শাঁখারীবাজারে ঢুকলেই ধূপ আর ধুনার সৌরভ নাকে এসে লাগে। পুরোনো বাড়ি আর দালান আপনাকে যেন নিয়ে যায় স্মৃতির শহরে। এখানে সারি সারি দোকানে দেখা মিলবে নানা ধরনের পণ্য। হাঁটতে হাঁটতে চোখ আটকে যায় শাঁখা, পলা, নানা আকারের রঙিন টিপ, গয়না আর বৈচিত্র্যময় শাড়ির সম্ভারে।
কথা হয় ঢাকেশ্বরী শঙ্খ শিল্পালয় অ্যান্ড বস্ত্রালয়ের স্বত্বাধিকারীর সঙ্গে। তিনি জানান পূজার উপকরণ সম্পর্কে। পূজার জন্য লাগে দেবীর শাড়ি, মালা ও চূড়া। অসুর, কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী ও সরস্বতীর পোশাক। লাগে খড়্গ, ত্রিশূল, চক্র, বল্লম, ঢাল, শঙ্খ, পদ্ম, গদা, তির-ধনুক, লক্ষ্মীর ঘট। এ ছাড়া কাঁসার থালা, গ্লাস, বাটি, পঞ্চবটি, প্রদীপ, পুষ্পপত্র লাগবে। মোটামুটি ২০০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকার মধ্যে এসব জিনিস পাওয়া যাবে। আবার দুর্গার প্রসাধনী, পোশাক ও গয়না, যেমন আলতা, সিঁদুর, শাঁখা, পলা, টিপ, নতুন শাড়ি, নতুন ওড়না, কান ও হাত, গলার গয়না ইত্যাদি ১ হাজার ২০০ থেকে ৪ হাজার টাকার মধ্যে। এ ছাড়া পৈতা, নতুন বস্ত্র, চাঁদমালা, ধূপদানি, পঞ্চপ্রদীপ, প্রদীপ, কর্পূর, ধূপ, ধুনুচি, বেলপাতা, দূর্বা—এগুলো লাগে ষষ্ঠী থেকে দশমী—সব দিনই।
সপ্তমী ও অষ্টমীর দিন বিশেষ করে লাগে পদ্মফুল। অষ্টমীর সন্ধিপূজায় ২১টি প্রদীপ অঞ্জলি দেওয়ার জন্য লাগে। মহাসপ্তমীর দিন লাগে নবপত্রিকা, যা মূলত ৯টি গাছের সমাহার। এগুলো হলো কদলী (কলা), দাড়িম্ব (ডালিম), ধান্য (ধান), হরিদ্রা (হলুদ), মানক (মানকচু), কচু, বিল্ব (বেল), অশোক ও জয়ন্তী। একটি কলাগাছের সঙ্গে অন্য গাছের চারা বেঁধে দেওয়া হয়। তারপর এতে শাড়ি পরানো হয়। একে বলা হয় কলাবউ। তিনি বলেন, কেউ অল্প খরচে পূজা করতে চাইলে অন্তত দেবীর মূর্তি, অনুষঙ্গসহ ৬০ হাজার থেকে ৭০ হাজার টাকা লাগবে। ভালো মানের মণ্ডপ ও পূজার জন্য সামগ্রীর জন্য ২ লাখ থেকে ৩ লাখ টাকা খরচ হবে।
পূজায় নারীরা সাধারণত শাড়ি আর পুরুষেরা ধুতি পরেন। দত্ত ভান্ডারের স্বত্বাধিকারী জানালেন, ধুতির দাম ৩০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত হয়। সিল্ক ও সুতির রেডিমেট ধুতি-পাঞ্জাবি সেট ১ হাজার থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা। খোলা ধুতি ১১ হাত বহর হয়ে থাকে।
দেবীর শাড়ি মূলত বেনারসি ও ভেলভেটের হয়। এতে থাকে নানা কাজ করা। দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এবার দামি কাপড় কম আনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা। ক্রেতাও তুলনামূলক কম বলে মনে হয়েছে। কার্তিক ও গণেশের কাপড়ের চাহিদা আছে, যা মূলত ঘিয়ে, সাদা ও কমলা রঙের হয়ে থাকে। অসুরের কাপড় হয় বাঘের চামড়ার প্রিন্টে। দাম পড়বে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা গজ।
পূজায় অত্যাবশ্যকীয় হচ্ছে দেবীর আসন, যা মার্বেল বা শ্বেতপাথরের হয়ে থাকে। অনুপ আর্ট পাবলিসিটির বিপ্লব সেন জানালেন, তাঁদের দোকানে যে আসন পাওয়া যায়, তার দাম পড়বে ৫০ হাজার থেকে ৭০ হাজার টাকার মধ্যে।
