আশি বছরের সুদীর্ঘ জীবনে কবিগুরু ভ্রমণ করেছেন ৩৩টি দেশ। একই দেশে গেছেন একাধিকবার। ভ্রমণ অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ভ্রমণপিপাসু ছিলেন কিন্তু ভ্রমণবিলাসী কিংবা ভবঘুরে ছিলেন না। তাঁর প্রতিটি ভ্রমণের নেপথ্যে এক বা একাধিক উদ্দেশ্য ও অভিপ্রায় ছিল বলেই অনুমেয়। ভ্রমণ অভিজ্ঞতা তিনি লিপিবদ্ধ করে গেছেন য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র, য়ুরোপযাত্রীর ডায়ারি, পথের সঞ্চয়, পথে ও পথের প্রান্তে, জাপান যাত্রী, পশ্চিম যাত্রীর ডায়ারি, জাভা যাত্রীর পত্র, রাশিয়ার চিঠি, পারস্য যাত্রী ইত্যাদি গ্রন্থে।
১৮৭৮ সালে সতেরো বছর বয়সে ইংল্যান্ডে পাড়ি দিয়েছিলেন। সেটা ছিল তাঁর প্রথম বিদেশ ভ্রমণ। আর শেষ ভ্রমণ ছিল ১৯৩৪ সালে; গিয়েছিলেন শ্রীলঙ্কায়। ৫৬ বছরের ব্যাপ্তিতে প্রায় সাড়ে ছয় বছরকাল বিশ্বভ্রমণে কাটিয়েছেন।
ক্যালকাটা ট্রেনিং একাডেমি, ওরিয়েন্টাল সেমিনারি, নর্মাল স্কুল, বেঙ্গল একাডেমি, সেন্ট জেভিয়ার্সের খাতায় নাম লিখিয়েও মেট্রিকুলেশন পর্যন্ত পৌঁছাননি। মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রস্তাব আনলেন, বিলাতে গিয়ে ব্যারিস্টারি পড়ানো হোক। সেকালে বিলাতে কোন রকম ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করলেই ব্যারিস্টারি পড়ার সুযোগ পাওয়া যেত। পরিকল্পনা মত ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করানোর জন্য ব্রিটেনের এক পাবলিক স্কুলে এবং পরে লন্ডন ইউনিভার্সিটি কলেজে রবীন্দ্রনাথকে ভর্তি করানো হয়; কিন্তু ম্যাট্রিকুলেশন পাশ হয়নি।
প্রথমবার বিদেশ ভ্রমণের সঙ্গী ছিলেন মেজদাদা। ১৮৭৮ সালে ২০ সেপ্টেম্বর সতের বছর পাঁচ মাস বয়সে রবীন্দ্রনাথ বোম্বাই বন্দর (বর্তমান মুম্বাই) থেকে পুনা ষ্টিমারে বিলেতের উদ্দেশে রওনা দেন। লোহিত সাগরের সুয়েজ বন্দরে নেমে রেলপথে মিশর হয়ে আলেকজান্দ্রিয়া বন্দরে পৌঁছান। সেখান থেকে পুনরায় সমুদ্রপথে মঙ্গোলিয়া জাহাজে ইতালির ব্রিন্দিসি বন্দর। তারপর রেলপথে প্যারিস হয়ে লন্ডন। দেড় বছর বিলেতে কাটিয়ে ১৮৮০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শিক্ষা অসমাপ্ত রেখে দেশে ফেরেন।
আবার দশ বছর পর বিলেত গমন। এবারের যাত্রায় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গী ছিলেন বন্ধুবর লোকেন্দ্রনাথ ও মেজদাদা। ১৮৯০ সালের ২২ আগস্ট শ্যাম জাহাজে বিলেত পাড়ি জমান। লন্ডনে একমাস কাটিয়ে টেমস জাহাজে চেপে বসেন দেশের উদ্দেশে। রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাত মুখোপাধ্যায় এই বিলেত যাত্রাকে “উদ্দেশ্যহীন কর্মহীন জীবনের উপসর্গ” বলে অভিহিত করেছেন। দ্বিতীয়বার বিদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ দুই খন্ডে ‘য়ুরোপ যাত্রীর ডায়ারি’ রচনা করেন।
তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত (১৩১৯ বঙ্গাব্দ) ‘যাত্রার পুর্বপত্র’ প্রবন্ধে তৃতীয়বার বিদেশ ভ্রমণের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন “কেবলমাত্র বাহির হইয়া পড়াই আমার উদ্দেশ্য। ভাগ্যক্রমে পৃথিবীতে আসিয়াছি, পৃথিবীর সাথে পরিচয় পূর্ণ করিয়া যাইব”। এবার ভ্রমণসঙ্গী ছিলেন পত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও পুত্রবধু প্রতিমা দেবী ।
