বাইরে প্রচণ্ড গরম। বাড়ি ফিরলেই ঠান্ডা শরবত খেতে ইচ্ছা হচ্ছে। হাত চলে যাচ্ছে ফ্রিজে রাখা আইস কিউবের ট্রের দিকে। রেফ্রিজারেটরের জন্ম হয়েছে এই সেদিন, ১৯১৩ সালে। আমাদের এই অঞ্চলে ফ্রিজ আসে আরও পরে। ১৯২৮ সালের দিকে। ভারতে প্রথম ফ্রিজ তৈরি শুরু হয়, তারও বছর ৩০ পরে, ১৯৫৮ সালে ‘গোদরেজ অ্যান্ড বয়েস’ ভারতে প্রথম ফ্রিজ তৈরি করা শুরু করে। অবশ্য ফ্রিজ ঘরে ঘরে পরিচিতি পায় সত্তরের দশক থেকে।
তবে ভারতবর্ষে গরমকাল এলেই বরফের প্রয়োজনীয়তা অনুভবের ব্যাপারটি কিন্তু চিরন্তন। তাই ফ্রিজ ছাড়াই তৈরি হতো বরফ। মোগল আমলে এই ব্যবস্থা চালু ছিল। আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরি’ গ্রন্থে বরফঘরের উল্লেখ পাওয়া যায়। এর অর্থ হলো মোগল সম্রাট আকবরের আগে থেকেই ভারতবর্ষে বরফ তৈরির প্রচলন ছিল।
প্রচলিত আছে, বাদশাহ হুমায়ুনের দরবারে পারস্য থেকে আগত পারদর্শী প্রকৌশলীরা কাজ করতেন। ভূগর্ভস্থ বরফঘর তাঁদেরই তৈরি করা। বাদশাহ হুমায়ুনের জীবনযাপন ছিল বেশ বিলাসবহুল। গরম তিনি একেবারেই সহ্য করতে পারতেন না। তাই তো শেরশাহকে ধাওয়া করে যখন বাংলায় আসেন, এত গাছপালা, সুশীতল আবহাওয়া দেখে তিনি মুগ্ধ হন। এই এলাকার নাম দিয়েছিলেন ‘জান্নাতাবাদ’। থেকেও যান বেশ অনেক দিন।
হুমায়ুনের পর তাঁর পুত্র সম্রাট আকবর সিংহাসনে বসলেন। আকবর ছিলেন ভারতবর্ষের সবচেয়ে সফল ও প্রভাবশালী মোগল সম্রাট। তাঁর আমলে অনেক পরিবর্তন ঘটে। এর মধ্যে বরফঘরের ধারণাটিকে তিনি আরও সুদৃঢ় করে বাস্তবায়ন করেন। তবে তখন বরফ ছিল শুধু অভিজাতদের হাতের নাগালে। পাওয়া যেত শুধু দিল্লি, আগ্রা ও ফতেহপুর সিক্রিতে। দিল্লি, লাহোর ও হায়দরাবাদের কয়েকটি প্রাসাদে এই বরফঘরের ধ্বংসাবশেষ আজও আছে।
বরফঘরগুলো সাধারণত মাটির নিচে বা আংশিক নিচু করে তৈরি করা হতো। এতে করে বাইরের তাপমাত্রা ভেতরে প্রবেশ করতে পারত না। এই ঘরের দেয়াল খুবই পুরু করে তৈরি করা হতো। কখনো কখনো তিন-পাঁচ ফুট পর্যন্ত হতো এর উচ্চতা এবং তৈরি হতো কাদামাটি, চুন, ইট বা কখনো পাথর দিয়ে। পুরু দেয়াল তাপ নিরোধক হিসেবে কাজ করত। বরফঘরের ছাদ রাখা হতো ঢালু, যাতে গরম বাতাস ওপর থেকে বেরিয়ে যেতে পারে এবং ঠান্ডা বাতাস নিচে জমে থাকে।
একেবারে অন্ধকার করে রাখা এসব ঘরে বাইরের আলো ঢুকতে পারত না। বরফের চাঁইয়ের চারপাশে খড়, কাঠকয়লা, পাট বা শুষ্ক পাতার আস্তরণ দেওয়া হতো তাপরোধক হিসেবে। এরপরের স্তর হিসেবে বরফ রাখা হতো স্তরে স্তরে, প্রতিটি স্তরের মাঝে আবার তাপরোধক উপাদান দেওয়া হতো। অনেক সময় বাঁশ বা কাঠের তৈরি কাঠামো ব্যবহার করে বরফের গাদা তৈরি করা হতো, যাতে বরফ গলে গেলে পানি নিচের দিকে নেমে যায়। সুতরাং এই বরফঘরকে রেফ্রিজারেটর এবং বাঁশের তৈরি কাঠামোকে আপনার ফ্রিজের আইসট্রের আদি পিতা হিসেবে ধরে নিতেই পারেন!
মোগলরা এ অঞ্চলে আসেন মূলত মধ্য এশিয়া থেকে। এ অঞ্চলের স্থায়ী নন তাঁরা। পারস্যে বরফ ব্যবহারের প্রচলন ছিল। সেই রীতিই তাঁরা নিয়ে আসেন ভারতবর্ষে। তবে বরফঘর তৈরি করা ছাড়াও প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি বরফ ব্যবহারের উল্লেখ আছে। কাশ্মীরের মতো শীতপ্রধান এলাকা থেকে ঘোড়ার পিঠে করে বরফ আসত রাজদরবারে। শীতকালে নিয়ে আসা বরফ বিশেষ উপায়ে সংরক্ষণ করা হতো গরমকালের অপেক্ষায়। এমনকি বাদশাহ হুমায়ুন ও তাঁর পুত্র প্রতাপশালী আকবরের আমলে দিল্লিতে বরফ আনার জন্য যমুনা নদীপথ ধরে ছিল বিশেষ গুপ্ত রাস্তা! পাহাড়প্রধান অঞ্চল, যেমন হিমাচল থেকেও আসত বরফ। প্রাচীন যুগে মানুষেরা শীতের রাতে মাটির মাত্রে সারা রাত বাইরে পানি ঢাকা দিয়ে রেখে বরফ জমাতেন। প্রাচীন ভারতের এই প্রক্রিয়াও অবশ্য নজর এড়ায়নি মোগলদের।
আকবরের পর তাঁর পুত্র জাহাঙ্গীর ও পৌত্র সম্রাট শাহজাহানের আমলে বরফের ব্যবহার পায় নতুন মাত্রা। সম্রাট জাহাঙ্গীরের ‘তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরী’তে আছে বরফ ব্যবহারের উল্লেখ। বরফঘরের দেখাশোনায় প্রহরী নিয়োগের মতো সতর্কতা অবলম্বন করতেও বাদ রাখেননি মোগলরা। তাঁদের আবার বিশেষ নামেও ডাকা হতো। নাম দেওয়া হয়েছিল ‘আবদার’। তাঁদের ছিল একটাই কাজ। বরফ যাতে গলতে না পারে, সেদিকে নজর রাখা এবং বরফকে প্রাসাদের রন্ধনশালায় সহিসালামতে পৌঁছে দেওয়া! এত রকম বুদ্ধি এঁটে বরফ জমানো মোগল সম্রাটরা কি জানতেন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য রেফ্রিজারেটর আবিষ্কারের পথ তাঁরা সহজ করে দিয়ে যাচ্ছেন?
ছবি: পেকজেলসডটকম ও উইকিপিডিয়া