আদি ঢাকেশ্বরী শঙ্খভান্ডার। এই ব্যবসা পারিবারিক। দু শ বছরেরও বেশি সময় পারিবারিক ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন তাঁরা। শাঁখা ও পলা নিয়ে কথা হয় অলক ধরের সঙ্গে। তিনি জানান, পলা বিবাহিত-অবিবাহিত সবাই পরতে পারেন, তবে শাঁখা কেবল বিবাহিত নারীরা পরেন। মূলত দেবীকে অঞ্জলি দেওয়া, তাঁর চরণে সোপর্দ করতে, বিশেষ কোনো মনোবাসনা পূরণ করতে, পূজায় কাউকে উপহার হিসেবে দিতে কেনা হয় পলা। যার দাম সর্বনিম্ন ২০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। শাঁখার দাম ২০০ টাকা থেকে ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। গোল্ড প্লেটেড শাঁখাও আছে। নকশা ও মানের ওপর নির্ভর করে এর দাম।
শঙ্খ দুই ধরনের হয়ে থাকে—বামাবর্ত শঙ্খ ও দক্ষিণাবর্ত শঙ্খ। বামাবর্ত শঙ্খ পূজার সময় বাদ্যরূপে ব্যবহৃত হয়। আর দক্ষিণাবর্ত শঙ্খকে বিষ্ণুরূপে পূজা করা হয়। উভয় শঙ্খের দাম ৪০০ থেকে ৮ হাজার টাকা। শ্রীলঙ্কার শঙ্খের মান ভালো, তাই এর দাম বেশি। আলতার দাম ৫০ টাকা থেকে শুরু করে ১০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। এ ছাড়া সিঁদুর গুঁড়া ও তরল দুই রকম হয়। দাম ৫০ থেকে ২০০ টাকা।
বাড়ির দুর্গাপূজায় যা লাগে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানান অঞ্জলি শঙ্খভান্ডারের সন্তোষ নন্দী। তিনি বলেন, মহাদেবের ছবি আবশ্যক। লাগবে প্রচুর ফুল, যার মধ্যে অপরাজিতা, লাল জবার মালা থাকতেই হবে। দুটি পানপাতা, লাল ফুল, কচি ডাব, পদ্মফুল, বেলপাতা, মাটির ঘট, আমপাতা, বেলপাতার মালা, সুপারি, কাঁচা হলুদ থাকে। রসাল ফল লাগবে পাঁচ রকমের। মিষ্টি, মুড়কি, নারকেল ও তিলের নাড়ু, মোয়া ইত্যাদি। নৈবদ্য দিতে হয় নবগ্রহকে এ সময়। পূজায় নৈবদ্য লাগেই। নৈবদ্য দিতে লাগে আতপ চাল। এ ছাড়া লাগে পৈতা, নতুন বস্ত্র, চাঁদমালা। ধূপদানি, পঞ্চপ্রদীপ, প্রদীপ, কর্পূর, ধূপকাঠি, ধুনুচি, বেলপাতা, দূর্বা, লবঙ্গ, এলাচি লাগে।
দেবী দুর্গাকে দেওয়ার জন্য লাগে আলতা, সিঁদুর, শাঁখা, পলা, টিপ, নতুন শাড়ি, নতুন ওড়না, কান, হাত ও গলার গয়না। পূজার যাবতীয় মাঙ্গলিক উপকরণের মধ্যে থাকে মহাস্নান সামগ্রী। যেগুলো হলো—পাক তেল, মৃত্তিকা জল, নারায়ণ তৈল, নির্ঝরোদক জল, বিষ্ণু তেল, ফলদক জল, ঘি, বৃষ্টির জল, মধু, সরস্বতী জল, আবির,পঞ্চরত্নমিশ্রিত জল, পঞ্চশষ্য, গঙ্গাজল, ধান, যব, তিল, ইক্ষুরস, শ্বেত শর্ষে, সর্বৌষধি, হরীতকী, মহৌষধি, কড়ি, পঞ্চকষায়, পঞ্চগুঁড়ি, গিলা, মেটে সিঁদুর, পাঁচ ফল, সপ্তধাতু, নবরত্ন, প্রবাল, পঞ্চরত্ন, মুক্তা, আসন আঙ্গুরী, কেশর, কর্পূর, চুয়া, গোলাপজল, অগুরু, তিলের তেল, সুগন্ধি তেল, ফুলন তেল, কস্তুরি, পঞ্চমণ্ডলের গুঁড়ি, পদ্মরেণু, পঞ্চপল্লবের গুঁড়ি, অষ্টবর্গ ও গৌরচনা। এসব উপকরণ মিলিয়ে একটি বাক্স পাওয়া যায়, দাম পড়বে ১ হাজার টাকা।
ছবি: শিশির চৌধুরী