১৯১২ সালের ২৭ মে বোম্বাই শহর থেকে ‘সিটি অব গ্লাসগো’ জাহাজে তৃতীয়বারের মত ইংল্যান্ড যাত্রা করেন। “পথের সঞ্চয়’ গ্রন্থে যতদূর জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ দীর্ঘদিন অর্শ রোগে ভুগছিলেন। অপারেশনের প্রতি তাঁর অনীহা ছিল। তিনি আমেরিকার বিখ্যাত হোমিওপ্যাথি ডাক্তার ন্যাসকে দেখানোর সুপ্ত বাসনা পোষণ করতেন।
১৯১২ সালের ২৮ অক্টোবর আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে এসে পৌঁছান। এবার দুই ভুখন্ডে কবিগুরু বছরকাল অতিবাহিত করেন।
ভ্রমণসঙ্গী ছিলেন মি পিয়ার্সন ও চিত্রশিল্পী মুকুল দে। ১৯১৬ সালের ১ মে তোসামারু জাহাজে চড়ে বসেন সবাই। ২৯ মে জাপানের কোবে বন্দরে পৌঁছান।
কবিগুরু জাপান যাত্রার আগ্রহ প্রকাশ করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং প্রফেসর কিমুরাকে চিঠি লিখেছিলেন। সেখানে তাঁর যে দুটো উদ্দেশ্য ব্যক্ত করেছিলেন তা হলো, আধুনিক জাপানের জাগরণ, জাপানী সাহিত্য সম্পর্কে জানা।
জাপানে তিন মাস কাটিয়ে ১৯১৬ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর কবি ওয়াশিংটন উপস্থিত হন।
এবারের ভ্রমণসঙ্গীরা হলেন পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পুত্রবধু প্রতিমা দেবী ও সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা মঞ্জুদেবী। ১৯২০ সালের ১৫ মে বোম্বাই বন্দর থেকে জাহাজ যোগে যাত্রা করে ৫ জুন ইংল্যান্ডের প্লিমাউথ বন্দরে উপস্থিত হন। ইংল্যান্ড থেকে নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম ও প্যারিস আবার লন্ডনে।
লন্ডন থেকে রটারডাম জাহাজে করে আমেরিকার উদ্দেশে যাত্রা করেন। আমেরিকায় ৫ মাস কাটিয়ে ইংল্যান্ডে ফেরেন। ১৯২০ সালের ১৬ এপ্রিল লন্ডন থেকে প্যারিস যান বিমানযোগে, এটিই কবিগুরুর প্রথম বিমানবিহার।
সুইজারল্যান্ড, ডেনমার্ক, ভিয়েনা, চেকোস্লভাকিয়া এই স্থানগুলো পরিভ্রমণ শেষে ১ জুলাই মোয়ারা জাহাজে স্বদেশ যাত্রা করেন।
বিশ্বভারতীর প্রতিনিধি হিসেবে কবিগুরু শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক একটি দল নিয়ে চীনে সফরে যান। এই দলে ছিলেন বিশ্বভারতীর অধ্যাপক ক্ষিতিমোহন সেন, নন্দলাল বসু ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. কালিদাস নাগ।
ধনপতি কিশোর বিড়লা এই ভ্রমণের ব্যয়ভার বাবদ এগারো হাজার টাকা দান করেন।
কলকাতা আউট্রামঘাট থেকে ইথিওপিয়া জাহাজে ১৯২৪ সালের ২১ মার্চ কবি সদলবলে যাত্রা করেন। রেঙ্গুন ও পেনাং হয়ে ৭ এপ্রিল সিঙ্গাপুর পৌঁছান। জাহাজ বদল করে, আতসুতামারু জাহাজে উঠে ১০ এপ্রিল চীনের হংকং বন্দরে উপস্থিত হয় দলটি।
১৯২১ সালে শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীর প্রথম বিদেশী অধ্যাপক সিলভা লেভির নেতৃত্বে চীনা ও তিব্বতী ভাষার চর্চাকেন্দ্র স্থাপিত হলে রবীন্দ্রনাথ জানতে পারেন, লুপ্তপ্রায় বহু অজ্ঞাত সংস্কৃত গ্রন্থ চীনা ও তিব্বতী ভাষায় অনুবাদের মাধ্যমে সংরক্ষিত আছে। সেগুলো উদ্ধারের জন্যই তিনি মূলত চীন গিয়েছিলেন। সেখান থেকে তিনি টোকিও গমন করেন। জাপানে এক মাস ঘুরে কলকাতা ফেরেন।
কবিগুরু পেরুর স্বাধীনতা শতবার্ষিকী উৎসবে যোগদানের আমন্ত্রণ পান। কিন্তু তাঁর পেরুতে যাওয়া হয়ে উঠেনি অসুস্থতার জন্য। আর্জেন্টিনার রাজধানী বন্দর বুয়েন্স আয়ার্সে তিনি আচমকা জ্বরে পড়েন।
এই সফরে তাঁর সঙ্গে ছিলেন পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পুত্রবধু প্রতিমা দেবী ও তাদের তিন বছরের পালিত কন্যা নন্দিনী।
