন।
যাঁদের উচ্চতা কম, তাঁদের ক্ষেত্রে ওজন কমানোর ক্যালরি হিসাবটা একটু কঠিন হতে পারে। কিন্তু আপনার কাছে সেটাই তো চ্যালেঞ্জ, নিজের সীমার মধ্যেই নিজের সম্ভাবনাগুলো খুঁজে বের করা। এর জন্য আপনাকে যা করতে হবে-
● নিজেকে জোর করে জিমে ঠেলে দেবেন না।
● বরং এমন ব্যায়াম বেছে নিন, যেটা আপনাকে আনন্দ দেয়। যেমন নাচ, জুম্বা, যোগব্যায়াম, হাঁটতে হাঁটতে গান শোনা, কিংবা হালকা ওজন তোলা। যেটা আপনাকে মানসিক প্রশান্তি দেয়, আপনি সেটাই ধরে রাখুন।
● প্রতিদিন ১০ মিনিট হাঁটা, চিনি কমানো, একদিন ভাজা খাবার না খাওয়া, এই ছোট অর্জনগুলোই আপনাকে দীর্ঘপথে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
● প্রয়োজনে পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিন।
● পর্যাপ্ত ঘুমান ও বিশ্রাম নিন।
● নিজের মেজাজ ভালো রাখুন।
শেষ কথা হচ্ছে, ওজন কমানো কোনো প্রতিযোগিতা নয় বরং এটা একেকজনের নিজের সঙ্গে নিজের একটা যাত্রা। আপনি খাটো হোন বা লম্বা, আপনার শরীরই আপনার ঘর, সেটাকে ভালোবাসা আর যত্ন দিয়ে গড়ে তুলুন। খাবারে সচেতনতা, মানসিক শান্তি, আর আনন্দের সঙ্গে চলা জীবনযাপন, এই তিনটিই হতে পারে আপনার দীর্ঘমেয়াদি ফিটনেসের চাবিকাঠি।
তথ্যসূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া
ছবি: পেকজেলস