যাত্রা করেছিলেন ১৯২৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর। ১৯২৫ সালের ২১ জানুয়ারী দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ইতালিতে যান।
ইতালি, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক, জার্মানি, চেকোস্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, যুগোস্লাভিয়া, বুলগেরিয়া, রুমানিয়া, তুরস্ক, গ্রিস, মিশর–
এই দীর্ঘ যাত্রা রবীন্দ্রনাথ শুরু করেন ১৯২৬ সালের ১৫ মে মুম্বাই বন্দর থেকে অকিলেহা জাহাজে। ভ্রমণসঙ্গীরা হলেন পুত্র-পুত্রবধু ও তাদের পালিত কন্যা নন্দিনী, শ্রীনিকেতনের সচিব প্রেমচাঁদ লাল, শান্তিনিকেতনের শিক্ষক গৌরগোপাল ঘোষ।
জগদীশ চন্দ্র বসুর সাথে আলোচনাকালে রবীন্দ্রনাথ জাভা ও বালদ্বীপে সংরক্ষিত ভারতীয় ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারেন। প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি ছিল কবিগুরুর বিশেষ টান।
১৯২৭ সালে জাভা থেকে আমন্ত্রণ এলে তিনি উদ্গ্রীব হয়ে পড়েন ভ্রমণের জন্য। এই সফরের সঙ্গীরা ছিলেন শান্তিনিকেতনের কলাভবনের সহকারী অধ্যক্ষ সুরেন্দ্রনাথ কর, তরুণ শিল্পী ধীরেন কৃষ্ণ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়।
১৪ জুলাই মাদ্রাজ থেকে আবোয়াজ নামের জাহাজে সদলবলে রওনা করেন। ২৭ অক্টোবর কলকাতা ফেরে দলটি। এবারের সফরনামা ‘জাভাযাত্রীর পত্র’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়।
কানাডার জাতীয় শিক্ষা পরিষদের আমন্ত্রণে এই সফর। এ যাত্রায় সফরসঙ্গী রয়েড টাকার, অপুর্বকুমার চন্দ্র ও কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। তিন সফরসঙ্গী ১লা মার্চ মুম্বাই থেকে নলদেরা জাহাজে কানাডার উদ্দেশে পাড়ি দেন।
পথিমধ্যে চীন, চীন থেকে আবারও জাপান হয়ে কানাডা পৌঁছান ২৮ মার্চ। সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্র যান। তারপর ২৭ জুন মাদ্রাজ অভিমুখে যাত্রা করে।
১৯৩০ সালে হিবার্ট বক্তৃতা দানের আমন্ত্রণ পেয়ে বিলেত আবারও পাড়ি জমান। সাথে ছিলেন পুত্র-পুত্রবধু ও তাদের পালিত কন্যা নন্দিনী। ১৯৩০ সালের ২ মার্চ কলকাতা থেকে বিলাতে রওনা হোন।
ইংল্যান্ড, জার্মানি ঘুরে ১১ সেপ্টেম্বর মস্কো রওনা করেন।
পারস্যের মহামান্য নৃপতি রাজা শাহ পহলভি কবিকে আমন্ত্রণ জানালে ৭২ বছর বয়সেও সেই নিমন্ত্রণ তিনি অগ্রাহ্য করতে পারেননি ।
১৯৩২ সালের ১১ এপ্রিল দমদম বিমান বন্দরে ডাচ বিমানে রবীন্দ্রনাথ পারস্য যাত্রা করেন। ভ্রমণসঙ্গী প্রতিমা দেবী, অমিয় চক্রবর্তী ও কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায়।
২ মে ইরানের রাজা রেজা শাহ পহলভির সঙ্গে কবির সাক্ষাত হয়। ৬ মে তেহরানে কবির জন্মোৎসব মহাসমারোহে পালিত হয়।
১৯২২ ও ১৯২৮ সালে বিশ্বভারতীর আদর্শ প্রচারে কবি সিংহল গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে আবারও যান ১৯৩৪ সালে। সেবার ৫ মে কলকাতা ইনচাংগা জাহাজে সিংহলে যাত্রা করেন। কবিগুরুর বর্নাঢ্য ভ্রমণ জীবন জানতে গিয়ে ঘুরে এলাম বিশ শতকের বিশ্ব।
তথ্যসূত্র: রবীন্দ্রজীবনী ১ম ও ৩য় খন্ড– প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
য়ুরোপ যাত্রীর ডায়ারি– রবীন্দ্ররচনাবলী, ২য় খন্ড
রবীন্দ্রনাথের ভ্রমণসাহিত্য– সন্তোষকুমার মন্ডল
ছবি: উইকিপিডিয়া, লেখক সংগৃহীত